ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাবা॥ এক নির্ভরতার নাম

প্রকাশিত: ১১:৫২, ১৯ জুন ২০১৯

বাবা॥ এক নির্ভরতার নাম

স্নেহের, শাসনের অনাবিল প্রশ্রয়ের নাম বাবা। একটি সন্তান জন্মানোর সঙ্গে জন্ম হয় একজন বাবারও। এতদিন যিনি ছিলেন একজন বাবার সন্তান, নিজের সন্তান জন্মের পর তিনি নামেন বাবার ভূমিকায়। এই পরিবর্তন বদলে দেয় অনেক কিছু। তবে বাবা-সন্তানের সম্পর্কের মানদ- নির্ভর করে বিত্তের ওপর। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এ তিন স্তরের বাবা-সন্তানের সম্পর্ক অভিন্ন নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন বলেন, ‘বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন, দেখিস, একদিন আমরাও.../বাবা এখন অন্ধ, আমাদের দেখা হয়নি কিছুই/ সেই রয়্যালগুলি, সেই লঠি-লজেন্স, সেই রাস-উৎসব/আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবে না! ... কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখে না।’ বুঝতে বাকি থাকে না, এ এক স্বল্পবিত্ত বাবার বঞ্চিত সন্তানের কান্না। সন্তানকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষায় এ বাবারা শ্রমের শেষ বিন্দু দিয়েও দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে নিজের অক্ষমতা লুকান। নিজের স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম ভুলে গিয়ে শুধু সন্তানের ‘ভবিষ্যত’ গড়তে কায়ক্লেশে কাটিয়ে দেন সব কর্মক্ষমতা। যেন সন্তান লালন করাই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, ধর্ম-কর্ম সব। সন্তানের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতেই তিনি পৃথিবীতে এসেছেন। একটাই আশা তারÑ সন্তান বড় হয়ে বাবাকে বুঝবে। বাবার কাঁধে হাত রেখে বলবে, অনেকটা পথ তো হাঁটলে এবার জিরোও। তোমার বোঝাখানি এখন আমায় বইতে দাও। চিত্রটা এমন হলেই মানবিক সম্পর্কের পক্ষে যায়। যদি উল্টোটা হয়? বাবার শ্রম-ঘামে, স্নেহ-আদরে সিক্ত হয়ে বাবাকেই যদি ভুলে যায়? কিছুই বলেন না বাবা। দীর্ঘশ্বাসের আড়ালে আরও একবার কান্না চাপেন। সিনেমা নাটকে শুধু নয়, বাস্তবে আছে এমন বহু ঘটনা। যেখানে প্রচুর বিত্ত, বাবা-সন্তানের সম্পর্কের সমীকরণ সেখানে প্রায়শ অন্যরকম। অনেক বিত্তবান বাবা ভাবেন সন্তানকে অর্থের প্রাচুর্যে রাখাই তার একমাত্র দায়িত্ব। তা পালন করে তারা বেশ দায়মুক্ত ভাবেন নিজেদের। আর সন্তানরা বড় হয় একরকম বাবাহীন হয়ে। বাবার সান্নিধ্য, তার সঙ্গে আবেগ লেনদেনের অভিজ্ঞতার স্বাদ থেকে তারা বঞ্চিত। সহজেই এরা ছেড়ে যেতে পারে বাবাকে। অনায়াসে পাঠাতে পারে বৃদ্ধাশ্রমে। যেখানে আত্মিক সম্পর্ক নেই বৃদ্ধ বয়সে বাবা সেখানে সন্তানের কাছে বিরক্তিকর ‘বস্তু’তে পরিণত হন। বিত্তবান-বিত্তহীন যাই হোক কঠোর শৃঙ্খলার একটি হাত সন্তানের বেড়ে ওঠার জন্য খুব জরুরী। শাসন এবং আদরের সমন্বয় যত সুন্দরভাবে করা যাবেÑ সন্তান ততই সুষ্ঠুভাবে বড় হবে। বাবা সম্পর্কে ‘জীবন স্মৃতিতে’ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার জন্মের কয়েক বছর পূর্ব হতেই আমার পিতা প্রায় দেশ ভ্রমেণই নিযুক্ত