ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চারপাশে মুগ্ধতা ছড়ায়

প্রকাশিত: ০৯:১১, ২১ জুন ২০১৯

  চারপাশে মুগ্ধতা ছড়ায়

দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনার নাম অন্যপ্রকাশ। প্রথিতযশা লেখক হুমায়ূন আহমেদের অসংখ্য বই প্রকাশ করে তারা নিজেরাই ধন্য হয়েছে। অন্যপ্রকাশ প্রতিবছরই পাঠকের হাতে তুলে দিচ্ছে অসংখ্য বই। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অনেক বইয়ের মধ্যে তরুণ কবি, গীতিকার, সাংবাদিক হক ফারুক আহমেদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গতার পাখিরা’ও বের করেছে অন্যপ্রকাশ। বইয়ের পাতায় নিজের লেখা কবিতা দেখে আনন্দে অভিভূত কবি ফারুক বলেন, প্রথম কাব্যগ্রন্থটি ছাপা হওয়ার পর বইয়ের একটি কপি হাতে নিয়ে মনে হলো, আরও একবার আমার জন্ম হলো। এখানে প্রত্যেকটি সৃজন, প্রতিটি কবিতা শুধুই আমার লেখা। এ এক অন্যরকম ভাললাগা।’ কবি হক ফারুকের দায়বোধটা মানসম্মত, সুন্দর লেখার প্রতি; দেশ ও সমাজের প্রতি। তাই দীর্ঘ সময় ধরে লেখালেখির পরই কবিতাগুলোকে বইয়ের মলাটে আবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। রবীন্দ্র-নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ পড়ে পড়ে বিস্মিত কবি লিখতে শুরু করেন। বিদেশী কবিরাও কবির মনে মুগ্ধতা ছড়িয়ে কবিতার বীজ বপন করেছেন। বিশেষ করে কোলরিজ ও রবার্ট ব্রাউনিংয়ের কবিতা কবিকে কবিতা লিখতে বাধ্য করেছে। কবি হক ফারুক আহমেদ ১৯৯৯ সালে নটর ডেম কলেজে পড়ার সময় থেকেই লিখতে থাকেন বিভিন্ন পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। তবে তার লেখালেখির শুরুটা হয়েছে গান দিয়ে। পেশায় সাংবাদিক কবি হক ফারুক ব্যান্ড মেটাল মেইজে অফিসিয়াল গীতিকার হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করছেন। গানের পাশাপাশিই লিখছেন কবিতা। অ্যাকুয়া সাংস্কৃতিক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তরুণ এই কবি মনে করেন, একটু সচেতন হলেই আবেগহীন গতিময় সময়টাকে পাশে রেখে হৃদয় দিয়ে অনুভবের জায়গাটা ধরে রাখা যায়। নিজের ভেতরের মাটির মননকে ভাষা দিয়ে, আবেগ দিয়ে প্রকাশ করার প্রবল তাড়নায় কবি লিখে যান অনবরত। কবি আল মাহমুদের কবিতায় নারী এক বিশেষ জায়গাজুড়ে আছে। নারী নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। নারী বা প্রেয়সী নিয়ে তার অনেক কথার মধ্যে আজ একটি কথা আমার ভেতরে বারবার দোলা দিয়ে যাচ্ছে। আমি আমার মেমোরি থেকে বলছি- কবি আল মাহমুদ বলেন, এশিয়ার, তথা আমাদের এই দেশের নারীদের ভেজা শরীরে যে নারী-সৌন্দর্য, তীব্র কামনা-বাসনা, আবেগ-আনন্দ ফুটে ওঠে পৃথিবীর আর কোথাও নারীর ভেজা শরীরে এ কামনার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে না। ঠিক কবি হক ফারুক আহমেদের একটি কথাও আমার মনে বেশ দাগ কেটে গেছে। কবি ফারুক বলেন, এশিয়া, এই ভারতবর্ষ, তথা আমাদের এই বাংলাদেশের মানুষ যত বড়, যত সম্পদশালী, যত আনন্দ-উদ্বেলতার মধ্যেই হোক না কেন, ব্যথা বাঙালীর মধ্যে থাকবেই। এ যেনো আমাদের জন্মগত পাওয়া। অতএব, আমাদের লেখায়, কবিতায় ব্যথা, বিষণ্ণতা ও দুঃখের শোকগাথা, পিরামিড থাকবেই। এ থেকে আমাদের রেহাই নেই। তবে আশার কথা হচ্ছে ব্যথা, বিষণ্ণতা ও দুঃখের রাত আমরা যাই বলি না কেন কবির কাছে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসে শীতল ভোর। কুয়াশায় ভেজা শীতল ভোর। কবি বলেন- এত গভীর রাত্রির শেষে যদি মৃত্যুও আসত, অবাক হতাম না। দেখি এলো কুয়াশার ভোর। এক পৃথিবী ভস্ম হলেও পুড়তাম না। চোখ মেলে দেখি শীতল কুয়াশার ভোর। -মুঠো কুয়াশার ভোর যন্ত্রণারা আশপাশে থাকে, ঘুরঘুর করে ওদের পাখা গজায়, মৌমাছির