ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

রুদ্র ছিলেন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ১৮ জুন ২০১৯

রুদ্র ছিলেন প্রজন্মের কণ্ঠস্বর

‘হাত ধরো, হাত ধরো- আমি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিবর্তে এনে দেবো তৃতীয় পৃথিবীর শ্রেণীহীন কবিতার ভুবন’ -রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আকাশছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে পৃথিবীর বুকে কিছু কীর্তিমান বিপ্লবীর আবির্ভাব ঘটে, যারা প্রেমময় সাম্যের পৃথিবী গড়তে তরুণ প্রজন্মের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে আজীবন নিরন্তর লড়াই করে। বাংলা কাব্য সাহিত্যে এমনি একজন ক্ষণজন্মা বিপ্লবী কবি এসেছিলেন, নাম তার রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। ঘুণে ধরা জরাজীর্ণ সমাজকে বদলে দিতেই তরুণ এই কবির জন্ম হয়েছিল। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে রাজ্যের অভিমান নিয়ে পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে তিনি চিরতরে ওপারে চলে যান। তবে এই স্বল্প জীবনেই তিনি হয়েছিলেন মুকুটবিহীন কাব্য স¤্রাট। গত শতাব্দির ৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত দেশে এমন কোন আন্দোলন নেই, যেখানে কবির অংশগ্রহণ ছিল না। অন্যায়, অবিচার ও অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী কবিতা লিখেছেন। মুক্ত মঞ্চে সেই কবিতাগুলো আবৃত্তি করে তরুণ প্রজন্মের ভেতরে প্রতিবাদী সত্তা জাগ্রত করার নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর মননে ছিল কবিতা, আবৃত্তিতে অনলবার্তা আর রক্তে প্রবাহিত বিদ্রোহের লাভা। মৃত্যুর মাঝেই তাঁর সংগ্রামী জীবনের অবসান ঘটে। তবে তাঁর প্রতিবাদী কবিতাগুলো আজও তরুণ প্রজন্মের হৃদয় আন্দোলিত করে। কবিতা, গল্প, কাব্যনাট্য, প্রবন্ধ, গান- যেখানেই শিল্প সাহিত্য সেখানেই রুদ্র। তিনি ভক্তদের হৃদয় সিংহাসনে বসে আছেন কবিতার রাজপুত্র হয়ে। তাকে বলা হয় বাংলা কাব্য সাহিত্যের ‘প্রতিবাদী রোমান্টিক কবি’। মাত্র ২১ বছর বয়সে তরুণ রুদ্র লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কালজয়ী কবিতা ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’। তারপর বাকিটা ইতিহাস। বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানের দেয়ালে দেয়ালে এই কবিতার চরণগুলো শোভা পায়। তরুণ বয়সেই তিনি পেয়ে যান প্রতিষ্ঠিত কবির খেতাব। তবে রুদ্র বলেছিলেন, ‘আমি কবি নই- শব্দ শ্রমিক, শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই, ভুল বোধে ভুল চেতনায়, হৃদয়ের কালো বেদনায়’। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ রুদ্র যেমন অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, তেমনিভাবে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সবর। তাই তো তিনি লিখেছিলেন, ‘আফিম তবুও ভাল, ধর্ম সে তো হেমলক বিষ’। রুদ্রর পিতৃ প্রদত্ত নাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ছোটবেলায় এই নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। লেখালেখির জগতে এসে অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে এই নামটি তিনি নিজেই বদলে দেন। নামের আগে যোগ করেন ‘রুদ্র’, ‘মোহাম্মদ’-কে করেন ‘মুহম্মদ’ আর ‘শহীদুল্লাহ’-কে ‘শহিদুল্লাহ’। নিজ প্রদত্ত এই নাম শুধু লেখক হিসেবেই নয়, পরীক্ষার সনদেও তিনি ব্যবহার করেছেন। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর করতে তিনি সমাজতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সারাদেশে চষে বেড়িয়েছেন। মুক্ত মঞ্চে তার সাম্যবাদী ও দ্রোহের কবিতা আবৃত্তি করে তরুণপ্রজন্মের বিবেক বোধ জাগিয়ে দিতেন। আজও তরুণপ্রজন্মের কাছে রুদ্রের সাম্যবাদী ও দ্রোহের কবিতাগুলো সমান আবেদন রাখে। যখন অপশক্তির করাল গ্রাসে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেশার রাজ্যে ডুবেছিল, তখন অপশক্তির বিরুদ্ধে রুদ্র লিখেছিলেন, ‘যে মাঠ থেকে এসেছিল স্বাধীনতার ডাক, সেই মাঠে আজ বসে নেশার হাট’। রুদ্রের প্রেমের কবিতাগুলো তরুণ প্রজন্মের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গতানুগতিক ধারা থেকে ভিন্ন ধাঁচে, ভিন্ন আঙ্গিকে কবির প্রেম-বিরহের কবিতাগুলোর আবেদন ছিল অনন্য। তার প্রেমের কবিতা পড়ে দুই বাংলার হাজার হাজার তরুণী রুদ্রের প্রেমে মজে ছিলেন। আর প্রেম নিবেদনে তরুণদের কাছে রুদ্রের কবিতা থাকত তালিকার শীর্ষে। বিরহী দ্বগ্ধ হৃদয়ের ক্ষত উপশমে রুদ্রের কবিতাই ছিল শেষ আশ্রয়। রুদ্র যেমন খ্যাতিমান কবি ছিলেন, তেমনিভাবে খ্যাতিমান আবৃত্তিকার, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। তিনি প্রায় অর্ধ শতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। কবির কালজয়ী কবিতা, পরবর্তীতে সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা গান ‘আমার ভেতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে’ কবিকে অমরত্ব এনে দেয়। তরুণদের নিয়ে গড়েছিলেন ‘অন্তর বাজাও’ নামে একটি গানের দল। গানের দল নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কবিতা ও গানে তরুণপ্রজন্মের অন্তর আত্মা জাগিয়ে গেছেন। রুদ্র আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তরুণপ্রজন্মের বিপ্লবী চেতনায় আমরা রুদ্রকেই খুঁজে পাই। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক’। এই তরুণ কবি আমাদের বুকের বাম পাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে পরম শ্রদ্ধায় অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন। এই লেখাটি পড়তে পড়তে কেউ হয়তো গেয়ে উঠবে রুদ্রের সেই কালজয়ী গান ‘আমার ভেতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে, আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।’
×