ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বীপরাষ্ট্রের সামাজিক বলয়

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ১৮ জুন ২০১৯

দ্বীপরাষ্ট্রের সামাজিক বলয়

ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় ১৮০০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্র বন্দর সিঙ্গাপুরের নিজস্ব সীমানা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এক সমৃদ্ধ দর্শনীয় অঞ্চল। সুদীর্ঘ অতীত ইতিহাসের কোন ঐতিহ্যিক সম্ভাবের অনুপস্থিতিতে কিভাবে দেশটি সময়ের মিছিলে তৈরি হয়েছে তাও এক বিস্ময়কর পথপরিক্রমা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছোট দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে সমধিকখ্যাত হয়েও অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিস্তৃত আঙ্গিনায় নিজেকে শামিল করা আধুনিকতার উদ্দীপ্ত মহিমা। দেশটি মালয় উপদ্বীপের একান্ত কাছাকাছি জায়গায় নিজের অবস্থান জানান দিলেও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে এমন সমৃদ্ধ আর স্বাতন্ত্র্য পুরো অঞ্চলটিকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে সময় নেয়নি। আনুষ্ঠানিকতার নির্দিষ্ট আলয়ে এই ছোট্ট দ্বীপটি সিঙ্গাপুর প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপরিচয়কে বিশ্বের কাছে নন্দিত করেছে। দেশটির নামকরণের বিশেষত্বে যেমন চমক আছে, তার সঙ্গে মেলানো হয়েছে শক্তি আর শৌর্যের এক অপূর্ব সমন্বয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধনের অনিবার্যতায় নামকরণেও এসেছে মালয় শব্দ কোষের অনন্য অভিযোজন। বলা হচ্ছে সিঙ্গাপুর নামটিই নাকি মালয় শব্দের সিঙ্গাপুরা থেকে চয়ন করা, যার উৎপত্তিতে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব আছে বলে বিজ্ঞজনদের অভিমত। আর বাংলার যার যথার্থ প্রতিভাষা সিংহপুর। যে সিংহ দেশটির গৌরব আর ঐতিহ্যের স্বাক্ষর হয়ে প্রতিনিয়তই জনগোষ্ঠীকে শুধু উদ্দীপ্তই নয়, দর্শনীয় হয়েও দেশী-বিদেশী পর্যটকদের মনোরঞ্জন করে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুরের মারলায়ন পার্কে বনের রাজা সিংহের মূর্তি তাই দর্শনার্থী আর পর্যটকদের আনন্দ উপভোগের বিশিষ্ট বিনোদন পর্যায়। এই গৌরবোজ্জ্বল সিংহের ভয়ানক গর্জনের বিপরীতে মুখগহ্বর থেকে অবিরত জলরাশির প্রবাহমান দীপ্তি এক আকর্ষণীয় বিমুগ্ধ বিস্ময়। দেশটির নৈসর্গিক সম্ভার আমাদের দেশের মতো প্রকৃতির অবারিত দান নয়। কষ্ট করে জ্ঞান, বুদ্ধি ও সময়ের দুর্বার বলয়ে প্রতিনিয়তই এমন শৃঙ্খলায়িত সৌন্দর্যকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে হয়েছে। গড়ে তোলার এমন মুগ্ধতার অপার সম্ভাবনায় দেশটি নিরন্তর সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমৃদ্ধ অর্থনীতির শক্ত বলয় সমস্ত বিপর্যয়কে অতিক্রম করতে যে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে, সেখানে দেশপ্রেমিক এই জাতি এক অনমনীয় আদর্শ আর নীতিনৈতিকতায় দুর্বার শক্তি অর্জনে সময়ের নিরন্তর স্রোতে নিজেদের প্রমাণ করা ছাড়া অন্য কোন দিকে তাদের নজরও নেই। এক নিয়মানুগ শৃঙ্খলাবদ্ধ গোষ্ঠী হিসেবে সিঙ্গাপুরের অধিবাসীরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ আর ভাষা নির্বিশেষে সবাই