ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আব্দুর রাজ্জাক

যাত্রাশিল্প ও মানুষের আবেগ

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ২১ জুন ২০১৯

যাত্রাশিল্প ও মানুষের আবেগ

মানুষ মৌখিক উপস্থাপনা, অভিনয় ও লেখার মাধ্যমে যাপিত এবং আধ্যাত্মিক জীবনের নিগুঢ় অনুভূতি প্রকাশ করতে চায়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ অভিনয় করে আসছে। প্রাথমিক পর্যায়ে অভিনয়ের মাধ্যম ছিল যাত্রা। যাত্রার বিষয় ছিল দেব বন্দনা ও ধর্মীয় কাহিনী নির্ভরতা। অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে দেবতার প্রতি মানুষের প্রেমভক্তির আধিক্য। প্রাচীন যুগে রাধাকৃষ, বামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের কাহিনী হয়ে উঠে যাত্রার বিষয়-আশায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিক যুগের মাহেন্দ্রক্ষণে মানুষ যাত্রার বিষয়-বৈচিত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। পৌরাণিক কাহিনীর পরিবর্তে আধুনিক অনুসঙ্গ স্থান করে নিয়েছে। মানুষ ও সমষ্টিগত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, শোষণ-ত্রাসন হয়ে উঠে যাত্রার উপজীব্য। যাত্রাপার ইতিহাসও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের মতো বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আধুনিক কালে এসে উৎকর্ষ অর্জন করেছে। মানুষের অভিনয় শিল্পবোধের এ চেতনা আদিগ্রন্থ ‘বেদ’ এ লক্ষ করা যায়। সে ক্ষেত্রে বলা যায় যাত্রা অত্যন্ত প্রাচীন একটি বিনোদন শিল্প মাধ্যম। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে নানা বাঁক পেরিয়ে যাত্রাপালা আধুনিককালে এসে পৌছেছে। যাত্রা উন্মেষকাল নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। নগেন্দ্রনাথ বসু (১৮৬৬-১৯৩৮) যাত্রার উদ্ভব সর্ম্পকে বলেন, ‘অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারতবর্ষের সকল স্থানেই প্রকাশ্য রঙ্গভূমে বেশভূষায় ভূষিত ও নানা সাজে সুসজ্জিত নরনারী লইয়া গীতবাদ্যাদি সহকারে কৃষ প্রসঙ্গ অভিনয় করিবার রীতি প্রচলিত ছিল। পুরাণাদি শাস্ত্রগ্রন্থে বর্ণিত ভগবদবতারের লীলা ও চরিত্র ব্যাখান করা এ অভিনয়ের উদ্দেশ্য। ধর্মপ্রাণ হিন্দুগণ সেই দেবচরিত্রের আলৌকিক ঘটনা পরম্পরা মনে রাখিবার জন্য এক একটি উৎসবের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। গীতবাদ্যাদিযোগে ঐ সকল লীলোৎসব প্রসঙ্গে যে অভিনয়ক্রম প্রদর্শিত হইয়া থাকে, তাহাই প্রকৃত যাত্রা বলিয়া অভিহিত।’ (নগেন্দ্রনাথ বসু, বাংলা বিশ্বকোষ, পঞ্চদশ ভাগ, বিআর পালিশিং কর্পোরেশন, দিল্লী, পুনর্মুদ্রণ ১৯৮৮, পৃ. ৬৯৭) নন্দ্রেনাথ বসুর ধারণা মতে ভারত বর্ষে অতিপ্রাচীনকালেই নারী-পুরুষ দেবতাদের প্রতি প্রেম আধিদক্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে অভিনয় করতো যা পরবর্তীতে যাত্রা নামে পরিচিতি লাভ করে এবং ভারত বর্ষে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই জনপ্রিয়তা যাত্রাশিল্পকে বহুগুণ বিকাশিত করে। ড. নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় যাত্রার উদ্ভব বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক মতামত দিয়েছেন, ‘The well-known Sanskrit Idyll called Gita-gobinda, by Jayadeva Goswmi, which, as has been well observed, is nothing but a Yatra in Sanskrit, is based on a part of the story, in as much as it depicts only he amours of Krishna with Radha in their various phaes without referring to other two periods of his life. (Nishikanta Chattopadhyay, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩-৬৮) নিশিকান্তের এই মতবাদ কেউ কেউ মানতে চান না। তাই কেউ কেউ বলেন, ‘অপভ্রংশ ভাষার খোলস ছেড়ে যখন নতুন বাংলার সৃষ্টি হয়েছিল, তখনই যাত্রাপালার উদ্ভব হয়।’ সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘The break up of the old orthodox drama was almost synchronous with the rise of Apbhramasa and modern Indian Lierature; and along with it came popular intertainments of the type of semi- religious Jatra.(A History of Classical Sanskrit Literature, vol 1, Cacautta, 1962, P. 508) গবেষক প্রভাতকুমার গোস্বামী যাত্রা ও থিয়েটার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যাত্রার উদ্ভবকাল দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘ষোড়শ শতাব্দীতে যাত্রার বীজ বাংলার মাটিতে উপ্ত হয়েছিল, তা অষ্টাদশ শতাব্দীতে অঙ্কৃরিত হয় এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা নানা শাখা-প্রশাখা সমন্বিত বৃক্ষে পরিণত হয়। ‘যাত্রা’র জন্মটা আগে হলে তার বিকাশ ঘটেছে থিয়েটারে পাশাপাশি।’ (প্রভাতকুমার গোস্বামী, ‘ঐতিহাসিক নাটক ও ঐতিহাসিক যাত্রা’, দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটক, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৩৮৮, পৃ. ২৯৩)। প্রভাতকুমার গোস্বামীর আলোচনা যাত্রার এক প্রকার বিবর্তিত ইতিহাস উঠে এসেছে। স্থান, সময় এবং যাত্রার ব্যাপকতায় যে, উৎকর্ষিত হয়েছে তার ইঙ্গিত করেছেন। মণীন্দ্রলাল কুণড়ু যাত্রার উদ্ভব সর্ম্পকে বলেন, ‘খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীরদ দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বাংলা দেশে প্রচলিত নাটগীতির ধারণাটি পরিবর্তিতরূপে যাত্রা নামে অভিহিত হতে থাকে। তিনি বলেছেন, ষোড়শ শতাব্দীর আগে নাটক বা নাট্যাভিনয় অর্থে ‘যাত্রা’ শব্দের প্রয়োগ আমরা পাই না। অবশ্য অভিনয় ছাড়া অন্যান্য অর্থে ‘যাত্রা’ শব্দটির প্রয়োগ প্রাচীনকাল থেকেই ছিল।’ (মণীন্দ্রলাল কুণড়ু, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৮)। ফোকলোরবিদ আশরাফ সিদ্দিকী মনে করেন যাত্রাপালার উদ্ভব হয়েছে দ্বাদশ শতাব্দীতে। তিনি বলেন,‘ কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং পরবর্তীকালে শ্রীকৃষকীর্ত্তনের মধ্যেই যাত্রার নিদর্শনটি পাওয়া যাবে।’ মধ্য-পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজ জীবনে শ্রীচৈতন্যের (১৪৮৬-১৫৩৩) ব্যাপক অবদান রয়েছে। তাঁর গীত, অভিনয় এবং নৃত্যের সমন্বিত পরিবেশনাকে যাত্রাই বলা হয়ে থাকে। ষোড়শ শতাব্দীতেই মূলত যাত্রা শব্দের পরিচিতি ঘটে। আর এ সময় বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী অভিনয় করে দেখানো হতো সে অভিনয় থেকেই যাত্রা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেবের গীত অভিনয় যাত্রার প্রাথমিক প্রচেষ্টা হলেও আবার কেউ কেউ বলেন শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগেও রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, গৌড়, পু-্র, চন্দ্রদ¦ীপ, হরিকেল, শ্রীহট্টসহ সমগ্র ভূখন্ডে পালাগান ও কাহিনীকাব্যের অভিনয়ের প্রচলন ছিল। আমরা বিবর্তনের ধারায় একধাপ এগিয়ে শোড়ষ শতকের দিকে তাকালে যাত্রাকে দেখতে পাই অভিনয়কলা হিসেবে। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে যাত্রার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ সাধিত হয়। আধুনিককালে যাত্রার বিকাশ সর্ম্পকে বাংলাদেশের গবেষক তপন বাগচী বলেন, ‘যাত্রার এখন যে রূপ টিকে আছে তা মূল থেকে অনেক বিবর্তিত, অধঃপতিত, যুগের দাবির কাছে সমর্পিত। যাত্রার সঙ্গে বাঙালির নাড়ির টান খুব শক্ত। যাত্রায় বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ পাওয়া যায় তীব্রভাবে। তাঁর মতে, যাত্রা রূপ বদলালেও অস্তিত্ব রক্ষা করে চলছে।’ (তপন বাগচী, বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, পৃ. ২৬)। যাত্রার সাথে বাঙালির নিবিড় বন্ধন, মানুষের আবেগ এবং যাত্রায় গ্রাম-বাংলার চিরায়িত লোকজ সংস্কৃতির ধারার সাথে সাধারণ মানুষের আত্মিক যে সর্ম্পক তা ব্যাখ্যানের প্রচেষ্টা থাকবে উক্ত নিবন্ধে। ধর্মীয় বা কোনো সামাজিক উৎসবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার যে রীতি তাকে যাত্রা বলে। এদেশে বিভিন্ন নামে যাত্রা সাধরণ মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে। রাধার বারোমাসী, সীতার বারোমাসী, শিবের গাজন, রামযাত্রা, কেষ্টাযাত্রা জনপ্রিয় ছিল। অষ্টাদশ শতকে যাত্রা বাংলার মানুষকে আবিষ্ট করে ফেলে এবং সর্বত্র তা ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক যাত্রা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তখন মতিলাল ও নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের যাত্রাদল বিখ্যাত হয়েছিল। কৃষলীলা, মহাভারত এবং রামায়ণের পৌরাণিক কাহিনির পাশাপাশি লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা, বেহুলা-লখিন্দর, মা মনসা, লক্ষ্মির মহিমা, কমলাবতী রাণীর প্রেম-কাহিনী বাংলায় প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ছিল। দৌলত