ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

উন্নয়ন ও উপন্যাস ॥ যুক্তরাষ্ট্রের কথা

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ১৮ জুন ২০১৯

উন্নয়ন ও উপন্যাস ॥ যুক্তরাষ্ট্রের কথা

১৯৫৮-৫৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ার ক্রমে অধ্যাপক রেহমান সোবহান আমাদের পড়িয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস। তাঁর স্বভাব সুলভ বাগ্মিতার পরিশীলনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ইতিহাস হিসাবে ব্রিটেনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও রাজনীতির এককালীন অধ্যাপক (সম্ভবত রেহমান সোবহানের শিক্ষক) ফ্রাঙ্ক থিসিলথওয়েটের লেখা ‘দি গ্রেট এক্সপ্যারিমেন্ট’ পড়তে বলেছিলেন। তাঁর বক্তৃতা শুনে ও থিসিলথওয়েটের বইটি পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রথাগত বিশ্লেষণের বাইরে সেদেশের অভিবাসী জনগণের প্রচেষ্টার অর্জন হিসাবে বুঝতে চেয়েছি সে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া। থিসিলথওয়েট বলতে চেয়েছেন, ১৮ ও ১৯ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে ইউরোপ থেকে আগত অভিবাসীরা তাদের প্রযুক্তি ও অদম্য কর্মপ্রচেষ্টার মূল্যবোধ নিয়ে সেদেশের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে ভিত্তি করে দ্রুতবেগে অভাবনীয় প্রগতি অর্জন করে। অন্যকথায়, তার বিশ্লেষণে অভিবাসী তথা জনগণের সামনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য মূল্যবোধ তাদের প্রগতির গুরুত্বপূর্ণ ধারক ও বাহক হিসাবে কাজ করেছে। থিসেলথওয়েটের এই বিশ্লেষণকে ভিত ধরে আমি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের উন্নয়ন মানস কিভাবে এবং কতটুকু কাজ করেছিল তা জানা ও বোঝার জন্য ওই দেশের সময়ান্তরিক সাহিত্যে প্রতিফলিত মানসিকতা বুঝতে চেষ্টা করেছি। ফরাসী বিপ্লবের সময়কালীন মানুষের অধিকার বিষয়ক উপন্যাস ও গল্প জনগণকে যেভাবে উজ্জীবিত করেছিল তা সবারই জানা। রুশ বিপ্লবের আগে ও পরে তখনকার উপন্যাস এবং অন্যান্য লেখাসমূহ যেভাবে জনগণকে পরিবর্তনের অনুকূলে ও মানুষের সমাজে সমতা বিস্তারণে প্রভাব ফেলেছিল তা আমাকে সমাজের প্রগতি বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক উপকরণের বাইরে যুগমানসের ভূমিকা ও অবদান জানার জন্য উৎসাহিত করেছে। এই পটভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নে মানুষের অদম্য সাহস, নিরন্তর পরিশ্রম ও জয় করার অপরাজেয় বাসনা আমার বিবেচনায় সবচেয়ে আগে বিস্তৃতভাবে প্রকাশ পেয়েছে হারমেন মেলভিলের মবি ডিক উপন্যাসে। বইটি ১৮৫১ সালের শেষার্ধে যুগপৎভাবে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়েছিল। তিমি মাছ ধরার জাহাজ পিকোয়েভের ক্যাপ্টেন তিমির আঘাতে এক পা হারানো আহাব কি অদম্য সাহস সংকল্প বোধ নিয়ে মবি ডিক আখ্যায়িত শ্বেত বর্ণের পুরুষ- তিমিকে পরাজিত ও হত্যা করার জন্য এক মহাসাগর থেকে আরেক মহাসাগর ছুটে শেষ পর্যায়ে ৩ দিন ধরে ক্ষুদ্রাকৃতির নৌকা নিয়ে একাই সেই তিমির সঙ্গে যুদ্ধ করে তিমির সঙ্গেই মহাসাগরের নীল পানিতে হারিয়ে যান, তা সেকালের অভিবাসী জনগণের সামনে সকল বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আত্মিক উপকরণ হিসাবে ফুটে উঠেছে। ডি এইচ লরেন্স মবি ডিককে সাগরের ওপর লেখা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বই হিসাবে আখ্যায়িত করে হারমান মেলভিলকে সাধারণ মানুষের অদম্য সাহস ও স্পৃহার প্রতিফলক হিসাবে সম্মানিত করেছেন। আমার বিবেচনায় সকল বাধা পার হয়ে প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদ আহরণে মানুষের অদম্য সাহস ও সংকল্পবোধ কিভাবে ও মাত্রায় অর্থনৈতিক প্রগতির ধারা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, মবি