ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্রিকেট জাগিয়েছে দেশবোধ

বিশ্ব আসরে লাল সবুজের ঢেউ, নতুন দোলা

প্রকাশিত: ১১:২৮, ১৯ জুন ২০১৯

বিশ্ব আসরে লাল সবুজের ঢেউ, নতুন দোলা

মোরসালিন মিজান ॥ সেই মনোবেদনার কথাটিই আগে বলতে হয়। নানা মত পথে বিভক্ত এই দেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বিস্ময়কর ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সেটিও ভেস্তে গেছে। চাওয়া-পাওয়াগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু কী আশ্চর্য, গল্পটা আমূল বদলে দিল ক্রিকেট! ২২ গজের এই খেলা কিছুকাল আগেও অন্যের ছিল। মাঠে ছিল না বাঙালী। গ্যালারিতে বসে শুধু দেখেছে। আর এখন বদলে যাওয়া বাংলাদেশ। ক্রিকেটে একের পর এক অর্জন। এর বা ওর নয়। দেশের প্রতিটি মানুষ টাইগারদের সাফল্যে গর্ববোধ করেন। ছেলে বুড়ো নারী-পুরুষ প্রত্যেকেই এক চাওয়া নিয়ে তাকিয়ে থাকেন টেলিভিশনের পর্দায়। বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার পর উন্মাদনা আরও বেড়েছে। সারাদেশের প্রতি প্রান্তে একটিই আলোচনাÑক্রিকেট। তবে গত সোমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যে জয়, তার কোন যেন তুলনা হয় না। শক্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড গড়েছে শাকিব লিটনরা। এরপর থেকে গোটা দেশজুড়ে আনন্দ। উৎসব। সব অনৈক্য হয়তো দূর হয়ে যায়নি, তবে দেশবোধটাকে নতুন করে জাগিয়েছে ক্রিকেট। বিশ্ব আসরে লাল-সবুজের ঢেউ। সেই ঢেউ এসে আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। এবারের বিশ্বকাপে, হ্যাঁ, অনেক বেশি পরিণত বাংলাদেশ। প্রাথমিক টার্গেট-ই সেমি ফাইনাল। সে অনুযায়ী শুরুটাও ছিল দুর্দান্ত। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিরুদ্ধে ৩৩০ রানের পাহাড় গড়েছিলেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানরা। হেসে খেলে জিতেছিল ম্যাচ। সঙ্গত কারণেই প্রত্যাশা বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যায়। চায়ের দোকানে গল্প আড্ডায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন নতুন আশাবাদের কথা ব্যক্ত হতে শুরু করে। কিন্তু এরই মাঝে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে জিততে জিততে হার। ইংল্যান্ডের সঙ্গে হারটা ছিল আরও বড় ব্যবধানের। তদুপরি শ্রীলঙ্কা বদের মধ্য দিয়ে জয়ের ধারায় ফেরার জোরালো আশা ছিল। ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যায়। এ অবস্থায় হতাশার সুর বাজতে থাকে সমর্থকদের মধ্যে। তবে কি থমকে যাবে সেমির স্বপ্ন? অনেকে ভুলগুলো শুধরে কামব্যাক করার পরামর্শ দেন। কারও কারও আবেগ বেশি। সমালোচনায় মুখর হন। তবে নতুন ম্যাচ শুরু হতেই সব ভুলে মাশরাফিদের পাশে ঠিক দাঁড়িয়ে যান সমর্থকরা। উন্ডিজের সঙ্গে লড়াই দেখতে আগেভাগে কাজ সেরে টেলিভিশনের সামনে বসে পড়তে দেখা যায় তাদের। ঢাকার অলিতে গলিতে বড় পর্দা। খোলা জায়গায় হাজার হাজার মানুষ খেলা দেখেন। গর্বের সঙ্গে লাল-সবুজের পতাকা ওড়ান। উৎসাহ যোগান ক্রিকেটারদের। হ্যাঁ, বহু দূর থেকে উৎসাহ যোগানোর আপ্রাণ চেষ্টা। ক্রমে যখন জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল টাইগাররা তখন