মতো উড়ে উড়ে হুল ফোটায়। যন্ত্রণারা মেঘ হয়ে ঘরের সিলিংয়ে জমে থাকে; ওদের মাথায় অনেক বুদ্ধি, কখন কখন বাড়তে হবে কমতে হবে খুব ভালো করে জানে। যন্ত্রণারা মধ্য রাতে ঘুমায়, খুব সকালে জেগে উঠে অভিবাদন জানায়; দুপুরবেলা গোসল শেষে রোদ পোহায়। যন্ত্রণারা খুব বিলাসী আমোদপ্রিয়... -যন্ত্রণারা বেড়াতে গেছে কবিরা কখনো কখনো এমন কিছু বলেন, যা পড়লে মনে হয় এর ভেতর কিছুই নেই। কোথাও কিছু নেই। সব কী যেনোÑ হিজিবিজি, আঁকাবাঁকা, অস্পষ্ট ও অর্থহীন। অথবা বলা না বলার গল্প। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত মনে হয় ওর ভেতরেও কী যেন আছে। কবি হক ফারুক আহমেদের ‘অন্য কোথাও’ কবিতাটাকে অন্তত আমার তাই মনে হয়েছেÑ নিঃসঙ্গতার পাখিরা শিষ দিচ্ছে, পায়ে পায়ে চলছি কোথাও রাস্তা নেই, কেবল জলরাশি দেখি, ভালো লাগে। কোথা থেকে এসেছি জানি না, কোথায় যাব তা-ও না... -অন্য কোথাও কবির দায়বোধ থাকে। লেখার প্রতি কবির প্রচ- দায়বোধ থাকে। লিখতে লিখতে কবি এ দায়বোধের মধ্যে ধাপিত হন। দেশ ও সমাজের প্রতি কবি দায়বোধ্য হয়ে পড়েন। প্রকৃত দায়বোধ কবিকে অনেক দূর নিয়ে যায়। মাঝে মধ্যে স্থান কাল ও প্রাত্রের প্রতিও কবিকে দায়বোধ্য হতে হয়। কবি হক ফারুক আহমেদ দীর্ঘকাল ধরে ঢাকায় আছেন। এ ঢাকার প্রতি, ঢাকার ভাষার প্রতিও কবির একটা দায়বোধ তৈরি হয়ে গেছে। তিনি লিখে ফেলেছেন ঢাকা ও বরিশালের ভাষায় এক বিখ্যাত কবিতা ‘কথোপকথন’। যা পাঠকমাত্রই এ কবিতায় এক ভিন্ন স্বাদ গ্রহণ করবেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। কবিতাটির কিছু অংশ আমরা নিচে তুলে ধরছি- বাঙ্গাল হালারা আমগো ঢাকাটারে পুরা গিলা খাইলো সব জায়গায় গিজগিজ করতাছে। কোনো রহম লঞ্চ ধইরা সদরঘাট আয়া পারলেই অইলো ওগো মস্তানি শুরু, আর বালা লাগতাছে না। ......... বাঙ্গাল কন আর ক্ষেত কন টেহাডাতো আমাগোরতেই লন। ........ আমি খেয়াল করছি, তুই সবসোম কেরফা লাগাই না প্যাচাল পারোছ। বালা ওয়া যা কলাম। চা বালা বানাচ দেইখা তরে কিছু কমু না ভাবছচ? কী জামানা আইলো বাঙ্গালগো আতের চা খাওন লাগতাছে...। ......... - আরো খাওয়া লাগবে। আগের টাহাসহ এহন একশো পাঁচ টাহা অইছে, দিয়া যাইয়েন। তুই কি আমারে কিছু কইলি? - কথোপকথন হুম, আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা বড় বড় কথা বলে, গালগপ্প করে; কিন্তু আসল কাজের বেলায় সব ঠনঠন, সব ফাঁকি। সমাজের এই নিন্দিত মানুষদের তুলে ধরাই কবির কাজ। সমাজের অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খল, ঘুণ পোকা ও আগাছা উপড়ে ফেলার জন্যই কবিদের জন্য হয়। এ দায়বোধ কবিদের তাড়িয়ে বেড়ায়। কবি হক ফারুক আহমেদও এ দায়বোধের বাইরে নয়। এ দায়বোধ থেকেই কবি লিখে ফেললেন ‘কথোপকথন’ নামের বিখ্যাত কবিতা। কবি এ কবিতায় ঢাকা ও বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা খুব সুন্দর ও সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। কবিকে ধন্যবাদ। কবি হক ফারুক আহমেদ তার বইটিতে মানুষের যাপিত জীবনের একাকিত্ব, বেদনাবোধের মতো বিষয়ের পাশাপাশি নান্দনিকরূপে তুলে এনেছেন প্রেমকে। মানবীয় প্রেমের সঙ্গে বাংলার প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন স্বার্থকভাবে। হেমন্তপাখির বিছানাজুড়ে, দ্বীপান্তর, তুমিময়, মেলানকলি তেমনই কিছু কবিতা। তিনি বলছেন- এক পৃথিবীর পাখিদের গান ছিল বুকে পুরো একটা বর্ষার বৃষ্টি, এক শরতের রাতে যত শিউলি ফুল ফুটেছিল তাদের সৌরভ ছিল; জেগে থাকা নদীগুলোর তরঙ্গরা আর শীতের উষ্ণতা অগ্ন্যুৎসবগুলো। সব তোমাকে নিবেদন করে বলেছিলাম ‘ভালোবাসি’। কিছুই বললে না তুমি, শুধু একটু হেসে করলে দ্বীপান্তর - দ্বীপান্তর
×