ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জীবনের মোহমুক্তিই আমার মোক্ষ -আতাউর রহমান

প্রকাশিত: ১১:৩৬, ২০ জুন ২০১৯

জীবনের মোহমুক্তিই আমার মোক্ষ -আতাউর রহমান

আতাউর রহমান। বাংলাদেশের নাট্যশিল্পে যার নাম একটি শিরোনাম। নাট্যাভিনয়, নাট্যনির্দেশনা, নাট্যশিক্ষক এবং ট্যসমালোচনা-নাটকের প্রতিটি আঙিনায় যার সমান সফল রিচরণ। শৈশব থেকে আজ অবধি এই মানুষটি শিল্পের সন্ধানে নিমগ্ন। পারিবারিক আবহ কিংবা ব্যক্তিগত সীমানা সবটাই তাঁর শিল্প প্রেমের অনুপ্রেরণা। শিল্পের সন্ধানে কেটেছে ৭৮ বছর। গত ১৮ জুন ছিল তাঁর ৭৮তম জন্মদিন। দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা। ভাল লাগা-মন্দ লাগা এবং শিল্প সৃষ্টির অনুপ্রেরণা অসঙ্কোচে ব্যক্ত করেছেন আনন্দকণ্ঠের সঙ্গে লিখেছেন- সব্যসাচী দাশ আমাদের নাট্যশিল্পে তার অবদান নতুন করে বলার কিছু নেই। কেবল নাট্যশিল্প চর্চা নয় শিল্পী তৈরির ক্ষেত্রে এই মানুষটির ভূমিকা অসামান্য। নাট্যাঙ্গনে তাঁর হাত ধরে উঠে আসা প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর সংখ্যাও কম নয়। প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা ও নির্দেশক আলী যাকের এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘আতাউর রহমান আমার অভিনয় জীবনে সবচেয়ে বড় অর্জনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, গ্যালিলিও নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে’ কেবল আলী যাকের নয়, রামেন্দু মজুমদার, লাকী ইমাম, সারা যাকের, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু থেকে শুরু করে প্রখ্যাত নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর জীবদ্দশায় বার বার উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের নাট্যশিল্পে আতাউর রহমানের অবদান। সময় আগে থেকে ঠিক করা ছিল। আবহাওয়া বৈরী থাকায় দশ মিনিট দেরি! অসুবিধে নেই আতাউর রহমান সব সময় পরিস্থিতি বুঝে মানিয়ে নিতে পারেন। যা তাঁর আচরণে পরিষ্কার উপলব্ধি করতে পেরেছি। শুরুতেই কেমন আছেন? মুখে প্রশান্তির হাসি ‘ভাল আছি।’ আপনার ৭৮তম জন্মদিন কেমন অনুভব করছেন? আতাউর রহমান; স্বাভাবিক অনুভব করছি। এখনও সংগ্রামের মধ্যদিয়ে জীবন অতিবাহিত করছি। আমি মনে করি এই যে বেঁচে থাকার সংগ্রাম বা জীবন ধারণের কাজ এটাই আমাকে স্বাভাবিক জীবন দান করছে। এসবের মধ্যদিয়ে আমি প্রতিনিয়ত জীবনকে উপভোগ করছি। আপনার ব্যক্তিগত এবং শিল্প জীবন সম্পর্কে বলেন, শৈশব থেকে। আমার জন্ম ১৯৪১ সালে নোয়াখালীতে। সে সময় বাবা চাকরি করতেন কলকাতায়। পরিবারের সঙ্গে আমার ছোট বেলা কেটেছে সেখানে। দেশ ভাগ হলে আমরা চট্টগ্রাম চলে আসি। ছোট থেকে পারিবারিক সাংস্কৃতিক আবহে আমার বড় হওয়া। এরপর ঢাকায় চলে আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ওখান থেকে এমএসসি করি। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষে অনেক ভাল ভাল চাকরির সুযোগ আসে। কিন্তু কোন চাকরি আমার করা হয়নি। কারণ ঠিক করেছিলাম কারও চাকরি আমি করব না। শিল্পের প্রতি অনুরাগ আমার সবসময়। ষাটের দশকের শেষ পর্বে আমেরিকার হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাট্যকলা অধ্যয়ন শেষে জিয়া হায়দার ভাই ঢাকায় এলেন। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পের্কের সুবাদে আমরা একটি নাট্যদল গঠন করি, ‘নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়’ নামে ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে। আমি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। মূলত ওখান থেকে আমার আনুষ্ঠানিকভাবে নাট্যশিল্পের সঙ্গে যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে আজ অবধি এই শিল্পের সঙ্গে আছি। বর্তমান পেক্ষাপটে আমাদের নাট্যশিল্পের সার্বিক অবস্থা কেমন বলে আপনি মনে করেন? আতাউর রহমান; ভাল না। অবস্থার উত্তরণ কিভাবে সম্ভব? দেখেন মঞ্চ নাটক একটি জীবিত শিল্প। এখনও ইংল্যান্ডের অনেক হলে নাটক মঞ্চস্থ হলে ছয় মাস আগে থেকে টিকেট বুকিং হয়ে যায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যান্য রাজ্য নাট্যশিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে নগদ অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে। যদিও নির্দিষ্ট নিয়মে। তারপরও শিল্প এবং শিল্পী রক্ষার্থে তারা ইতিবাচক কাজ করছে। সেদিক থেকে আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ তেমন দেখছি না। শিল্পের প্রতি রাষ্ট্রের আরও আন্তরিক হতে হবে। আমাদের এখানে ঢাকাসহ সারাদেশে ৬৪টি জেলায় একটা করে শিল্পকলা রয়েছে। সেখানে নাট্যচর্চার ব্যাপারে আপনার অভিমত? শিল্পকলায় নাট্যচর্চার ব্যাপারে লাকী (লিয়াকত আলী লাকী) ভাল করছে। বর্তমানে যারা নাট্যচর্চা করছে আপনার দৃষ্টিতে তাদের ভেতর উল্লেখযোগ্য কে বা কারা? বর্তমানে যারা নাট্যচর্চা করছে তাদের মধ্যে প্রাচ্য নাট্যের পাভেল, (আজাদ আবুল কালামের ডাক নাম) আহমেদুল কবির, ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’ নাটকের লিয়ন এরা ভাল করছে। সুযোগ পেলে আরও ভাল করতে পারবে এমন তরুণ নাট্যকার এবং শিল্পীও অনেকে আছে। আর সিনিয়রদের মধ্যে? রামেন্দু মজুমদার, আলী যাকের, লিয়াকত আলী লাকী, ইসরাফিল শাহীন, ভাল করছেন। জন্মদিনে নিজস্ব অভিমত? আমি ভাল আছি। দেশ ছেড়ে যাইনি। দেশের প্রতি মান অভিমান থাকলেও দিন শেষে দেশ মাতৃকার কোলেই আশ্রয় নেই। ব্যক্তিগত কোন লক্ষ্য যা এখনও পোষণ করেন? আতাউর রাহমান; ‘জীবনের মোহমুক্তিই আমার মোক্ষ’ এত অল্প কথায় আতাউর রহমান সম্পর্কে বলা সম্ভব নয়। তার নাট্যাভিনয়, নাট্যনির্দেশনা নিয়ে সামান্যতম আলোচনা করলে লেখার আয়তন আর সীমিত রাখা যাবে না। কেবল একদিক উল্লেখ না করলেই নয়। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের লেখা একাধিক নাটকের তিনি পূর্ণতা দিয়েছেন। যে নাটক নির্দেশনা বা মঞ্চায়নের সিদ্ধান্তে সবাই বিমুখ হয়েছেন, সেই নাটক দক্ষ নির্দেশনার মধ্যেমে শিল্পগুণে আলোক উজ্জ্বল করেছেন। যেমন নাটক ‘ঈর্ষা’ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ ‘নারীগণ’ ‘অপেক্ষমাণ’ সৈয়দ হকের এই নাটকগুলো আতাউর রহমানের আলো না পরলে হয়তো জীবন ফিরে পেত না। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এখানেই তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব। এছাড়া তাঁর অনান্য কাজ আজ এবং আগামীতে আমাদের নাট্যাঙ্গনে বহুকাল আলো দিয়ে যাবে।
×