ছিলেন। বাল্যকালে তিনি আমার কাছে অপরিচিত ছিলেন বলিলেই হয়। ... একদিন তেতলার ঘরে ডাক পড়িল। পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি তাঁহার সঙ্গে হিমালয়ে যাইতে চাই কিনা। ‘চাই’ এই কথাটা যদি চিৎকার করিয়া আকাশ ফাটাইয়া বলিতে পারিতাম, তবে মনের ভাবের উপযুক্ত উত্তর হইত। কোথায় বেঙ্গল একাডেমি আর কোথায় হিমালয়। গুরুজনদিগকে প্রণাম করিয়া পিতার সঙ্গে গাড়িতে চড়িলাম। আমার বয়সে এই প্রথম আমার জন্য পোশাক তৈরি হইয়াছে। কী রঙের কী রূপ কাপড় হইবে তাহা পিতা স্বয়ং আদেশ করিয়া দিয়াছিলেন। মাথার জন্য একটা জরির কাজ করা গোল মখমলের টুপি হইয়াছিল। সেটা আমার হাতে ছিল, কারণ নেড়ামাথার ওপর টুপি পরিতে আমার মনে মনে আপত্তি ছিল। গাড়িতে উঠিয়াই পিতা বলিলেন, ‘মাথায় পরো।’ পিতার কাছে যথারীতি পরিচ্ছন্নতার ত্রুটি হইবার জো নেই। লজ্জিত মস্তকের ওপর টুপিটা পরিতে হইল। রেলগাড়িতে একটু সুযোগ বুঝিলেই টুপিটা খুলিয়া রাখিতাম। কিন্তু পিতার দৃষ্টি একবারও এড়াইত না। তখনই সেটাকে স্বস্থানে তুলিতে হইত।’ পিতার শাসন এমনই রবীন্দ্রনাথের জীবনে। শুধু রবীন্দ্রনাথের বাবা নন। সে আমলে বনেদি পরিবারে পিতার শাসন কম বেশি এমনই ছিল। বাবা ছিলেন স¤্রাট, সংসার সা¤্রাজ্যে পুত্র-কন্যারা ছিল তার অধীনস্থ প্রজা। বাবা নন পিতা। পিতার আদেশ সন্তানের শিরোধার্য। একটা বয়সের আগে পর্যন্ত সন্তানের স্বতন্ত্র জীবন ছিল না। নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা ভাল লাগা সব নিয়ন্ত্রণ করতেন পিতা। অধীনস্থ প্রজা সন্তানরাও বিদ্রোহ করার ধৃষ্টতা দেখাতেন না। আজকের দিনের বাবারা সন্তানের অনেক কাছে নেমে এসেছেন। আলোকিত পরিবারের বাবা-সন্তানের সম্পর্ক বন্ধুত্বের কাছাকাছি। শিশু লালন পালনের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি, শিশু মনস্তত্ত্ব ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক এখন অনেক সহজ। যাবতীয় নেতিবাচকতার পরও সমাজ সামনে এগোচ্ছে। জীবনযাপনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসছে। পরিবারে সন্তান সংখ্যা এখন সাধারণত সর্বোচ্চ দুই। বাবা বাইরে কাজ করেন, মাও। পারিবারিক অর্থনীতিতে দু’জনার সমান অংশীদারিত্ব। এর সংস্কৃতিগত বহির্প্রকাশ আলাদা হবে তাই স্বাভাবিক। আগে সন্তান সংখ্যা আট থেকে দশ, কখনও এর থেকেও বেশি হতো। সব সন্তান বাবার সমান সান্নিধ্য পেত না। বাবা ছিলেন দূর আকাশের তারার মতো। তবে বাবা-সন্তানের সম্পর্ক অনেক নিবিড় হলেও তা কেবল শহুরে সচ্ছল, আলোকপ্রাপ্ত (ঊহষরমযঃবহবফ) পরিবারের মধ্যেই সীমিত। এই সৌভাগ্যবান পরিবারের সন্তানেরা পরিবারের সুশিক্ষা পেয়ে বড় হচ্ছে। পরিবারের শিক্ষা যেখানে খ-িত, ভুল বা অসম্পূর্ণ সেখানেই সন্তান নিয়ে অশান্তি। সবচেয়ে বড় ভুল, সন্তানকে শুধুই শাসনে রাখা। অনেক বাবা সন্তানের সঙ্গে স্বৈরাচারী আচরণ করেন। এই সন্তানেরাই বিপথে যায় সবচেয়ে বেশি। আবার শুধুই স্বাধীনতা পাওয়া সন্তানরাও একরোখা, বদমেজাজি, স্বার্থপর হয়ে ওঠে। শাসন ও স্বাধীনতার পরিমিতি বোধ বাবা-মার মধ্যেই থাকতে হয়। কারণ যে অঙ্কুরটি তারা রোপণ করলেন তা পরিচর্যার শতভাগ দায় তাদেরই। পরিচর্যায় ত্রুটি