ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ২১ জুন ২০১৯

বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকা

বিংশ শতাব্দীর তিন দশক অতিক্রম হলেও ভারতবর্ষে তখন এমন কোন সাহিত্যপত্র ছিল না, যেখানে কবিতাকে গুরুত্বসহকারে স্থান দেয়া হতো। সে সময়ে যেসব সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হতো সেখানে কবিদের স্থান কেবল নগণ্যই নয়, বলা যায় অচ্ছুৎও ছিল। অনেকে বলতেন, সাহিত্যপত্রে, বিশেষত ‘প্রবাসী’তে ইঞ্চি মেপে যেন কবিতা ছাপা হতো। অন্যদিকে ‘সবুজপত্র’, ‘কল্লোল’, ‘পরিচয়’ ইত্যাদি পত্রিকাগুলোতে কবিতা ছাপা হলেও সেগুলো বেশিরভাগই ছিল রবীন্দ্রনাথ নির্ভর। অন্যান্য কবিদের ঠাঁই সেখানে কম হতো, তরুণ কবিদের লেখা প্রকাশ হতো আরও কম। বুদ্ধদেব বসু এ সম্পর্কে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আবাল্য দেখেছি, বাংলা মাসিকপত্রে কবিতার স্থান পদপ্রান্তিক। অর্থাৎ যেখানে কোন গদ্যরচনা শেষ হলো তারই ঠিক তলায় থাকে কবিতা-কোথাও কোথাও রর্জইস অক্ষরে কুণ্ঠিত হয়ে।... ১৯৩২-৩৩-এ কলকাতায় ভাল পত্রিকা অনেক ছিল কিন্তু এমন কোন পত্রিকা ছিল না যার মধ্য দিয়ে কবিতা হতে পারে বিশেষভাবে প্রকাশিত, প্রচারিত ও রসজ্ঞজনের দৃষ্টিগোচর।’ মাসিকপত্রে কবিতা প্রকাশ নিয়ে কুণ্ঠা, অনাদর ও অনাগ্রহের বিষয়টি বুদ্ধদেবকে সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখত। এর থেকে পরিত্রাণও তিনি চাইতেন প্রবলভাবে। তাঁর আগ্রহের নদীতে জোয়ার আসে ইংরেজী পত্রিকা ‘পোয়েট্রি’ দেখার পর। ‘পরিচয়’ পত্রিকার এক আড্ডায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের হাতে এ পত্রিকাটি দেখেছিলেন বুদ্ধদেব। তিনি এ পত্রিকাটির আদলেই কেবলমাত্র কবিতা নিয়ে বাংলায় সাহিত্যপত্র প্রকাশ করার চিন্তা করেন। এ চিন্তার বাস্তবায়ন ঘটে ক বছর পরেই। ১৯৩৫ সালে প্রথমবারের মতো ‘কবিতা’র প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সাহিত্যপত্রের নাম রাখেন ‘কবিতা’। শুধু নামই নয়, পোয়েট্রির সম্পাদকীয়ও নীতিও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বুদ্ধদেব দেখেছিলেন পোয়েট্রিতে কবিতা ও কবিতার সংক্রান্ত গদ্য প্রকাশিত হয়। ‘কবিতা’ সম্পাদনায় তিনি নির্দ্বিধায় এ নীতি গ্রহণ করেন। কবিতার প্রকাশ নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায়। সে বিজ্ঞাপনে ‘কবিতা’ প্রকাশের কারণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় : ‘কবিতাকে যথোচিত গৌরবে বিশেষভাবে ছেপে থাকে এমন সাময়িকপত্র বর্তমানে দেশে বেশি নেই। অথচ আধুনিক কবিদের অনেকেই নতুন কবিতা লিখছেন-বাইরের পাঠকমন্ডলী দূরে থাক, অনেক সময় নিজেদের মধ্যে সেগুলো দেখাশোনার সুবিধে হয় না। এই কারণে আমরা একটি ত্রৈমাসিক কবিতাপত্র বের করতে বাধ্য হচ্ছি। পত্রিকার নাম হবে ‘কবিতা’ এবং তাতে থাকবে শুধু-কবিতা।’ পত্রিকার নাম, সম্পাদকীয় নীতি ঠিক হলো। এখন প্রয়োজন প্রকাশনা। সে সময়ে পত্রিকা প্রকাশনা সহজ ছিল না। চাঁদার টাকায় ‘কবিতা’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত হলো। বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘প্রথম চাঁদাটা যে আমিই তুলেছিলাম সেটা ভুলিনি। ... চাঁদার হার পাঁচ টাকা। বুদ্ধদেব পাঁচ টাকা, প্রেমেন্দ্র মিত্র পাঁচ টাকা, মায়া মাসিমা পাঁচ টাকা, পনেরো টাকা তো উঠেই গেল। কী ফুর্তি সকলের। বাড়ি ভেসে গেল খুশির জোয়ারে।...শেষ পর্যন্ত পয়ত্রিশ টাকা চাঁদা উঠতেই শুরু হয়ে গেল কাজ।’ আরেকটি বিষয়ও বুদ্ধদেব বসুর জন্যে খুব আনন্দের ছিলো। ‘কবিতা’ পত্রিকাটির প্রারম্ভ সংখ্যাটি পুর্বাশা প্রেসের সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সত্যপ্রসন্ন দত্ত বিনামূল্যে ছেপে দিয়েছিলেন। কবিতার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালের ১ অক্টোবর। প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র। সহকারী সম্পাদক ছিলেন সমর সেন। কবিতার প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ করেন অনিল। প্রারম্ভ সংখ্যায় লিখেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, অজিতকুমার দত্ত, প্রণব রায়, স্মৃতিশেখর উপাধ্যায় ও হেমচন্দ্র বাগচী। ত্রৈমাসিক কবিতার প্রথম সংখ্যাটি ছিলো ৪০ পৃষ্ঠার; প্রতিসংখ্যার মূল্য ছিল ছয় আনা, বার্ষিক মূল্য ছিল দেড় টাকা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কবিতার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের দিনই বুদ্ধদেবের বড় মেয়ে মিমির জন্ম হয়। কবিতার প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের পরপরই এটি সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। যার ফলে প্রথম বছরেই এর গ্রাহক সংখ্যা ৭০ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। বুদ্ধদেব বসু সসংকোচে রবীন্দ্রনাথের কাছে ‘কবিতা’র প্রথম সংখ্যা পাঠিয়ে ছিলেন। তাঁর ভাষ্যে : ‘ঈষৎ ভয়ে-ভয়ে এক কপি পত্রিকা পাঠালাম রবীন্দ্রনাথকে, প্রার্থনা করলাম তাঁর একটি কবিতা।’ বুদ্ধদেব ভাবতেই পারেনি তাঁর জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল। বুদ্ধদেবের চিঠি পাওয়ার দুই-তিন দিনের মাথায় রবীন্দ্রনাথ জবাব দিয়েছিলেন। তিনি ‘কবিতা’ পড়েছিলেন এবং প্রকাশের জন্য দিয়েছিলেন ‘ছুটি’ কবিতাটিও। ‘কবিতা’র প্রথম সংখ্যা পড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘‘তোমাদের ‘কবিতা’ পত্রিকাটি পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। এর প্রায় প্রত্যেকটি রচনার মধ্যেই বৈশিষ্ট্য আছে। সাহিত্য-বারোয়ারি দল-বাঁধা লেখার মতো হয়নি। ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য নিয়ে পাঠকদের সঙ্গে এরা নূতন পরিচয় স্থাপন করেছে।” ‘কবিতা’ সাহিত্যপত্র হিসেবে নতুন হলেও শিল্পমানের কারণে রবীন্দ্রনাথ অকৃপণভাবে কাগজটির প্রশংসা করেছিলেন। কবিতার প্রথম সংখ্যাটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ আনন্দিত হয়েছিলেন-এটি তরুণ বুদ্ধদেব ও ‘কবিতা’র জন্যে ছিল অনেক বড় প্রাপ্তি। কবিতার আরও একটি বিশেষ প্রাপ্তি রয়েছে। টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্টে ‘কবিতা’র আলোচনা প্রকাশ হয়েছিল। আলোচক ছিলেন এ্যাডওয়ার্ড টমসন। এই বৈশি^ক আলোচনা বুদ্ধদেব বসুকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। কবিতার ২য় বর্ষে প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদনা থেকে দূরে সরে গেলে বুদ্ধদেব বসু একাই ‘কবিতা’ সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৬০ সালে কবিতা পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এর ১০৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ এ সাহিত্যপত্রের বিভিন্ন সংখ্যায় ৩৪৫ জন লেখক লিখেছিলেন। প্রকাশনার দীর্ঘ ২৫ বছর এ সাহিত্যপত্রটি বাঙালী সাহিত্যিক ও পাঠকের কাছে পরম মহার্ঘ ছিল। পরবর্তীতে ‘কবিতা’ এতই আরাধ্য ও বিশেষ পত্রিকায় রূপ নিয়েছিল যে, এখানে কবিতা প্রকাশ করা কবি স্বীকৃতির নামান্তর বলেই মনে করতেন তরুণ কবিবৃন্দ। এর কারণও ছিল। বুদ্ধদেব বসু লেখা নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রকাশনা পর্যন্ত দরদ দিয়ে ‘কবিতা’ সম্পাদনা করতেন। মানহীন লেখা তিনি ছাপাতে ইচ্ছুক ছিলেন না। ফলে আজও ‘কবিতা’র ঋণ বাঙালী লেখক মাত্রই স্বীকার করেন।
×