ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদনশীল খাতে রেমিটেন্স বিনিয়োগে মাস্টারপ্ল্যান

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১৯ জুন ২০১৯

উৎপাদনশীল খাতে রেমিটেন্স বিনিয়োগে মাস্টারপ্ল্যান

এম শাহজাহান ॥ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের জন্য একটি ‘মাস্টারপ্ল্যান’ তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে রেমিটেন্স আহরণ বাড়াতে প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রিজার্ভের টাকায় সভরেন বন্ড ইস্যু করার পরিকল্পনা করছে অর্থমন্ত্রণালয়। এছাড়া সব ধরনের হয়রানিমুক্ত থেকে দ্রুত দেশে রেমিটেন্স নিয়ে আসতে ব্যাংকিং খাতে বেশকিছু কর্মসূচী নিয়ে আসা হচ্ছে। রেমিটেন্স বিনিয়োগে কর অবকাশ সুবিধা, ওয়ানস্টপ সার্ভিস নিশ্চিত এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেয়া হবে। সূত্রমতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটি প্রবাসী বাঙালী বসবাস করছেন। বছরে প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিটেন্স আসছে প্রায় ১৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার। গত কয়েক বছর ধরে সরকারের নানামুখী উদ্যোগে রেমিটেন্স আহরণের পরিমাণ ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণাটি প্রবাসীরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। ইতোমধ্যে সরকারের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন প্রবাসী ভাই-বোনেরা। বেশি পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠানোর পাশাপাশি কষ্টার্জিত অর্থ তারা এখন বিনিয়োগ করে লাভবান হতে চান। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় এতদিন রেমিটেন্সের টাকা ভোগবিলাস এবং অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা হয়েছে। এখন রেমিটেন্সের ব্যাপারে সরকারী উদ্যোগ থাকায় উৎসাহী হচ্ছেন প্রবাসীরা। এ কারণে আশা করা হচ্ছে, নতুন অর্থবছরে রেমিটেন্স আহরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। রেমিটেন্স প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় বলেন, রেমিটেন্স প্রেরণে বর্ধিত ব্যয় লাঘব করা এবং বৈধপথে অর্থ প্রেরণ উৎসাহিত করার জন্য প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থের ওপর আগামী অর্থবছর হতে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা প্রদান করা হবে। এ বাবদ নতুন অর্থবছরের বাজেটে ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে বৈধ চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে এবং হুন্ডি ব্যবসা নিরুৎসাহিত হবে। তিনি বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য বীমা সুবিধা না থাকায় দুর্ঘটনা ও নানাবিধ কারণে তারা ও তাদের পরিবার প্রায়শই আর্থিক ক্ষতি ও ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। এ কারণে প্রবাসী কর্মীদের বীমা সুবিধার আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন এবং রূপকল্প-২১ সামনে রেখে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। নতুন বাজেট এ বিষয়ে বেশকিছু পরিকল্পনা ও নীতিগত সহায়তার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও রেমিটেন্স বাড়ানোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত পণ্য ও সেবা রফতানি। এরপরই রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে বছরে আয় হচ্ছে সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে রেমিটেন্সের পরিমাণ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ বছর প্রণোদনা থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার আয় আরও বাড়ানো সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে প্রবাসীরা রেমিটেন্স বিনিয়োগ করার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠছেন। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক জ্যামাইকার বাসিন্দা প্রবাসী বাঙালী বাবুল মোহাম্মদ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এতে করে দেশে রেমিটেন্সের প্রবাহ কয়েকগুণ বাড়বে। তিনি বলেন, প্রবাসী ভাইদের কষ্টার্জিত টাকা পাঠাতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। এখন ব্যাংক যদি এ ব্যাপারটিতে হয়রানিমুক্তভাবে সেবা নিশ্চিত করতে পারে তাহলে সবাই বৈধভাবে টাকা পাঠাবেন। শুধু তাই নয়, রেমিটেন্সের শেষ সম্বলটুকুও দেশে নিতে কোন আপত্তি নেই যদি বিনিয়োগ সুরক্ষা দেয়া হয়। আমেরিকায় বহু বাঙালী আছেন, দেশে টাকা বিনিয়োগ করতে চান। কিন্তু নানাবিধ সমস্যার মুখে পড়ে তারা আর দেশে যেতে উৎসাহিত হন না। এদিকে, রেমিটেন্সের অর্থ যাতে অর্থনীতির মূল ধারায় বিনিয়োগ হয় সে বিষয়ে ও আন্তরিক আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। বর্তমানে বিশ্বের ১৬৫টি দেশে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছেন। বিদেশে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হচ্ছে, বৈধ রেমিটেন্স প্রবাহে তা পুরোপুরি প্রতিফলিত হচ্ছে না। ব্যাংকের চেয়ে অবৈধ চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কিছুটা বেশি থাকায় সামান্য লাভের আশায় অনেকে সেদিকে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে রফতানির মতো করে রেমিটেন্সে নগদ প্রণোদনা দেয়া হবে। রেমিটেন্সের ওপর প্রতিষ্ঠানগুলো ৩ থেকে ৪ শতাংশ হারে চার্জ নিচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন প্রণোদনা দেয়ার ফলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসবে দেশে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স আসছে। চার্জ বেশি হওয়ার কারণে অনেক প্রবাসী এখন দেশে টাকা পাঠাতে ভরসা পাচ্ছে না। জানা গেছে, প্রবাসী আয়ের ব্যবহার খুঁজে বের করতে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। প্রবাস আয়ের প্রবাহ বা এর ব্যবহারের ওপর এ যাবত কোন উল্লেখযোগ্য নীতিনির্ধারণী কাঠামো প্রণীত হয়নি। যদিও বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবাস আয় দেশের অর্থনীতিতে নানাভাবে অবদান রাখছে। সংস্থাটি এর আগে প্রবাস আয়কে বাংলাদেশের উন্নয়নের অন্যতম দুটো চালিকাশক্তির মধ্যে একটি হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, প্রবাস আয় ভবিষ্যতেও অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এদিকে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রবাসী আয়ের অধিকাংশই বিনিয়োগ হচ্ছে জমি ক্রয়ে। এ ছাড়া খাদ্যদ্রব্য ও খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্য সামগ্রীতে প্রায় সমান হারে প্রবাস আয় ব্যবহার হচ্ছে। পরিবারগুলো গত এক বছরে ব্যয় করেছে মোট প্রবাসী আয়ের ৩৯ শতাংশ। এদিকে, দেশের বড় বড় প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা সভরেন বন্ড ছাড়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সরকারের নেয়া এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। তবে নতুন অর্থবছরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে এই বন্ড ছাড়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে প্রায় ৩৯ বিলিয়ন ডালারের রিজার্ভ রয়েছে। সেখান থেকে এ বন্ড ছাড়া হবে। পদ্মা সেতুসহ অন্যান্য বড় বড় প্রকল্পে এ বন্ড থেকে অর্থের জোগান দেয়া হবে।
×