ডিক তারই প্রতিফলক হিসাবে কাজ করেছে। মেলভিনের মবি ডিকের প্রকাশনার ১ বছর পরে প্রকাশিত হয়েছিল হেরিয়েট বিচার স্টয়-এর ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’। স্টয় যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরাঞ্চলের কানেকটিকাটে শিক্ষিকা ছিলেন। এই বইয়ে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রে, বিশেষত দক্ষিনাঞ্চলে প্রচলিত দাস প্রথাকে তিনি মানবিক মূল্যবোধ বিরোধী এবং মানুষের উৎপাদনশীলতা প্রযুক্তকরণের প্রতিকূল বলে প্রতিফলিত করেন। বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের এবং নারী পুরুষের সমতাকে তিনি তাঁর মর্মস্পর্শী কাহিনী দিয়ে তাঁর সময়কার শিক্ষিত ও সচেতন জনগণকে তাদের অভীষ্ট বলে গ্রহণ করতে উদ্দীপ্ত করেন। দাস প্রথাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধে সমতার সারথী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন স্টয়কে সেই গৃহযুদ্ধ শুরু করার নায়িকা হিসাবে অভিহিত করে সম্মানিত করে গেছেন। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ৪ দশক ধরে বিনিয়োগ, অধ্যবসায় ও সংকল্পবোধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপামর জনগণ তাদের উৎপাদনশীলতার সীমান্ত দ্রুত গতিতে ও বিস্তৃতভাবে বাড়িয়েছিলেন। আমার বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণভিত্তিক সমতার সমকালীন পর্যায়ে প্রগতির অন্যতম ফলপ্রসূ আহ্বান এই উপন্যাসে পৃথিবীব্যাপী সকলকে সন্দিপীত করেছে বলা চলে। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে এই সন্দীপনই মার্টিন লুথার কিং-এর আহ্বান সকল অসমতা ও বাধা অতিক্রম করে সর্বজনীন জয় অর্জন করার দৃঢ় সংকল্পবোধ জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল জনগণকে উদ্দীপিত করেছিল। মার্ক টোয়েন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক পর্যায়ের সবচেয়ে নামকরা উপন্যাসিক। তাঁর ‘এ্যাডভেঞ্চারস অব টম সোয়ার’ (১৮৭৬), ‘দি প্রিন্স এ্যান্ড দি পপার’ (১৮৭৬), ‘লাইফ অন দি মিসিসিপি’ ও ‘এ্যাডভেঞ্চারস অব হাকলবারী ফিন’ (১৮৮৫) আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাঁর এসব উপন্যাসে যেমনি সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা ধ্বনিত এবং বৈষম্যহীন মানব সমাজ প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার বাসনা প্রতিফলিত করেছে, তেমনি প্রকৃতির বিরূপতাকে পেছনে ফেলে তার সম্পদ আহরণ ও তাকে মানব উপযোগে ব্যবহার করার অবচেতন একাগ্রতা উন্নয়নের উপকরণ অবয়বে তুলে ধরেছে। এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত গায়ক ভূপেন হাজারিকা তাঁকে রুশ বিপ্লবকালীন সংবেদনশীল সন্দীপন উৎসারী ম্যাক্সিম গোর্কির সমতুল্য বলে সম্মান জানিয়েছেন। (দ্রষ্টব্য : ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মার্ক টোয়েনের সমাধির পরে গোর্কির কথা, জনকণ্ঠ, ৩ মে, ২০১৯)। এরপরে সেদেশে সাধারণ মানুষের হার না মানার মানস ফুটিয়ে তুলেছেন জন স্টেইনবেক। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘দি গ্রেপস অব রেথ’ বহুল প্রচারিত মানবাশ্রয়ী উপন্যাস। এই উপন্যাসের লেখক হিসেবে স্টেইনবেক ১৯৫২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৩০-এর মহামন্দার পটভূমিতে স্টেইনবেক লিখেছিলেন ‘দি গ্রেপস অব রেথ’। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯-এ। এই মহামন্দার সময়ে (১৯৩১-৩৯) ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্য থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়ার পথে এক দরিদ্র প্রজা কৃষক পরিবারের ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটানোর সংগ্রামের কাহিনী বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। আইনী অসমতা, অর্থনৈতিক বঞ্চনা, বড় বাণিজ্যিক খামারিদের ছোট প্রজা কৃষকদের শোষণ, শোষিতদের সংগঠিত হওয়ার সূচনা এবং এসব ছাড়িয়ে সকল বাধা ব্যত্যয়ের প্রতিকূলে সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম অনবদ্য সংবেদনশীলতায় ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। ফ্রান্সের লামঁদে পত্রিকা এই বইকে বিংশ শতাব্দীর ১০০ শ্রেষ্ঠ বইয়ের মধ্যে ৭ম বলে বিবেচিত করেছে। স্টেইনবেকের উপন্যাস পড়ার পরপরই আমি পড়েছি উইলিয়াম ফকনারের ‘দি সাউন্ড এ্যান্ড দি ফিউরি’ এবং ‘এজ আই লে ডায়িং’। ফকনার ১৯৪৯ এ মূলত এই উপন্যাসের জন্য সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন। তাঁর বইয়ে সমাজিক নিয়ন্ত্রণ থেকে প্রায় পূর্ণভাবে ধনতন্ত্রকে ছেড়ে দেয়ার পরিবেশে স্বল্পবিত্ত সাধারণ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়ার আর্তি ফুটে উঠেছে। ১৯২৩ সালে তিনি বলেছিলেন, আমি যতদিন বাঁচব ততদিন বিত্তশালী লোকের চাহিদা অনুযায়ী আমার জীবন প্রভাবিত থাকবে। তাঁর লেখায় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষত মিসিসিপি নদী অববাহিকা এলাকায় অধ্যুষিত উন্নয়ন সাধনে সংগ্রামরত সাধারণ মানুষের অবস্থা, দুঃখ-দারিদ্র্য, আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিভাত হয়ে সামষ্টিক পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাজ অর্জিত সমৃদ্ধি সকলের জন্য লভ্য করার আবেদন ফুটে উঠেছে। আমেরিকান উপন্যাসিকদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। তাঁর ‘দি সান অলস রাইজেস’ (১৯২৬), ‘এ ফেয়ার ওয়েল টু আর্মস’ (১৯২৯), ‘ফর হোম দি বেল টলস’ (১৯৪০) এবং ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দি সি’ (১৯৫১) আমেরিকান উপন্যাসের ক্ষেত্রে অনবদ্য সৃষ্টি। এসবের মধ্যে সকল বাধাবিঘœ পার হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া, আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা এবং এই দুইয়ের মিশ্রণে সৃষ্টির সকল ক্ষেত্রে মানুষের স্বকীয়তা প্রকাশনকে হেমিংওয়ে অনবদ্য সরল রৈখিকতায় তুলে ধরেছেন। বিশেষত ‘দি ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দি সি’তে তিনি প্রতিকূল পরিবেশে মানুষের জয়কে সূর্যালোকিত সমৃদ্ধির তট হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। গত শতাব্দীর সবচেয়ে নামকরা অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েলসন তাঁর পৃথিবী প্রখ্যাত অর্থনীতির অবতরণীকামূলক পাঠে হেমিংওয়ের উপন্যাস ‘ফর হোম দি বেল টলস’ এর শিরোনাম অর্থ ব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রে ও পর্যায়ে সাধারণ মানুষের ভূমিকা ও অভীষ্টের বিস্তৃতির স্বীকৃতি অবয়বে গ্রন্থিত করে তাঁকে সম্মান জানিয়েছেন। প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে সমৃদ্ধির পথে দৃঢ় সংকল্পবোধ নিয়ে সম্পদ অর্জন ও সৃজনের লক্ষ্যে সাধারণ মানুষের এগিয়ে যাওয়া এক্ষেত্রে মার্কিন জনগণের অদমনীয় সৃজন ও উৎপাদন অভিমুখে জয়যাত্রার সহজাত মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করেছে। মূলত এই বিবেচনায়ই ‘দি ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দি সি’ ১৯৫২ সালে হেমিংওয়েকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছে। প্রথাগত বিশ্লেষণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের তিন প্রধান সময়ান্তরিক উপকরণ, যথা- (১) অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, (২) সম্পদকে মানুষের ভোগ ও ব্যবহার যোগ্য করনে কারখানা ভিত্তিক শিল্পের প্রসার এবং (৩) প্রযুক্তিকে উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করে নতুনতর সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়। এই