ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরার স্মার্ট পোল্ট্রি ভিলেজ ॥ শতভাগ নারী স্বাবলম্বী

প্রকাশিত: ০৯:১০, ১৯ জুন ২০১৯

সাতক্ষীরার স্মার্ট পোল্ট্রি ভিলেজ ॥ শতভাগ নারী স্বাবলম্বী

মিজানুর রহমান সাতক্ষীরা থেকে ॥ গ্রামের নাম এখন স্মার্ট পোল্ট্রি ভিলেজ। এখানে শতভাগ নারী এখন স্বাবলম্বী স্বামীর উপার্জনের উপর নির্ভর না করে নিজেরাই সংসারের হাল ধরে হয়েছেন উপার্জনক্ষম। লাভের টাকায় সংসার খরচ, সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে তাদেরও স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখাচ্ছেন এসব জয়িতা নারীরা। প্রাণিসম্পদ বিভাগের টেকনিক্যাল সহযোগিতায় বাস্তবায়িত জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের ৫টি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা স্মার্ট পোল্ট্রি ভিলেজ সরকারের একটি রোল মডেল। এখানে প্রতিমাসে সোয়া লাখ কেজি সোনালি মুরগির মাংস উৎপন্ন হয়। যার বাজারমূল্য প্রায় ২৬ লাখ টাকা। আর এই উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত এলাকার চার শ’ দুই উদ্যোক্তা খামারি। এদের মধ্যে ৮০ ভাগ নারী। এদের উপর নির্ভরশীল জনসংখ্যা প্রায় ২ হাজার ২৫ জন। সোনালি মুরগিতে সোনার দেশ, জাতির পিতার বাংলাদেশ এই স্লোগানে নিবেদিত টোনা, গোবিন্দকাটি, বাঁশদহা, ঘোজা ও বেড়াখালি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠা এই স্মার্ট পোল্ট্রি ভিলেজ এ পরিবেশবান্ধব ডিপলিটার পদ্ধতিতে এখন প্রায় প্রতিটি ঘরেই চলে সোনালি মুরগি চাষ। কালীগঞ্জ উপজেলার এই ৫টি গ্রামের প্রতিটি ঘরেই মাংস উৎপাদনে পোলট্রি মুরগি চাষ হয় প্রায় ১২ থেকে ১৮ বছর ধরে। এখানে নতুন, পুরনো খামারির সংখ্যা ৪ শতাধিক। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সরাসরি জড়িত পরিবারের নারী সদস্যরা যেন এক একজন একটি মডেল। একদিনের বাচ্চা নিয়ে নিবিড় পরিচর্যায় খাওয়ার উপযোগী করে তুলতে সময় লাগে প্রায় ২ মাস। আর এই দুই মাস পরেই বিক্রি হয়ে যায় খাওয়া উপযোগী হয়ে ওঠা সোনালি মুরগির প্রথম চালান। আবার তারা নতুন করে বাচ্চা এনে পুনরায় শুরু করেন দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থসহ বছরে ৬টি চালান। কমবেশি লাভ লোকসান মিলিয়ে এক একজন খামারির লাভের অর্থ দিয়ে চলে সংসারের বাড়তি খরচ, সন্তানদের লেখাপড়াসহ অন্যান্য কাজ। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় চলতি বছর যোগ হয়েছে উপজেলা প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের সহযোগিতা। নতুন করে নামকরণ হয়েছে এই পাঁচটি গ্রামের স্মার্ট পোল্ট্রি ভিলেজ। কালীগঞ্জ গোবিন্দকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে টানানো হয়েছে সাইনবোর্ড। উপজেলা পরিষদের অর্থ সহযোগিতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ। স্মার্ট পোল্ট্রি ভিলেজের আওতাভুক্ত বাঁশদহা গ্রামের প্রেমদাস সরকারের স্ত্রী সফল খামারি মালতী রানী সরকার (৪৭) জানান, তার দেড় যুগের পোল্ট্রি চাষের অভিজ্ঞতা। তিনি প্রতি ২ মাস অন্তর ৫শ’ করে বাচ্চা তোলেন খামারে। প্রতি চালান বিক্রি হয় ৫০ হাজার টাকা থেকে ৫৫ হাজার টাকা। স্বামী জজ কোর্টের মুহুরির কাজ করেন। উপার্জিত টাকা দিয়ে তিনি মেয়ে প্রিয়াঙ্কা সরকারকে এমএম পাস করিয়েছেন। মেয়ে এখন বাড়িতে মাকে সহযোগিতা করেন। একমাত্র ছেলে ঢাকায় এমএ পড়ছে। গোবিন্দকাটি গ্রামের সুভেন্দু সরকারের স্ত্রী চন্দনা সরকার (৩৫)। তিনি চাষ করেন ২ বছর। তিনিও এই চাষে সফল। গোবিন্দকাটি গ্রামের সুইটি সরকার (২০) এর মা স্মৃতি রানী সরকার (৫০) ৫ বছর ধরে এই সোনালি মুরগি চাষ করেন। প্রতি ২ মাসে তিনি ২শ’ থেকে ৩শ’ বাচ্চা তোলেন খামারে। মেয়ে সুইটি সাতক্ষীরা পলিটেকনিট কলেজে লেখাপড়া করেন। সময় পেলে মাকে তিনি এই কাজে সহযোগিতা করেন। বাঁশদহা গ্রামের খামারি শওকাত কারিগর ৪ বছর ধরে এই মুরগি চাষ করছেন। তবে সব খামারিই জানান তাদের প্রধান সমস্যা মিষ্টি পানির অভাবের কথা। এই অঞ্চলে মিষ্টি পানি নেই। লোনা পানির কারণে অনেক বাচ্চা মারা যায় বলে খামারিরা জানান। দেশের মডেল প্রোগ্রাম হিসেবে স্মার্ট পোল্ট্রি ভিলেজ সম্প্রসারণ কার্যক্রমের উদ্বোধন উপলক্ষে রবিবার আয়োজন করা হয় একটি ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্ঠান। খামারিদের আরও উৎসাহ দিতে আয়োজন করা হয় গোবিন্দকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে সমাবেশ। চালু করা হয় স্মার্ট পোল্ট্রি ভিলেজ সম্প্রসারণ ও স্কুল এগ ফিডিং কার্যক্রম। কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদীর সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক মাসুদ আহম্মদ খান। বিশেষ অতিথি যশোর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ভবতোষ কান্তি সরকার, খুলনা জেলা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক সুশান্ত কুমার সরকার, সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম, সিনিয়র সাংবাদিক সুভাষ চৌধুরী, কালীগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মনোজিৎ কুমার ম-ল, দক্ষিণ শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান প্রশান্ত কুমার সরকার প্রমুখ।
×