ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দ্রুততম মানবী শিরিন আক্তারের বিশ্বকাপ ভাবনা

‘জয়ের ধারা অব্যাহত রাখুক বাংলাদেশ’

প্রকাশিত: ১১:৪৫, ২০ জুন ২০১৯

 ‘জয়ের ধারা অব্যাহত রাখুক বাংলাদেশ’

রুমেল খান ॥ সাতক্ষীরার এল্লারচরের দোহা কোলা গ্রাম। এ গ্রামে বাস করেন ব্যবসায়ী শেখ আবদুল মজিদ। মাছের ঘের আছে তার। আর আছে প্রচুর ধানী জমির মাঠ। প্রচন্ড ধর্মপরায়ণ। স্ত্রী আঙ্গুরা বেগম। তাদের চার সন্তান। সবাই মেয়ে। তিন মেয়ে বাবার হুকুমে পর্দা করে চলে। বোরকা পরে বাইরে যায়। তবে দ্বিতীয় মেয়েটি একটু ব্যতিক্রম। এ মেয়েটিই একসময় সাংঘাতিক রক্ষণশীল ও গোঁড়া মনোভাবের বাবাকে রাজি করিয়ে এ্যাথলেটিক ক্যারিয়ার শুরু করল। একসময় জাতীয় পর্যায়ে সফলও হলো। এমনই সফল, আটবার হলো দেশের দ্রুততম মানবী (সামারে চারবার, ন্যাশনালে চারবার)! মেয়েটির নাম শিরিন আক্তার। দুঃখজনকভাবে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোন খেলাই দেখা হয়নি ২০০৬ সালে জীবনের প্রথম দৌড় ৬০ মিটারে প্রথম হওয়া শিরিনের। কারণ দুটি। জনকণ্ঠকে দেয়া একান্ত আলাপনে তিনি জানান, ‘দিনের বেলা অনুশীলন করে ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে ১০টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ি। আরেকটা কারণ হচ্ছে বিকেএসপি হোস্টেলে টিভি আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা আমার রুম থেকে অনেকটা দূরে। রাতে ওখানে একা একা যেতে ভয় করে। তবে খেলা না দেখলেও বিশ্বকাপের খবরা-খবর ঠিকই রাখি। বিশেষ করে বাংলাদেশ দলের।’ জাতীয় পর্যায়ে খেলার আগে জুনিয়র মিটে অংশ নিয়ে সেখানেও (২০০৯-২০১২ সাল পর্যন্ত) নজরকাড়া সাফল্যের অধিকারী শিরিন আরও যোগ করেন, ‘আজ অবশ্য আপনি যখন ফোনে কথা বলছেন, তখন ইংল্যান্ড-আফগানিস্তান ম্যাচটি খানিক সময় দেখছিলাম সুযোগ পেয়ে। এর আগে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটিও অল্প সময়ের জন্য দেখেছিলাম।’ বাংলাদেশের দুটি জয় এসেছে এখন পর্যন্ত। এই জয়ই প্রমাণ করে বাংলাদেশের ক্রিকেটটা আজ অনেক এগিয়ে গেছে। আরও এগোবে। তাদের এই এগোনটা পরিকল্পিতভাবেই হচ্ছে। কারণ তারা সবদিক থেকেই ফ্যাসিলিটিজ পাচ্ছে। ২০১৩ সালে সাব-জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের পুনেতে ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে দলগতভাবে তৃতীয় হওয়া শিরিন কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য জানালেন, ‘লিটন দাস বিকেএসপিতে আমার এক ব্যাচ জুনিয়র ছিল। সৌম্য সরকার আবার আমার এক ব্যাচ সিনিয়র। আর মুশফিকুর রহীম ও সাকিব আল হাসান আমার অনেক সিনিয়র।’ ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে নাজমুন নাহার বিউটিকে ২০০ মিটারে হারানো (ওই আসরে ১০০ মিটারে ফটোফিনিশে দ্বিতীয় হন শিরিন, প্রথম হন বিউটি) শিরিনের মতে, ‘বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের এখন সেমিতে যাবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। তবে তাদের এ জন্য আরও দুটি-তিনটি ম্যাচে ভাল খেলে জিততে হবে। খেলোয়াড়দের পারফর্মেন্সের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। আমার তো মনে হচ্ছে তারা পারবে।