ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহীনুর রেজা

নজরুল বিষয়ক গ্রন্থ আলোচনা

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২১ জুন ২০১৯

নজরুল বিষয়ক গ্রন্থ আলোচনা

বাংলা একাডেমির সূত্রমতে এবারের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪৮৩৪টি। এরমধ্যে মানসম্পন্ন বই হলো ১১৫১টি। তার মানে মানহীন বইয়ের সংখ্যাই বেশি। মানসম্পন্ন বই চার ভাগের এক ভাগেরও কম। টাকার অঙ্কে ২০১৯ সালে বিক্রি ৮০ কোটি, ২০১৮ সালে ৭০ কোটি এবং ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বছরকে বছর বাড়ছে টাকার অঙ্ক, সঙ্গে মানহীন বইও। টাকার অঙ্ক নিয়ে বাংলা একাডেমি ও লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে মতের হেরফের আছে, থাকতে পারে। কিন্তু দিনকে দিন যে মানহীন বইয়ের উর্ধগতি চলছে তা নিয়ে কারও মতভেদ নেই। এর বিভিন্ন কারণ থাকলেও একটি বিশেষ কারণ হলো- আমরা বইমেলাকে বই প্রকাশের মেলায় পরিণত করেছি। কিন্তু হওয়া উচিত ছিল বই বিক্রির মেলা। সারা বছর ধরে পান্ডুলিপি যাচাই-বাছাই করে আস্তে-ধীরে বই প্রকাশিত হবে, আর মেলাতে এসে সে বই বিক্রি হবে। তাহলে মান অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব। আমরা একটি মানসম্পন্ন বইয়ের গল্প বলতে বসেছি, বইয়ের নাম ‘নজরুল মানস’ লেখক- সন্জীদা খাতুন। সন্জীদা খাতুনকে আমরা জানি রবীন্দ্রচর্চার পথিকৃৎ হিসেবে। এটি সাহিত্যের পাঠে নিমগ্ন হওয়ার পরের কথা। কিন্তু স্কুল ফাইনালের পর তিনি টানা তিন বছর প্রথিতযশা নজরুল সঙ্গীতশিল্পী সোহরাব হোসেনের কাছে নজরুল সঙ্গীত শিখেছেন। নজরুলের সঙ্গে তাঁর বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। সেই হিসেবে নজরুল ছিলেন সন্জীদা খাতুনের পারিবারিক আত্মীয়। বইয়ের প্রাক্কথনের শুরুতেই তা ধরা পরে- ‘বড়দি যোবায়দা মির্জা নজরুল কাকার কোলে পিঠে উঠে আদর পেয়েছেন গান শিখেছেন, শৈশবে কাকার কোলে বসে আসরে গান গেয়েছেন। কাজেই গ্রন্থটি তাঁর নজরুলীয় চিন্তা চেতনায় ভরা থাকবে- এই স্বাভাবিক। ‘নজরুল মানস’ গ্রন্থের সূচীপত্র সাজানো হয়েছে এমনভাবে- সবার কবি নজরুল/পারিবারিক অভিজ্ঞতা, আবেগ উচ্ছ্বাসিত নজরুল, নজরুল সঙ্গীত, নজরুল কাব্যে আধুনিকতা: প্রেম ও নারী, রাক্ষসী, যুগ-সৃষ্টির বাণী, গদ্যরচনায় নজরুল-মানস, নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়, পত্রাবলীতে কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথম অধ্যায় ছোট, একেবারেই পরিবার কেন্দ্রিক। বাবা-মা’র প্রসঙ্গ, ফজিলাতুন্নেসা, রানু সোমের বিষয়-আশয়, পিতার সঙ্গে অসুস্থ নজরুলকে কলকাতায় প্রথম দেখতে যাওয়া এবং মৃত্যুকালীন শান্তিনিকেতনে বসে ঢাকা বেতারের বিবরণ- এসব স্থান পেয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা পাই নজরুলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিষয়। গান্ধীজী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় সখ্য, গুটিকয় কবিতার উদ্ধৃতি, রবীন্দ্রনাথকে নজরুলের হস্তলেখা পত্র। এ রচনাটিও ছোট। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের মনোমালিন্যের বিষয় এখানে চমৎকারভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। লেখক যে এক সময় নজরুলের সঙ্গীতচর্চা করেছেন তারই উপলব্ধি ধরা পরেছে ‘নজরুল সঙ্গীত’ অধ্যায়ে। এ রচনায় নজরুলের কয়েকটি গানের বাণী বিশ্লেষণ করা হয়েছে- যা মধুময়। যে কোন পাঠকের মন এতে বিগলিত হবে। ‘নজরুলের কাব্যে আধুনিকতা : প্রেম ও নারী’ অধ্যায়ে ‘সঞ্চিতা’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখাটি ১৯৬৮ সালের। বিস্ময় জাগায়। ‘রাক্ষুসী’ কাজী নজরুল ইসলামের ‘রিক্তের বেদন’ গল্প গ্রন্থের একটি গল্প। বাংলাদেশ টেলিভিশনে এর নাট্যরূপ দেখে, বিশেষ করে নায়িকার ভূমিকায় রওশন জামিলের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে লেখক এ গল্পের আদ্যোপান্ত লিখেছেন। বাগদীনারী বিন্দির আত্মউক্তি বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে এ লেখায়। যুগ-সৃষ্টির বাণী মূলত নজরুলের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ, সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত প্রন্থ ‘যুগবাণী’ নিয়ে আলোচনা। গদ্যরচনায় নজরুল-মানস’ লেখাটির সঙ্গে আমি পূর্বেই পরিচিত। লেখক নজরুলের প্রবন্ধ আর অভিভাষণগুলো পড়ে তাঁর চিন্তা এবং নিহিতবোধ অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন এ রচনায়। রচনাটি এ গ্রন্থের সর্ববৃহৎ রচনা। নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায়, মূলত সূফী জুলফিকার হায়দার রচিত বাংলা একাডেমির জীবনী সাহিত্য গ্রন্থমালার একটি বই। বইটি নিয়েই লেখক নয় পৃষ্ঠার একটি সমালোচনা লিখেছেন। কিন্তু প্রথম ও ষষ্ঠ পৃষ্ঠার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী মন্তব্য পাঠকদের তালগোল পাকিয়ে দেয়। প্রথম পৃষ্ঠার মন্তব্য- ‘এই রচনাটির বৈশিষ্ট্য এই যে আন্তরিকতার রসে সিক্ত করে লেখক নানা ঘটনা বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে যেসব মন্তব্য করেছেন তার সারবত্তা সম্বন্ধে চিন্তা জাগবার আগেই মন মজে যায়। দ্বিধাহীন চিত্তে বলা চলে গ্রন্থখানি অতিশয় সুখপাঠ্য হয়েছে। ষষ্ঠ পৃষ্ঠার মন্তব্য- ‘বিশেষ মনোযোগ করে পড়তে গেলে এ গ্রন্থে প্যাচালের প্রকোপ আগাগোড়াই বেশ অনুভব করা যায়। অভিযোগ আর অভিযোগ-। পাঠক কোনটি গ্রহণ করবে? পত্রাবলী অংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলীর মধ্যে ছয়টি চিঠির দুইবার মুদ্রিত হওয়ার প্রসঙ্গ লেখক ধরিয়ে দিয়েছেন। যেমন- ‘পত্রাবলীতে মোট অষ্টআশি সংখ্যক চিঠি ছাপা হলেও দেখা যাচ্ছে বিরাশি নম্বরের চিঠিটি বাহান্ন নম্বরে, তিরাশি নম্বরের চিঠি পঞ্চাশ নম্বরে, পঁচাশি নম্বর চিঠি ষাট নম্বরে, ছিয়াশি নম্বর চিঠি উনপঞ্চাশ নম্বরে, সাতাশি নম্বর চিঠি তেপ্পান্ন আর অষ্টআশি নম্বর চিঠিটি চুরাশি নম্বরে আগেই ছাপা হয়েছে। অর্থাৎ ছয়খানি চিঠি দুইবার মুদ্রিত হয়েছে। তাতে বাস্তবিক বিরাশিটি চিঠি পাওয়া যাচ্ছে পত্রাবলীতে। আশা করি লেখকের এই বিচক্ষণতার ফল বাংলা একাডেমির নজরুল রচনাবলীর পরবর্তী সংস্করণে খুঁজে পাব। নজরুলের ‘উপন্যাস প্রসঙ্গ’ বাদ দিলে লেখক সন্জীদা খাতুন তাঁর ’নজরুল মানস’ গ্রন্থে প্রায় সবকিছু তুলে ধরেছেন। তবে কিছু কিছু বানানের ভ্রান্তি বিশেষ করে গানের পঙ্ক্তির শব্দের ভ্রান্তি পাঠককে বিভ্রান্তিতে ফেলবে। যেমন- ১১ পৃষ্ঠায় ‘বোলো বঁধুয়ারে’ বানানটি হবে ‘ব’লো বঁধুয়ারে’, ১৬ পৃষ্ঠায় ‘দুর্দিনের’ বানান হবে ‘দুর্দিনের’, ২১ পৃষ্ঠায় শিরোনামে আছে ‘নজরুলসঙ্গীত’ কিন্তু নিচের লাইনেই আছে ‘কাব্যসঙ্গীত’ বানান, ২৮ পৃষ্ঠায় ‘ইনস্টিট্যুট’ লেখা হয় ‘ইনস্টিটিউট’ বানানে। সমগ্র বইয়ের মধ্যে বানান আছে ‘নজরুল-মানস’ কিন্তু প্রচ্ছদে আছে ‘নজরুল মানস’। আমরা আশা করব পরবর্তী সংস্করণে লেখক-প্রকাশক এসব ভ্রান্তি থেকে আমাদের মুক্তি দেবেন। এখন বিশ্বায়নের যুগ। এ রকম গ্রন্থের প্রচ্ছদে নজরুলের অবয়ব অবশ্যম্ভাবী। এ খেয়ালও লেখক- প্রকাশক রাখবেন। গ্রন্থটির বহুল পঠন কামনা করি। নজরুল মানস : সন্জীদা খাতুন, প্রকাশক : নবযুগ প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ : আশ্বিন ১৪২৫/অক্টোবর ২০১৮, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ, পৃষ্ঠা : ১১২, মূল্য : ২২০ টাকা। লেখক গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন প্রফেসর রফিকুল ইসলাম ও পরম স্নেহের জুব্লিকে।
×