উত্তেজনায় কাঁপছিল দেশ। শাকিব সজোরে ব্যাট চালাতেই ১৬ কোটি মানুষ একসঙ্গে জয়ধ্বনি করছিল। একইভাবে তামিমের দুর্ভাগ্যজনক রান আউটে বিষণœ বদন। সবার। একসঙ্গে। প্রায় একই ছবি গ্যালারিতে। টন্টনে সমর্থকদের যে আবেগ উচ্ছ্বাস দেখা গেছে সেটি ঢাকার চেয়ে কিছু কম নয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বেশি বলে মনে হয়েছে। প্রবাস জীবনে অন্যের আচারে অভ্যস্ত হতে হয়। কিন্তু ক্রিকেট তাদের আত্মপরিচয় নিয়ে সামনে আসার সুযোগ করে দিয়েছে। গ্যালারিটিকে মনে হয়েছে একখ- বাংলাদেশ। জাতীয় পতাকা এবং লোক ঐতিহ্যকে উর্ধে তুলে ধরার চেষ্টা দেখে ক্রিকেটাররাও নিশ্চয়ই বুকে বাড়তি বল পেয়েছেন। এবং অতঃপর বিপুল ব্যবধানে জয়। সর্বোচ্চ ৩২১ রান তাড়া করে মাত্র তিন উইকেট খরচায় জয় নিজেদের করেছে বাংলাদেশ। এই কামব্যাকের পর আবারও স্বপ্ন বুনছে বাঙালী। টিএসসি এলাকায় বড় পর্দায় বাংলাদেশের ম্যাচ দেখছিলেন পুরান ঢাকার ক্রিকেটপ্রেমী সাজ্জাদ। লাল-সবুজের জার্সি গায়ে গোটা এলাকা মাতিয়ের রাখা তরুণ বলেন, আমাদের কাছে ক্রিকেটটা এখন বাংলাদেশ। একসময় অন্য দেশের খেলা নিয়ে মেতে থাকতে হতো। এখন আমাদের খেলা। আমরা আমাদের নিয়ে মেতে থাকতে পারছি। প্রতিটি ম্যাচের জন্য কিভাবে অপেক্ষা করে থাকি, বলে বোঝাতে পারবো না। উন্ডিজের সঙ্গে জয়ের পর প্রত্যাশা আরও বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি। মগবাজারে বড় পর্দায় খেলা দেখার পর বিজয়োল্লাসে মেতেছিলেন স্থানীয় প্রবীণ সফিকুর রহমান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এই একটি খেলা গোটা জাতিকে উদ্বেলিত করে। ঐক্যবদ্ধ করে। আমার বাসায় খেলা দেখার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সবার সঙ্গে দেখার জন্য এখানে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে আছি। সবার সঙ্গে দেখলে আবেগটা আরও ভালভাবে শেয়ার করা যায় বলে মত তার। এদিকে, ক্রিকেটারাও সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এক সাক্ষাতকারে ম্যাচ সেরা শাকিব আল হাসান বলেছেন, আমরা আমাদের বেস্টটা দেয়ার চেষ্টা করছি। সেইসঙ্গে দেশবাসীর সমর্থন আমাদের উজ্জীবিত করেছে। সামনের দিনগুলোতে এই সমর্থন অব্যাহত থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। ক্রিকেটে অগ্রগতি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে লড়াই এত উপভোগ্য হয়েছিল যে, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ক্রিকেটাররা, সাবেক গ্রেটরা শাকিব তামিমদের ভূঁয়সী প্রশংসা করেছেন। টুইটের পর টুইট। নামকরা স্পোর্টস চ্যানেলে, পত্রিকায় লেজেন্ডরা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নাম ধরে স্তুতি করেছেন। বাংলাদেশ শুধু জয়ী হচ্ছে না, ম্যাচগুলোকে উপভোগ্য করে তুলছে বলে মত তাদের। প্রশংসা করার পাশাপাশি বাংলাদেশের কাছ থেকে শেখার আছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে। টাইগাররা বিশ্বকাপে অনেক দূর যাবে বলেও আশা করছেন বিশ্লেষকরা। সব দেখে বলাই যায়, বিশ্ব আসরে লাল-সবুজের ঢেউ। নতুন দোলা। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ। ক্রিকেটের হাত ধরে জাতীয় সব ইস্যুতে এমন ঐক্য গড়ে উঠুকÑ সকলের তা-ই প্রত্যাশা।
×