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা শিরিন বেশ আশাবাদী বাংলাদেশের দুই ক্রিকেটারকে নিয়ে, ‘সাকিব যেভাবে দুর্দান্ত খেলছেন, বাকি ম্যাচগুলোতে সেভাবে খেলে যেতে পারলে তাকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। আমাদের মুস্তাফিজও অনেক ভাল বোলিং করছেন।’ গত ২০১৫ বিশ্বকাপের খেলাগুলোও সেভাবে দেখতে পারেননি কৃষ্ণকলি-সুদর্শনা শিরিন, ‘তবে সেবার সমর্থন করেছিলাম অবশ্যই আমার প্রিয় বাংলাদেশ দলকেই।’ শিরিনের অতীতের প্রিয় ক্রিকেটারদের তালিকায় আছেন বাংলাদেশের আবদুর রাজ্জাক (তিনিও বিকেএসপির সাবেক শিক্ষার্থী), ভারতের শচীন টেন্ডুলকর, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্রায়ান লারা এবং পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি। ২০০৭ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হন। এখন খেলছেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হয়ে। তবে নিজের সুবিধার জন্যই নৌবাহিনী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বিকেএসপিতেই সবসময়ই অনুশীলন করেন কোচ আবদুল্লাহ হেল কাফির কাছে। ২০০৮ সালে বিকেএসপিতে মেয়েদের ক্রিকেট চালু হয়। তখন থেকেই সেখানে প্রতিবছর বিশেষ কোন দিবস উপলক্ষে মেয়েদের প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ হতো। তাতে নিয়মিতই খেলতেন শিরিন। মিডিয়াম পেস বোলিং করে উইকেট ভালই পেতেন। এ প্রসঙ্গে শিরিনের লাজুক স্মৃতিচারণ, ‘আমার খেলা দেখে বিকেএসপির ক্রিকেট কোচরা আমাকে এ্যাথলেটিক্স ছেড়ে ক্রিকেট বেছে নিতে বলেন। কিন্তু নানাদিক বিবেচনা করে আমি ক্রিকেটে আর যাইনি। রয়ে যাই এ্যাথলেটিক্সেই। কেননা ভেবে দেখলাম ওই সময় মেয়েদের ক্রিকেটের কোন ভবিষ্যত নেই। তাছাড়া এটা দলীয় খেলা। সেক্ষেত্রে এ্যাথলেটিক্স হচ্ছে একক নৈপুণ্যের খেলা। এই খেলায় সফলতা-ব্যর্থতা সব নিজের হাতে।’ আমি মনে করি আমি ক্রিকেটে থাকলে আজ জাতীয় ক্রিকেট দলে খেলতে পারতাম। আমার বিকেএসপির কিছু জুনিয়র সহপাঠী আজ জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটার। যেমন পিংকি, সুপ্তি। তাই বলে ক্রিকেটে না যাওয়ায় কোন আক্ষেপ নেই আমার। এ্যাথলেটিক্স খেলেই আমি খুশি।’ ৪৬ দিনে এবারের বিশ্বকাপের আসরে ৪৮ ম্যাচ হবে। সময়টাকে ‘কম’ বলে মনে করেন শিরিন, ‘আরও বেশি সময় নিয়ে আয়োজিত হলে ভাল হতো। এতে দলগুলো পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিয়ে আরও ভাল খেলতে পারতো। তবে এখন যেভাবে হচ্ছে সেটাও ঠিক আছে।’ বৃষ্টি এবার বেশ ভোগাচ্ছে বিশ্বকাপের আসর। এ নিয়ে শিরিনের অভিমত, ‘রিজার্ভ ডে না রাখায় অবাক হয়েছি। তবে এটা ঠিক, বৃষ্টির ওপর কারোর হাত নেই। এখন সম্ভব না হলেও ভবিষ্যতে বিশ্বকাপের খেলাগুলো আয়োজন করা উচিত ইনডোর স্টেডিয়ামে। তখন আর বৃষ্টি নিয়ে দুর্ভাবনা করতে হবে না।’
×