সম্মিলিতভাবে দেশটিকে আধুনিকতার বলয়ে নিরন্তর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আপন কৃষ্টি আর সংস্কৃতির সঙ্গে, যা নিজেদেরই কষ্ট করে অর্জন করতে হয়েছে, সেটাই সমন্বিতভাবে স্বাগত জানায় নতুন সময়ের বিজ্ঞান অভিযাত্রার সমৃদ্ধ পথপরিক্রমার। অনেকটা নিজেদের থাকলেও বহির্বিশ্ব থেকেও কিছু কম নিতে হয়নি। সাজানো-গোছানো দ্বীপ রাষ্ট্রটি মাটি থেকে আরম্ভ করে গাছপালা, ফলমূলের সম্ভাবনাময় সমারোহ অন্য দেশ থেকে নিজেদের সীমানায় নিয়ে এসে সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে খুব বেশি সময় নেয়নি। কয়েকটি দ্বীপের মহাসম্মিলনে সিঙ্গাপুরের স্থলভূমির যে ৬৯৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন, তা সমুদ্র সমতল থেকে মাত্র ১৫ মিটার দূরে অবস্থিত। পুরো সিঙ্গাপুরই নদীর চারপাশের গড়ে ওঠা এক অত্যাধুনিক দ্বীপ রাষ্ট্র। প্রকৃতির অকৃত্রিম দানে দেশটি ভরপুর নয় বলে সেভাবে কোন প্রাকৃতিক হ্রদও নেই। কর্মঠ এবং আধুনিক জাতি হিসেবে নিজেরাই সুপেয় পানির জন্য তৈরি করে কৃত্রিম জলাধার। একটি সুসংহত সরকারী ব্যবস্থাপনায় পুরো দেশটির শাসন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামো পুরো দেশটিকে সংহত করলেও একদলীয় রাজনৈতিক শাসনে পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা নির্ণীত হয়। সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের আদলে গড়ে ওঠা সিঙ্গাপুরের রাজনৈতিক পরিসর পিপলস এ্যাকশন পার্টির নিয়ন্ত্রণে ১৯৫৯ সালের নির্বাচন থেকে শাসন ক্ষমতা পরিচালিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব দৃশ্যমান হলেও তারা মূলত ক্ষমতা বর্জিত অংশ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আসছে। তাই বিশ্বে দেশটি একদলীয় শাসনের একনায়কত্বে পরিচিত হতে বেশি সময় নেয়নি। তবে সিঙ্গাপুরের সরকারী ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত, জনবান্ধব প্রশাসন হিসেবে দুনিয়াজোড়া প্রশংসা অর্জন করেই যাচ্ছে। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একেবারে স্বাধীন। কেউই কারও ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ করে না এবং সুযোগও নেই। দীর্ঘদিন থেকে এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতি মুক্ত দেশ সিঙ্গাপুর। ৫০ লাখ জনসংখ্যার এই ক্ষুদ্র অঞ্চলটি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ আর খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীরা পারস্পরিক সহমর্মিতায় নিকটজনের মতো শান্তি আর স্বস্তিতে বসবাস করে আসছে। কয়েকটি দেশের জনসংখ্যার অবিমিশ্র মিলনে সিঙ্গাপুরের আর্থ-সামাজিক বলয়ের যে সুসংহত অভিযাত্রা, তাও হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখায়। চীন, মালয়েশিয়া, ভারত এবং কিছু পাশ্চাত্য দেশের জনসংখ্যার অভূতপূর্ব মিলন সৌধে সিঙ্গাপুরের যে সমৃদ্ধ বলয়, তা জনগোষ্ঠীর নিবিড় একাত্মতাকে অন্যমাত্রায় পরিশীলিত করে। এক দলীয় শাসন ব্যবস্থায় চলা সিঙ্গাপুর ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন সূচকে বিশ্বের নবম স্থানে। সংস্কৃতি যে কোন দেশের নিজস্ব বলয় আত্মপরিচয়ের সূচক, জনগোষ্ঠীর সংখ্যা, বোধ আর আচার আচরণের নিয়ামক। বাইরে থেকে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব দৃশ্যমান হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলামী সংস্কৃতিও পারস্পরিক বলয়ে আপন গতিতে চলমান। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমেও এর ব্যত্যয় ঘটে না। ফলে সরকারী দাফতরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজী, মালয়, চীনা এবং তামিল ভাষাও স্বীকৃত এবং প্রচলিত। তবে সর্বজনীন ভাষা হিসেবে ইংরেজীর গুরুত্ব অন্য ভাষার চাইতে বিশিষ্ট পর্যায়ে। শিক্ষার ক্ষেত্রে তো অনেকখানি। শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যম হিসেবে ইংরেজী ভাষার গুরুত্ব সমধিক। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে লালন করা হয়। তবে বেসরকারী কার্যক্রমও শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম পর্যায়। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। তবে প্রাথমিক-মাধ্যমিক এবং প্রাক বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থাকে অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, যা বিশ্বের বিভিন্ন মানের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রচলিত এবং প্রয়োজনীয়। নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সক্ষমতার বলয়ে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সমানতালে অগ্রসরমান দেশটি দুর্নীতি নামক সামাজিক অপশক্তি থেকে একেবারে মুক্ত। অনিয়ম এবং অপরাধের জন্য যে শাস্তি প্রাপ্য, তা যতই কঠিন এবং ভয়াবহ হোক না, কোন কিছুর বিনিময়ে এমন শক্ত দ- থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। ফলে অন্যায় এবং অসামাজিক কার্যকলাপ কোনভাবেই দৃশ্যমান নয়। সড়ক-মহাসড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াই অত্যন্ত নিয়মানুগভাবে পরিবহন ব্যবস্থা সুশৃঙ্খল এবং সংহত। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তায় পথচারী পারাপারও শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটায় না। অদ্ভুত এক সুশৃঙ্খল এবং সুসভ্য জাতি। নিয়ম কানুন, বিধি নিষেধকে সচেতন বোধে একেবারে ভেতরে থেকে তৈরি করা হয়েছে। যা অসচেতনভাবে কিংবা ভুলেও কারও আয়ত্তের বাইরে চলে যায় না। পর্যটন শিল্পে সমৃদ্ধ এই দেশটিতে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য ভ্রমণপিপাসু সিঙ্গাপুর বেড়াতে আসে। বাংলাদেশ থেকেও বহুলোক ভ্রমণ করতে যায়। চিকিৎসার কারণেও বাংলাদেশীদের অবস্থান চোখে পড়ার মতো। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতম শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পেয়ে জ্ঞানার্জন করতেও আসে। তবে শিক্ষা শুধু শিক্ষাঙ্গনের সুনির্দিষ্ট আলয়ে সীমাবদ্ধ নয়। সামাজিক জীবনের বিচিত্র ক্ষেত্রে শিক্ষা লাভের যে অবর্ণনীয় সুযোগ সিঙ্গাপুরে, তেমন অবস্থা সর্বত্রই দৃশ্যমান হয়ে আছে। শুধু দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে চলে আসাটা একেবারে বোকামি। বরং তাদের ন্যায়নিষ্ঠতা, নীতিনৈতিকতায় সামাজিক দায়বদ্ধতার যে অবিস্মরণীয় যোগসাজশ, তাকেও গ্রহণ করার মানসিকতা ভেতর থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে। সব দেশের ভাল জিনিসগুলো আয়ত্তে আনতে পারলে আমরাও এক দিন জাতি হিসেবে বিশ্বের সামনের সারিতে চলে আসব। লেখক : সাংবাদিক
×