উজির বাহরাম খাঁ বিরচিত লায়লী-মজনু বিয়োগান্তক রোমন্টিক প্রণয়োপাখ্যানটির মূল উৎস আরবি লোকগাঁথা। সারা বিশে^র মতো বাংলা সাহিত্যেরও এটি সম্পাদ এবং নিরেট প্রেমের নির্দশন। এ বিয়োগান্তক প্রণয়োপাখ্যান প্রত্যেক প্রেমিক হৃদয় রক্ত ঝরায় এবং শুনে চোখ মুছে। অনেক আছে প্রিয়াকে না পেয়ে মজনু বনে যায়। এই মর্মস্পর্শী বেদনাময় কাহিনীকে যাত্রার মাধ্যমে মনস্থ করা হয় তখন মানুষ আবেগে আপ্লত হয়েছে। সুপ্রাচীন প্রয়ণকাহিনী ইসুফ -জোলেখার উপজীব্য হয়ে আছে। বাংলার তথা সারা বিশে^র মুসলমানদের একটি পবিত্র ও আগ্রহের বিষয়। যা কুরান ও বাইবেলে উল্লেখ রয়েছে। বেহুলা-লখিন্দার বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় মঙ্গল কাব্য মনসামঙ্গলের প্রধান চরিত্র। চাঁদ সদাগরের পুত্র লখিন্দারের সর্পাঘাতে মৃত্যুর পর পুত্রবধু বেহুলার আত্মত্যাগের যে উপাখ্যান ধ্বনিত হয়েছে তা প্রত্যেক বাঙালি নারীর কাছে পতি ভক্তির পবিত্র দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এ সব উপখ্যান যাত্রার মাধ্যমে আরো জীবন্ত হয়ে ওঠে এসব প্রেমকাহিনী, লোকজ প্রেমীলা মঞ্চে দেখে মানুষ নিজ জীবনের সাথে মিলায় এবং কষ্ট অনুভব করে। যাত্রায় দেশপ্রেমমূলক কাহিনীর শুরু হয় উনবিংশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুর দিকে। এক্ষেত্রে সিদ্ধ হস্ত ছিল মুকুন্দ দাশ। তিনি বিক্রমপুর থেকে বরিশাল গিয়ে বিপ্লবী অশ্বিনী কুমারের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন। তিনি ‘স্বদেশী যাত্রা’র সূচনা করেন। তাঁর এই যাত্রাপালার উদ্দেশ্য ছিল সমাজের নানা কুসংস্কার, অসংগতি, পণপ্রথা এবং জাতিভেদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করা। মুকুন্দ দাশের অনুপ্রেরণায় আরো অনেকে স্বদেশী যাত্রার দল গঠন করে। দেশপ্রেম মূলক যাত্রার কাহিনী তারা গ্রামে গিয়ে প্রদর্শন করতো। ঈশা খাঁ, বারো ভঁইয়া, সোনাভান, নবাব সিরাউদ্দৌলা, ক্ষুদিরাম এবং আরো বিপ্লবী নামে যাত্রাপালা অভিনয় হতো। যা মানুষেনর মনে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে সচেতন করে তুলতো। এই সাহসী কার্যক্রমের জন্য তাদের ইংরেজ শাসকদের রোষানলে পড়তে হয়। এর আগে ঢাকায় ‘স্বপ্নবিলাস’, ‘দিব্যোন্মাদ’, ‘বিচিত্রবিলাস’ পালা লিখে বিখ্যাত হয়েছেন কৃষকমল গোস্বামী। ‘মধুমালা’, ‘সাগরভাসা, ‘কাঞ্চনবতী’, ‘বিন্দুমতি’, ‘পুষ্পমালা পালা লিখেন নফরউদ্দিন নামে একজন পালাকার। তার এই রূপকথামূলক কাহিনীগুলো মানুষের বিনোদন এবং তাদের আত্মার সাথে মিশে আছে। বেহুলা নিয়ে পালা লিখেছেন বিখ্যাত সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিষাদসিন্ধু’ -এর কাহিনী নিয়ে গ্রামে যাত্রা অভিনয় হতো। বাঙালি মুসলিম সমাজে এ গ্রন্থকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়। বিশ শতকে বাঙালির সংস্কৃতি অঙ্গনে কিছু বৈপ্লবিক সাধিত হয়। তখন কিছু লোককাহিনী নির্ভর যাত্রা জনপ্রিয়তা পায় ‘রূপবান-রহিম বাদশা’ তার মধ্যে একটি। যাত্রাপালাটির কাহিনী নিয়ে ১৯৬৫ সালে নির্মিত হয় ‘রূপবান’ নামে চলচিত্র। এ লোকজ কাহিনীর বিষয়াঙ্গিক বাঙালির সংস্কৃতি অঙ্গন তথা মানুষের আবেগকে বেশি পরিমাণ আলোড়িত করেছে। পনেরো দিনের রহিমের সাথে পনেরো বছরের রূপবানের বিবাহ। রাজ পরিবারের উপর দৈব শক্তির আরোপ এবং পনেরো দিনের মাথায় শিশু স্বামীকে নিয়ে গভীর বনে নির্বাসন ¯্রােতা সাধারণের আবেগকে আরো উতলিয়ে দিয়েছে। বাঙালি নারীর আদর্শ বুকে ধারণ করে শিশু স্বামীকে প্রতিপালনের দায়িত্ববোধ মাথা তুলে নিলো। এই যে ত্যাগ, তা পতিভক্তির দৃষ্টান্ত হয়ে রইলো। রূপবান-রহিম বাদশা লোকজ কাহিনীর কিছু বিচ্ছেদ গান মানুষের অন্তরে অনুরিত হয়ে আসছে যুগ-যুগ ধরে। এই যাত্রা মানুষের বিনোদনের মাধ্যম হলেও এ সব গান ছিল মন থেকে বিরহ-ব্যথা মোছনের উপায়। ‘রূপবান-রহিম বাদশা’ কাহিনীতে রূপবানের বনোবাসে যাওয়ার পথে নদীতে অথৈ ঢেউ/ মহাবিপদের আশঙ্কায় রূপবান গেয়ে উঠে। ‘ঢেউ উঠছে সাগরে রে / কেমনে পাড়ি ধরি রে/ দিবানিশি কান্দি আমি নদীর কূলে বইয়া/ ও মন রে যারা ছিল চতুর মাঝি তারা গেলো বাইয়া।/ রূপবান বনোবাসে সকল প্রতিকূতার সাথে যুদ্ধ করে। হৃদয় নিড়াংরো সবটুক ভালোবাসা উজার করে পনেরো দিনের শিশু স্বামীকে নিজের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তুলে। যখন ফসল ঘরে তোলার সময় তখন তার ঘরে বিরহ হানা দেয়। রাজার মেয়ে তাজেল রহিমকে ভালোবেসে ফেলে। রূপবানের এই যে বিরহ তা শতকোটি বাঙালি নারীর বিরহ গাঁথা। বিরহ শামাল দিতে রূপবান যে মিনতী করে গান গায় তা বাঙালির নর-নারীর ঠোঁঠে ঠোঁঠে ছিল অব্যক্ত বিরাহ প্রকাশের মাধ্যম। ‘শোনো তাজেল গো/ মন না জেনে প্রেমে মইজো না/ মন না জেনে প্রেমে মইজো না/ আগে না চিনিলে গো তাজেল/ পরবে গো ফেরে/ শেষে কাঁদলে দুঃখ যাবে না/ আমি করি বন্ধুর গো আশা/ তুমি তাতে সর্বনাশা/ এরকম অসংখ্য গান মানুষের আবেগে মিশে আছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনে এই লোকজ গন্ধ-সাধের গান ছিল তাদের আত্মার খোরাক। বিশ শতকে মানুষের সংস্কৃতিগত আবেগকে উদ্বেলিত করার যথেষ্ট নিয়ামক আমরা দেখতে পাই। সমাজের নানা অসংগতি এবং বাঙালির স্বকীয়তা ফুটিয়ে তুলতে অসংখ্য লোকজ কাহিনী নির্ভর যাত্রাপালা গড়ে উঠে। রূপবান-রহিম বাদশার মতো- ‘মালকা বানু’, ‘সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল’, ‘দুর্গামনি’, ‘মলুয়া’, ‘ভেলুয়া সুন্দরী’, ‘সোনাভান’, ‘বীরাঙ্গনা সখীনা’, ‘গাজী কালু’, ‘ কাশেম মালার প্রেম’, ‘রাখাল ছেলে’, ‘ভিখারীর ছেলে’, ‘আলোমতি’, ‘আপন দুলাল’, ‘প্রেমকুমার’, ‘রাখাল বন্ধ’ু, ‘লাইলি-মজনু’, ‘মধুমালা-মধন কুমার’, ‘গুনাইবিবি’, ‘কাজল-রেখা’, ‘কমলার বনসাস’ জনপ্রিয় যাত্রাপালা প্রচলিত রয়েছে। এ পালাগুলো সমাজ তথা মানুষের ভিতর-বাহিরের অনুসঙ্গ নিয়ে রচিত হয়েছে। দুই একটি ছাড়া যাত্রাপালাগুলোর বিষয়াঙ্গিক একই রকম মনে