ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফেঁসেই যাচ্ছেন ডিআইজি মিজান

প্রকাশিত: ১১:২২, ১৯ জুন ২০১৯

ফেঁসেই যাচ্ছেন ডিআইজি মিজান

শংকর কুমার দে ॥ ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় কোনভাবেই পার পাচ্ছেন না, ফেঁসেই যাচ্ছেন ডিআইজি মিজান। তার ঘুষ কেলেঙ্কারির তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দফতর। তিনি কীভাবে ঘুষ দিয়েছেন, ঘুষের টাকা কোথায় পেয়েছেন বা উৎস কি তার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ সদর দফতরের গঠিত তদন্ত কমিটি। যেহেতু ডিআইজি মিজান নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। ঘুষ লেনদেন ফৌজদারি অপরাধ। ডিআইজি মিজানের ব্যক্তিগত দায়ভার প্রতিষ্ঠান নেবে না- এ কারণেই তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। জানা গেছে, ঘুষ লেনদেন ছাড়াও ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়। দ্বিতীয় বিয়ে গোপন করতে নিজের ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় স্ত্রী মরিয়ম আক্তারকে প্রভাব খাটিয়ে গ্রেফতার করিয়েছেন তিনি। এক সংবাদ পাঠিকা ও এক নারী রিপোর্টারকে যৌন হয়রানির অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। পুলিশের নিয়োগ-বদলিতেও এক সময় ভূমিকা রাখতেন তিনি। গ্রেফতার ও মামলা দিয়ে হয়রানি করে টাকা আদায়ের অভিযোগও আছে এই প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন দুদক কর্মকর্তা বাছির। এর সপক্ষে তাদের কথোপকথনের কয়েকটি অডিও ক্লিপ একটি বেসরকারী টেলিভিশনকে দেন তিনি। ওই অডিও প্রচার হওয়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মইনুর রহমান চৌধুরীর (এ্যাডমিন এ্যান্ড অপারেশন) নেতৃত্বে পুলিশের এ তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (ফিন্যান্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) শাহাবুদ্দীন কোরেশী ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার মিয়া মাসুদ হোসেন। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার ক্ষেত্রে কমিটিকে কোন সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়নি। তবে দ্রুত তাদের কার্যক্রম শেষ করতে বলা হয়েছে। এর আগে ডিআইজি মিজানের নারী কেলেঙ্কারি তদন্তে গঠিত তিন সদস্যের কমিটিতেও নেতৃত্ব দেন মইনুর রহমান চৌধুরী। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিআইজি মিজানের ঘটনায় পুলিশের নীতিনির্ধারণী মহল বিব্রত। পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তার এমন ভূমিকা ও আচরণ তাদের কাম্য নয়। এতে পুলিশ বাহিনীর কনিষ্ঠ সদস্যদের মধ্যেও নৈতিক অবক্ষয়ের আশঙ্কা দেখা দেয়। তাদের মনোবলও ভেঙ্গে পড়ে। তাই ভবিষ্যতে যাতে পুলিশ বাহিনীর কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না দেখান, সে জন্য বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখবে পুলিশ। ডিআইজি মিজানের ব্যক্তিগত কোন কাজের দায় পুলিশ বাহিনী বা প্রতিষ্ঠান নেবে না। পুলিশ হিসেবে বাড়তি কোন সুযোগও তিনি পাবেন না। দোষী প্রমাণিত হলে সরকারী চাকরি বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তদন্তে দোষী প্রমাণ হলে তাকে শাস্তির মুখোমুখিও হতে হবে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগ মন্তব্য করে, ডিআইজি মিজান কি দুদকের চেয়েও বড়? দুদক কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করার পরও ডিআইজিকে গ্রেফতার না করায় উষ্মা প্রকাশ করে আপীল বিভাগ। এর আগে এক বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানায়, ঘুষ লেনদেনে জড়িত দুই পক্ষই সমভাবে দায়ী। ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়ের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানায় সংস্থাটি। এত সব ঘটনার নায়ক প্রভাবশালী ডিআইজি মিজানুর রহমান এখনও বহাল রয়েছেন স্বপদে। এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার মধ্যে রয়েছ ওএসডি, সাসপেন্ড। দ্বিতীয় বিয়ে লুকাতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে গত বছর ডিআইজি মিজানকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে প্রত্যাহারের পর পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্ত করা হয়। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, এক নারীকে জোর করে বিয়ের পর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ ওঠায় গত বছরের জানুয়ারিতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় মিজানকে। এরই মধ্যে দুদকের অভিযোগ থেকে বাঁচতে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন ডিআইজি মিজান। এর চার মাস পর তার সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক; এক হাত ঘুরে সেই অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান কমিশনের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। সেই অনুসন্ধান চলার মধ্যেই ডিআইজি মিজান গত ৮ জুন দাবি করেন, তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন দুদক কর্মকর্তা বাছির। এর সপক্ষে তাদের কথোপকথনের কয়েকটি অডিও ক্লিপ একটি টেলিভিশনকে দেন তিনি। ওই অডিও প্রচার হওয়ার পাশাপাশি তার সাক্ষাতকারও প্রচার করা হয়। এরপর ডিআইজি মিজানের বিষয়টি আলোচনায় আসে। ডিআইজি মিজান গত ১০ জুন সব জেনেশুনেই কাজটি করেছেন বাধ্য হয়ে। ডিআইজি মিজান বলেছেন, ‘তিনি (বাছির) যে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত, তা প্রমাণ করতে, তাকে ফাঁসানোর জন্য করেছি এবং নিজের বাঁচার জন্য করেছি’। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডিআইজি মিজান ঘুষ লেনদেন করায় তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ সদর দফতর। শাস্তির আওতায় আনা হবে পুলিশের ডিআইজি মিজানকে। ডিআইজি মিজান নিজেই বলেছেন তিনি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন। এটা ফৌজদারি অপরাধ। ফৌজদারি অপরাধের কারণে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোনভাবেই পার পাবেন না, শাস্তি তাকে পেতেই হবে।
×