ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেকর্ড গড়া দুর্দান্ত জয় ॥ ওয়েস্ট ইন্ডিজের হার ৭ উইকেটে

প্রকাশিত: ১৩:৫১, ১৮ জুন ২০১৯

রেকর্ড গড়া দুর্দান্ত জয় ॥ ওয়েস্ট ইন্ডিজের হার ৭ উইকেটে

জিএম মোস্তফা॥ বিশ্বমঞ্চে আবারও দুর্দান্ত বাংলাদেশ। টানা দুই হার আর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হওয়ার পর সোমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও দাপট দেখাল মাশরাফি-মর্তুজার দল। টন্টনে দারুণ এক জয় তুলে নিল লাল-সবুজের বাংলাদেশ। টাইগাররা এদিন ৫১ বল হাতে রেখেই ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। প্রথমে ব্যাট করে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেটের বিনিময়ে ৩২১ রান তুলেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে সাকিব-লিটনের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের সৌজন্যে ৩ উইকেট হারিয়ে ৪১.৩ ওভারেই ৩২২ রান তুলে ফেলে মাশরাফি মর্তুজার দল। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ডও গড়ে। এর আগে ২০১৫ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের করা ৩১৮ রান তাড়া করে ৪ উইকেটে ৩২২ রান তুলে জিতেছিল বাংলাদেশ। সেটি ছিল নিউজিল্যান্ডের ছোট্ট মাঠ নেলসনে। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় সেরা রান তাড়া করে জেতারও রেকর্ড গড়ল টাইগাররা। বিশ্বকাপে রান তাড়ার সেরা রেকর্ড আইরিশদের। ২০১১ বিশ্বকাপে ব্যাঙ্গালুরুতে ইংল্যান্ডের করা ৩২৭ রান টপকে গিয়েছিল তারা ৭ উইকেটে ৩২৯ রান করে। চলতি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক রান তাড়া করে জিততে পারেনি আর কোন দলই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই জয়ের ফলে পয়েন্ট টেবিলের পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ৫ ম্যাচ থেকে টাইগারদের সংগ্রহ ৫ পয়েন্ট। তাদের উপরে থাকা চার দল যথাক্রমে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত এবং ইংল্যান্ড। চার ম্যাচ থেকে স্বাগতিকদের সংগ্রহ ৬ পয়েন্ট। নিউজিল্যান্ড আর ভারতের পয়েন্ট সমান ৭। ম্যাচও খেলেছে সমান চারটি করে। শীর্ষে থাকা অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ৫ ম্যাচ থেকে সর্বোচ্চ ৮ পয়েন্ট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ রয়েছে সপ্তম স্থানে। পয়েন্ট মাত্র ৩। টন্টনে ক্যারিবীয়দের ছুড়ে দেয়া ৩২২ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে বেশ ভালই শুরু করে বাংলাদেশ। দলীয় ৫২ রানে প্রথম উইকেটের পতন ঘটে টাইগারদের। আন্দ্রে রাসেলের বলে ক্রিস গেইলের হাতে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরে যান সৌম্য সরকার। সমান দুটি করে চার ও ছক্কার সৌজন্যে ২৯ রান করেন তিনি। সৌম্য আউট হলেও তামিম ইকবাল এগিয়ে যান ঠা-া মাথায় খেলে। কিন্তু ব্যক্তিগত ৪৮ রানে কটরেলের দুর্দান্ত থ্রুতে রান আউটে কাটা পড়েন হার্ড-হিটার এই ওপেনার। তামিম ইকবালের ইনিংসটিতে কোন ছক্কা না থাকলেও চার ছিল ছয়টি। তামিমের পর মুশফিকুর রহিমও হতাশ করেন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। মাত্র ১ রান যোগ করেই ওশান থমাসের বলে শাই হোপের হাতে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান তিনি। বাংলাদেশের সংগ্রহ তখন ৩ উইকেটে ১৩৩ রান। দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে তখন একরাশ হতাশা! শেষ চারে যেতে হলে যে এই ম্যাচের জয়ের বিকল্প নেই। তবে প্রথম সারির তিন ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলেও দলকে টেনে তোলার দায়িত্ব নেন সাকিব আল হাসান। রাসেল-কটরেল-গ্যাব্রিয়েলদের বেদকর পিঠিয়ে বিশ্বমঞ্চে আরও একবার প্রমাণ করেন কেন তিনি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। এই ম্যাচেই তামিম ইকবালের পর ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ৬ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন সাকিব। কাকতালীয়ভাবে তখন উইকেটের আরেক পাশেই ছিলেন তামিম। ওশান থমাসকে থার্ড ম্যানে ঠেলে দিয়ে দুই রান নিয়ে সাকিব পৌঁছেন ছয় হাজারে। ছুটে এসে প্রথমেই অভিনন্দন জানান তামিম। ছয় হাজার রানে যেতে সাকিবের খেলতে হয় ২০২ ম্যাচ। বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আগে বেশিরভাগ সময়ই নামতেন পাঁচ-ছয় নম্বরে। সেসব পজিশনে বড় রান করার সুযোগ ছিল কম। বছরখানেক ধরে নিজেকে তিন নম্বরে উঠিয়ে আনার ফল সাকিব পাচ্ছেন হাতেনাতে। এই পজিশনে এখন পর্যন্ত তার বিস্ময়কর সাফল্য। ইংল্যান্ড ও ওয়েলস বিশ্বকাপের প্রথম তিন ম্যাচে দুই ফিফটি আর এক সেঞ্চুরিতে সাকিব করেন ২৬০ রান। দলের ভীষণ প্রয়োজনে নেমে সোমবারও ঝলক দেখান সাকিব। এদিন খেলেন অপরাজিত ১২৪ রানের নান্দনিক এক ইনিংস। এবারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ১২১ রান করেছিলেন সাকিব। উইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচেই ছাড়িয়ে গেলেন নিজেকে। তবে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ১২৮ রানের ইনিংসটা এখনও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দখলে। এবারের বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও সাকিব। প্রথম দুই ম্যাচে টানা ফিফটির পর টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরির সৌজন্যে এবারের বিশ্বকাপে সাকিবের রানসংখ্যা ৩৮৪। সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় সাকিবের পরে রয়েছেন এ্যারন ফিঞ্চ। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের রান ৩৪৩। তবে সাকিবের চেয়ে এক ম্যাচ বেশি খেলেছেন তিনি। এদিকে ৩ ম্যাচ খেলে ৩১৯ রান নিয়ে এই তালিকার তিনে রয়েছেন ভারতের রোহিত শর্মা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচসেরা সাকিবকে এদিন দারুণভাবে সঙ্গ দেন লিটন কুমার দাস। এবারের আসরে মোহাম্মদ মিঠুনের বদলি হিসেবে মাঠে নেমেই নিজের জাত চেনান এই তরুণ প্রতিভাবান এই ক্রিকেটার। প্রতিপক্ষের বোলারদের দেখে-শুনে খেলে ক্যারিয়ারের তৃতীয় অর্ধশতক তুলে নেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। সেঞ্চুরির কাছাকাছি গিয়েও ৯৪ রানে অপরাজিত থাকতে হয় লিটন দাসকে। কেননা, ততক্ষণেই যে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। তবে চতুর্থ উইকেটে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে রেকর্ড ১৮৯ রানের জুটি গড়েন লিটন। বিশ্বকাপের ইতিহাসেই দ্বিতীয় সেরা। এর আগের রেকর্ডটা ছিল অস্ট্রেলিয়ার মাইকেল ক্লার্ক ও ব্র্যাড হজের। ২০০৭ বিশ্বকাপে হল্যান্ডের বিপক্ষে ২০৪ রানের জুটি গড়েছিলেন ক্লার্ক-ব্র্যাড। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা বোলারের তালিকায় লিখতে হয় আন্দ্রে রাসেলের নাম। ৬ ওভারে ৪২ রানের বিনিময়ে একটি উইকেট পান তিনি। ওশান থমাস সমান ৬ ওভারে ৫২ রান খরচ করে একটি উইকেট দখল করেন। কটরেল-হোল্ডার-গ্যাব্রিয়েলরা তো এদিন চরম হতাশ করেছেন নিজের দেশের সমর্থকদের! কোন উইকেটই লাভ করতে পারেননি এদের কেউ। এর আগে টস জিতে এদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রথমে ব্যাটিংয়ে পাঠান টাইগার অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে ভালই বল করে টাইগাররা। শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেংথে বল করেন মাশরাফি-সাইফউদ্দিনরা। প্রথম ১০ ওভারে বাংলাদেশ মাত্র ১ উইকেট তুলে নিলেও প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা ছিলেন একেবারেই নিষ্প্রভ। এই সময়ে মাত্র ৩২ রান তুলতে সক্ষম হয় জেসন হোল্ডারের দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইল সাজঘরে ফিরে যান শূন্য হাতেই। ১৩ বল খেলেও কোন রান না করে মুশফিকুর রহিমের হাতে কট বিহাইন্ড হয়ে গেইল আউট হন সাইফ উদ্দিনের বলে। পরের ১০ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান বাড়ে। এই সময়ে ৬৫ রান তুলে ক্যারিবীয়রা। এর পেছনে বড় ভূমিকা এভিন লুইস এবং শাই হোপের। তবে নিজের তৃতীয় ওভারে এসে এভিন লুইসকে তুলে নেন সাকিব আল হাসান। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে জোরে মারতে গিয়ে লং অফে ক্যাচ তুলে দেন লুইস। আউট হওয়ার আগে ৬৭ বলে ৭০ রান করেন এই ওপেনার। লুইসের পর নিকোলাস পুরানকেও (২৫) প্যাভিলিয়নের পথ দেখান সাকিব। গেইল-পুরানরা সাজঘরে ফিরে গেলেও একপাশ আগলে রাখেন শাই হোপ। টাইগার বোলারদের দেখে-শুনে ক্যারিবীয় ইনিংসকে দারুণভাবে এগিয়ে নেন তিনি। তবে সাইফ-সাকিবের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ শিবিরে আঘাত হানেন মুস্তাফিজুর রহমান। ৪০তম ওভারের তৃতীয় বলে হেটমায়ারকে ফেরান তিনি তামিম ইকবালের দুর্দান্ত এক ক্যাচে। আউট হওয়ার আগে অবশ্য ২৬ বলে ৫০ রানের ঝড়ো এক ইনিংস খেলে যান তিনি। একই ওভারের ষষ্ঠ বলে আন্দ্রে রাসেলকেও সাজঘরে ফেরত পাঠান কাটার মাস্টার মুস্তাফিজুর রহমান। রাসেলের ক্যাচ তুলে নেন মুশফিকুর রহিম। দলীয় ২৮২ রানে জেসন হোল্ডারকে মাহমুদউল্লাহর হাতে ক্যাচ বানান সাইফ উদ্দিন। তার আগে ক্যারিবীয় অধিনায়কও খেলে যান ১৫ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংস। এরপর শাই হোপের উইকেটটিও দখল করেন মুস্তাফিজ। লিটন দাসের হাতে তালুবন্দী হওয়া হোপ খেলে যান দলীয় সর্বোচ্চ ৯৬ রানের দারুণ এক ধৈর্যশীল ইনিংস। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তিন শ’ ছাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ড্যারেন ব্রাভো। সাইফ উদ্দিনের বলে বোল্ড আউট হওয়ার আগে ১৯ রান করে যান তিনি। তবে ৬ রানে অপরাজিত থাকেন ওসান থমাস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সমান তিনটি করে উইকেট লাভ করেন সাইফ উদ্দিন ও মুস্তাফিজুর রহমান। সেজন্য ১০ ওভারে ৭২ রান খরচ করেন সাইফ উদ্দিন। আর ৯ ওভারে ৫৯ রান দেন মুস্তাফিজ। ৮ ওভার বল করে ৫৪ রানের বিনিময়ে ২ উইকেট লাভ করেন সাকিব আল হাসান। উইকেট না পেলেও ৮ ওভারে মাত্র ৩৭ রান দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন দলনেতা মাশরাফি। উইকেটবিহীন ছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ এবং মোসাদ্দেক সৈকতও।
×