হয়। পালাকারীরা নারীর বিরহ, সমাজের উচ্চ শ্রেণির সাথে নীচু শ্রেণির প্রেম ও দ্বন্দ্ব, বিচ্ছেদ-ব্যথাকেই তারা যাত্রার উপজীব্য করেছে। অবশ্য আধুনিক যুগে এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসছে। আধুনিক যুগে পৌরাণিক, ঐতিহাসিক, কাল্পনিক বা লোককাহিনী-ভিত্তিক, সামাজিক এবং জীবনীমূলক পালা পাওয়া। স্বাধীনতার পরে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ও ইতিহাসভিত্তিক যাত্রার সন্ধ্যান পাওয়া যায়। ‘জয়বাংলা’, ‘মুক্তিফৌজ’, ‘নদীর নাম মধুমতি’, ‘রক্তস্নাত একাত্তর’, ‘সোনার বাংলা’, ‘একাত্তের জল্লাদ’ এগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে। যাত্রাশিল্প হচ্ছে আমাদের ঐহিত্যচর্চার ধারক-বাহক। সামাজিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব রয়েছে সেই প্রাচীন আমল থেকেই। এটি একটি জন বান্ধব মাধ্যম হিসেবেও যথেষ্ট কাজ করে। যাত্রাশিল্পের গুরুত্বের কথা উঠে আসে বাংলাদের বিদগ্ধজনের কণ্ঠে। সওগাত-সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন (১৮৮৮-১৯৯৪) যাত্রা ‘বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আদিরূপ’ হিসেবে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন যে, যাত্রাগান পল্লীর মানুষকে যতোটা আকৃষ্ট করে অন্য কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ততটা করে না। তিনি বিশ^াস করতেন যে, যাত্রা উন্নত ধরনের হলে তার প্রতি শহরবাসীরাও আকৃষ্ট হবে। (জাতীয় যাত্রা উৎসব ১৯৭৯-৮০ স্মরণিকা, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ. ২৭)। সৈয়দ মুর্তাজা আলী (১৯০২-১৯৮১) বলেন, ‘যাত্রার সরল আঙ্গিক ও প্রবল আবেগ জনমনকে সহজেই অভিভূত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যাত্রার সাহায্যে শহর ও গ্রামীণ মানুষের সংযোগ সাধন করা সম্ভব। বাংলাদেশের অগনিত লোকসাহিত্য-বিশারদ এবং যাত্রাপ্রেমী জ্ঞানীদের কাছ থেকে যাত্রার এমন ইতিবাচক উপলব্ধি জানতে পারি। এতো সব থাকার পরেও বর্তমান সময়ে বিনোদনের সহজলভ্যতা, যাত্রাদলের অতিমুনাফালোভী মালিকদের খপ্পরে পড়ে গত তিন দশকে যাত্রাশিল্প মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে এবং বাংলাদেশের ‘যাত্রাম্রাজ্ঞী’ বলে খ্যাত জ্যোতস্না বিশ্বাস বলেন, ‘যাত্রাশিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ অসাধু যাত্রাপালা ব্যবসায়ীদের ‘প্রিন্সেস’ আমদানি আর জুয়া হাউজি চালু। তারা বলেন, এই শব্দগুলো আগে যাত্রাদলে ছিল না। (১৯৭৮-৭৯) সালের পর এই অশ্লীলতার শুরু হয় মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে এবং তাদের হাতেই চিরায়ত যাত্রা আজ মুমূর্ষু অবস্থায়। সাধারণ দর্শকরা এখনো সুস্থ ধারার যাত্রাপালা দেখতে চায়। সে ক্ষেত্রে যাত্রাশিল্পে ফিরে আসুক আগের ঐতিহ্য এবং একটি সুন্দর, সুস্থ বিনোদন মাধ্যম হিসেবে বাংলার সর্বস্থরের মানুষের কাছে আরো জনপ্রিয় ও আবেগের বিষয় হয়ে থাকুক।
×