হলে তার ফল ভুগতেই হবে। তা শুধু বাবা বা মাকে নয়, পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রকেও। বাবার শিক্ষায় পরিণত মন নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বেড়ে উঠেছিলেন ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। হতে পেরেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস। কবে থেকে শুরু হয়েছে বাবা দিবস? কেউ বলেন, চার হাজার বছর আগে থেকে। ব্যাবিলনের এক কিশোর এলমেসো তার বাবার দীর্ঘায়ু কামনা করে ধূসর কার্ডে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিল। শুভেচ্ছা জানানোর এ পদ্ধতি এর আগে দেখা যায়নি বলে একেই বাবা দিবসের সূচনা বলে মনে করেন অনেকে। এখন যেভাবে এ দিবস উদযাপন হয়, তার শুরু ১৯১০ সালে। সোনোরা লুইস স্মার্ট ডোড নামে এক তরুণীর নাম জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। ১৬ বছর বয়সে দুই ভাইবোনসহ মাতৃহীন হন তিনি। তাদের বাবা উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট মাতৃহীন সন্তানদের মাতৃস্নেহে বড় করে তোলেন। বাবার মাঝে সন্তানরা খুঁজে পায় বাবা ও মাকে। স্নেহপ্রবণ বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিয়ে বড় হতে হতে সোনোরা এক সময় জানতে পারেন মা দিবসের কথা। সেটা ১৯০৯ সাল। তখন তার বয়স ২৭। মা দিবস উদযাপনের বিষয়টি সোনোরার মনে দাগ কাটে। মায়ের জন্য দিবস থাকলে যে বাবা মাতৃস্নেহ দিয়ে সন্তানদের আগলে রাখেন তাদের জন্যও একটি দিবস থাকতে পারে। এ রকম একটি দিবস উদযাপনের জন্য উদ্যোগ নেন তিনি। এর আগে থেকেই মা দিবস পালিত হয়ে আসছিল। মা দিবস পালনে আনা জার্ভিস নামে এক নারীর ভূমিকা থেকে তিনি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন। শুরুতে ছোটখাটো বাধা, হাসি-ঠাট্টার নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে সোনোরা ডোডকে। তাতে দমে না গিয়ে তিনি নিজের কাজে অবিচল থাকেন। বিভিন্নভাবে এ নিয়ে প্রচারণা চালান। স্পোকেন মিনিস্টারিয়াল এ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন এ ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করে। স্থানীয় ক্রিশ্চিয়ান যুব সংগঠন নামে আরেকটি সংগঠনও তাকে সহায়তা দেয়। সম্মিলিত সহযোগিতায় ১৯১০ সালের ১৯ জুন নতুনভাবে প্রথমবার বাবা দিবস উদযাপন হয়। সোনোরা ডোড চেয়েছিলেন তার বাবার জন্মদিন পাঁচ জুন বাবা দিবস পালিত হোক, কিন্তু সে বছর পাঁচ জুনের আগে দিবস উদযাপনের জন্য পর্যাপ্ত সময় না থাকায় ঠিক করা হয় ১৯ জুন বাবা দিবস পালিত হবে। সে বছর ১৯ জুন ছিল মাসের তৃতীয় রবিবার। এরপর থেকে প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯১০ সালের পর ধীরে ধীরে এ দিবসের পরিসর বাড়তে থাকে। ১৯১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন একে রাষ্ট্রীয় উৎসবের স্বীকৃতি দেন। যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কোলিজ ১৯২৪ সালে বাবা দিবসকে রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন ঘোষণা করার উদ্যোগ নেন। যদিও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি।
×