ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জোবায়ের আলী জুয়েল

মোনালিসার মায়াবী হাসি

প্রকাশিত: ০৯:১৮, ২১ জুন ২০১৯

মোনালিসার মায়াবী হাসি

কোন এক বিখ্যাত মনীষী বলেছিলেন, ‘হাসির দ্বারা পৃথিবীতে কোন বড় কাজ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু অশ্রুর প্রতীক তাজমহল’। তাঁর এই বাণী ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়াতেই লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার নানা ব্যঞ্জনায় ভূষিত অপূর্ব হাসির ব্যাখ্যা আজও শেষ হয়নি। মোনালিসার রহস্যময় হাসি আজও পৃথিবীর শত শত মানুষকে বিস্ময়াভূত ও অভিভূত করে তোলে। শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির এই অমর বিখ্যাত আঁকা ছবিতে পৃথিবীর অজ¯্র নারীর শাশ্বত রহস্যময়ী রূপের প্রতিফলন ঘটেছে। মানুষের হৃদয়ের অন্তর্নিহিত আশা-আকাক্সক্ষাকে মূর্ত করে তুলেছে। ১৪৫২ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নিয়েছিলেন এই ক্ষণজন্মা মহা প্রতিভাধর ব্যক্তি। পিয়োরো দ্য ভিঞ্চির নামে এক সম্ভ্রান্ত আর কাতেরিনা নামে এক গ্রাম্য ললনার অবৈধ প্রেমের ফসল হিসেবে পৃথিবীতে পা রেখেছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালির লিওনার্দো ভিঞ্চি ছিলেন একাধারে শিল্পী ও বিজ্ঞানী। তিনি বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য আজও পৃথিবীতে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানের আবিষ্কারক নয়, শিল্পীই তাকে অমর করে রেখেছে। তাঁর আঁকা মোনালিসা চিত্রটিই হয়ে উঠল পৃথিবীর ভুবন বিখ্যাত চিত্রগুলোর অন্যতম। ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়ামে রক্ষিত মোনালিসার ছবিটির জন্য যদিও মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত যে এটি আসল মোনালিসার ছবি, কিন্তু ইতিহাস বলে ডজনখানেক চমৎকার অবিকল মোনালিসার প্রতিকৃতির সন্ধান পাওয়া গেছে যার অনেক ছবি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ছাত্রদের দ্বারা অঙ্কিত। মোনালিসার মুখম-লের অভ্যন্তরীণ দীপ্তি যে, চিরকালীন প্রহেলিকার সৃষ্টি করেছে। সারা বিশ্বের সমগ্র মানুষের কাছে তা আজও আকর্ষণীয়। মোনালিসার রহস্যময় হাসি আর বিষণ্ণ ব্যাকগ্রাউন্ড একে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। মোনালিসার এই বিখ্যাত চিত্রটি পরবর্তীকালে হয়ে উঠল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অঙ্কিত প্রতিকৃত। মোনালিসা বলে এই পৃথিবীতে সত্যি কি কেউ ছিলেন? না কি শিল্পীর নিছক বিমূর্ত কল্পনা? এ নিয়ে এ যাবত বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বিতর্ক হয়েছে নানা পর্যায়ে। অবশ্যই সত্যিকার অর্থে মোনালিসা বলে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে একজন ছিলেন। ফ্লোরেন্স নিবাসী জনৈক বিত্তশালী ব্যবসায়ী ফ্রান্সেসকো গিও কোনডারের স্ত্রী ছিলেন ম্যাডোনা লিসা সংক্ষেপে মোনালিসা। তিনি যে অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন এ কথা ঠিক বলা চলে না। কিন্তু তার মুখাবয়বে এমন এক চমকপ্রদ প্রশান্তির আবেদন ছিল যা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে মুগ্ধ করেছিল। মোনালিসার জন্ম হয়েছিল এক নিম্নবিত্ত পরিবারে। ১৫০২ খিস্টাব্দের কোন এক সময় শিল্পী তার এই ছবিটির কাজ শুরু করেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মোনালিসার ছবি আঁকার সময় যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবস্থা করেছিলেন। বাজনার তালে তালে যখন মোনালিসা তার হাত দুটি কোলের ওপর রেখে আপন মনে নিবিষ্টচিত্তে মিষ্টি বাজনা শুনতেন তখন তার চোখ মুখে এক অপূর্ব অনির্বাচনীয় রহস্যময় হাসির আভা ফুটে উঠত আর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তন্ময় হয়ে ক্যানভাসে তুলি বুলিয়ে যেতেন। এই অপূর্ব হাসিটিকে ফুটিতে তুলতে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির প্রায় দীর্ঘ ৫ বছর সময় লেগেছিল। যখন মোনালিসা ছবির সামনে পোজ দেন তখন তার বয়স ছিল ২৫ বছর। সে সময় তিনি এক সন্তানের জননী ছিলেন। ছবিটি সমাপ্ত হওয়ার সময় মোনালিসার মুখমন্ডল আরও অনাবিল, শান্ত, স্নিগ্ধ ও প্রশস্ত হয়েছিল। এত কিছু পরিবর্তনের পরও তা মুখের রহস্যময় হাসিটি কিন্তু অবিকল ঠিক রয়ে গিয়েছিল। মোনালিসার হাসিকে আরও প্রাণবন্ত ও ব্যঞ্জনাময় করে তুলতে পটভূমিকায় শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তুলির পরশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কিছু টুকরো পাহাড়, বাঁকানো পথ আর নিলাভ সবুজ হালকা রঙের জলস্রোত। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যখন অন্যখানে ভয়াবহ যুদ্ধের দৃশ্য আঁকতে ব্যস্ত, তারই অবসরের ফাঁকে ফাঁকে স্টুডিওর নির্জন পরিবেশে পালিয়ে এসে কল্পনার রঙে তুলির আঁচড়ে ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তুলেছিলেন মোনালিসাকে। সে জন্যই সে সময় মোনালিসা তার কাছে শুধু একটা নিছক ছবি ছিল না। তার আনন্দ ঘন মুহূর্তের সঙ্গিনীও ছিল। তাই পরবর্তীতে কোনক্রমেই শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছবিটি হাতছাড়া করতে চাননি। কিন্তু পরে তিনি অসহায় ও নিরুপায় হয়েই অসম্পূর্ণ ছবিটি গিওকোনডারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ছবিটি অসম্পূর্ণ দেখেই সে সময় মোনালিসার স্বামী গিওকোনডার লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে ছবিটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তার পরে শিল্পী অসম্পূর্ণ ছবিটি আঁকার ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান ও তৎপর হয়ে ওঠেন। এমনকি সে সময়ে তিনি অন্য কোন ছবি আঁকার প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দীর্ঘ ৬ বছর তিনি ছবিটি আঁকা সমাপ্ত করেন। পরবর্তীতে এই ছবিটি ফ্রান্সের রাজা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে কিনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাট যখন জানতে পারেন যে, ছবির বিরহে শিল্পী অকৃতদার লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন তৎক্ষণাৎ তিনি শিল্পীকে ছবিটি আমৃত্যু রাখার জন্য অনুমতি প্রদান করেন। পরবর্তীতে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির প্রাণের সঙ্গিনী এই মোনালিসার চিত্রটি হয়ে উঠল বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অঙ্কিত চিত্র শিল্প। এ বিষয়ে ইতিহাসে উল্টো দিকও রয়েছে, মোনালিসা ছবিটিকে কেন্দ্র করে। কেউ কেউ সে সময় বলেছেন, মোনালিসা কোন মতেই গিওকোনডারের স্ত্রী নন। নিশ্চই তাহলে মোনালিসার অঙ্গে বিধবার পোশাক থাকত না। মোনালিসার অঙ্গে ছিল নিরাভরণ অতি সাধারণ। তিনি কি কোন মৃত আত্মার স্মরণে এই পোশাক পরিধান করেছিলেন? এখানেই শেষ নয়, মোনালিসার ছবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল সে সময় প্রণয় কাহিনী। ব্যর্থ প্রেমের ইতিহাস। কেউ কেউ বললেন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন প্রচন্ড নারীবিদ্বেষী। সে জন্যই তিনি আজীবন বিয়ে করেননি এবং তাঁর সৃষ্টির অধিকাংশ ছবিই পুরুষপ্রধান। অতএব মোনালিসা ছিলেন নারী ছদ্মবেশে একজন পুরুষ। মোনালিসার জীবনকথা আজও আমাদের সঠিক জানা নেই। এ ছাড়া এমন গুঞ্জন, রটনাও রয়েছে যে, আসল ছবিটি লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা নয়। কোন এক অজানা শিল্পী ছবিটি একে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন এবং এই প্রতিকৃতিটি হলো ফ্লোরেন্স নিবাসী গুই লিয়ানো লা মেডিসির প্রণয়িনীর। গুই লিয়ানো দ্য মেডিসি নববিবাহিত স্ত্রীর ভয়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির কাছে ছবিটি গচ্ছিত রেখেছিলেন। হত্যভাগ্য লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে কখন ভাবতে পারেননি যে, তার এই বিশ্বখ্যাত মোনালিসাই তাকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখবে চিরদিন। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে এই প্রতিভাধর শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মৃত্যুমুখে পতিত হন। মোনালিসা কোন বয়সে এবং কিভাবে মৃতু হয়েছিল তা অবশ্য জানা যায়নি এবং আজও রহস্যাবৃত্ত। কিন্তু আজও আমাদের আকৃষ্ট করে মোনালিসার ভুবন মোহন মায়াবী অবিনশ্বর হাসি।
×