তিন উপকরণের ফলপ্রসূতা সর্বজন স্বীকৃত। তথাপি এই উপকরণ সমূহ আহরণ ও প্রযুক্ত করার প্রক্রিয়ায় মানুষের মূল্যবোধ ও অধ্যবসায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমার কাছে এই ক্ষেত্রে ভূমিকা ফুটে উঠেছে উন্নয়নের পথে সৃষ্ট সাহিত্যে, বিশেষত উপন্যাসসমূহে। এর বাইরে ১৯৩০-এর দশক থেকে শুরু করে সমাজে সুযোগের সমতা সৃষ্টি করার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সর্বজনীন সামাজিক দায়িত্ব স্বীকার করিয়ে নেয়ার বেলাও এসব বই জনগণ ও তাদের নেতৃত্বকে সন্দিপীত করেছে। এত সত্ত্বেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক প্রগতির বিশ্লেষণে এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিপাদ্য বিষয় এখনও যথার্থ স্বীকৃতি পায়নি। এরূপ স্বীকৃতির অভাব কিংবা অনুপস্থিতি নির্মোহ বিশ্লেষণে কার্যকরণ সূত্রের আলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূমিকা খাটো করতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস। থিসিলথওয়েটের ‘দি গ্রেট এক্সপ্যারিমেন্ট’ এদিকে আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেহমান সোবহানের দেয়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাঠ এভাবেই আমাকে অন্যান্য সহযোগীর সঙ্গে সচেতন ও সন্দিপীত করেছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিবর্তন ও উন্নয়ন এ প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে একটি বিষয় সামনে চলে আসে। অর্থনৈতিক প্রগতির দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সাম্প্রতিককালে উন্নয়নের আরেক মূলধন হিসাবে যথার্থ মাত্রায় ইতিবাচক মূল্যবোধে সন্দিপীত শিক্ষিত ও দক্ষ এবং স্বাস্থ্যবান জনগণকে মানব সম্পদের বিকল্পে এবং ওপরে মানব মূলধন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছি এবং প্রযুক্ত করতে সচেষ্ট হয়েছি। মানব মূলধনের সৃজন, সম্প্রসারণ ও প্রয়োগ সমকালে আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যেমনি অভীষ্ট, তেমনি উপকরণ। যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতার আলোকে সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে মানব মূলধন সৃজন এবং প্রয়োগকরণে এই প্রেক্ষিতে আমাদের দেশে অধিকতর দৃষ্টি ও গুরুত্ব দেয়া সার্বিকভাবে লক্ষানুগ। আমাদের সাহিত্য-গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, নিবন্ধ, এমনকি গান- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের অধিকার অর্জন, প্রয়োগ এবং এর ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক অভীষ্ট অর্জনের তৃপ্তি ও সন্তোষ দিয়ে জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে (উদাহরণত, দ্রষ্টব্য মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রণোদনা : গান, দৈনিক ভোরের কাগজ, ঈদ সাময়িকী ২০১৯)। কিন্তু এই অধিকার ও গণতান্ত্রিকতা অর্জন এবং বিস্তারণের সঙ্গে উদ্ভাবনশীলতা ও অধ্যবসায়ের ভিত্তিতে প্রগতির পথে দ্রুত বেগে এগিয়ে যাওয়ার সন্দীপন কিংবা মূল্যবোধ যথার্থ মাত্রায় আমাদের লেখকরা এখনও সৃষ্টি করতে এগিয়ে এসেছেন বলা চলে না। আমরা এখনও আমাদের মানব সম্পদকে মানব মূলধনে রূপান্তর করতে সক্ষম হইনি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন অনুসারে এই অসম্পূর্ণতা ও তা দূরীকরণের প্রয়োজন যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে মেনে নিয়ে আমরা যদি অগ্রসর হই, তাহলে সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অধিকতর সফলতার পথে ইপ্সিত দ্রুত বেগে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বলে অর্থনীতির অনুশীলনকারী হিসাবে আমার বিশ্বাস। লেখক : সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী
×