ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

দশম সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং সরকারের জবাবদিহিতা

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ২১ জুন ২০১৯

দশম সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং সরকারের জবাবদিহিতা

বাংলাদেশের সংবিধানের ৭৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ কর্তৃক সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ২৩৩ ধারা অনুযায়ী এই কমিটি অনধিক ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। নবম ও দশম সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত এই কমিটির সংসদ কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করেছি। দশম সংসদের এই কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে ৩ জন সাবেক মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। একাদশ সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত কমিটির চেয়ারম্যান অনুরূপভাবে নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় পার্টির ডাঃ রুস্তম আলী ফরাজী। এই কমিটি সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী ১. সরকারের ব্যয় নির্বাহকল্পে সংসদ কর্তৃক মঞ্জুরিকৃত অর্থের নির্দিষ্টকরণ সংবলিত হিসাব, ২. সরকারের বার্ষিক আর্থিক হিসাব এবং ৩. কমিটি কর্তৃক সমীচীন বিবেচিত সংসদে উত্থাপিত অন্যান্য আর্থিক হিসাব পরীক্ষা এবং অনুরূপ পরীক্ষাকালে শনাক্তকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ সংসদে পেশ করার দায়িত্ব বহন করে। সংবিধানের (১২৭-১৩২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রককে প্রজাতন্ত্রের সব মন্ত্রণালয় এবং প্রতিষ্ঠানের হিসাব নিরীক্ষণের ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের নিরিখ ও প্রতিবেদনের আলোকে কার্যপ্রণালী বিধির ২৩৩ (২) ধারা অনুযায়ী এই কমিটি রাষ্ট্রের সব ব্যয়ের ১. আইনানুগ অনুমোদন বীক্ষণ, ২. আইনানুগ নিয়ন্ত্রণকারীর ক্ষমতা অনুগামী ব্যয়ন পরীক্ষণ, ৩. আর্থিক ব্যয়ের যথাবিধি বা প্রয়োজন অনুগামী পুনর্নির্দিষ্টকরণ, ৪. রাষ্ট্রীয় কর্পোরেশন ও সংস্থাসমূহের আয়-ব্যয়ের হিসাব, স্থিতিপত্র ও লাভ লোকসানের সমীক্ষণ এবং ৫. খাত বা লক্ষ্য বিশেষে সংসদ কর্তৃক মঞ্জুরিকৃত অর্থ অপেক্ষা অধিক অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিরূপণ বিষয়ে দায়িত্ব পালন করে। এসব ক্ষেত্রের হিসাব বিষয়ক সংশোধন, পরিবীক্ষণ ও নির্দিষ্টকরণের কাজ উপযোজন হিসেবে নামায়িত। উপযোজন বিষয়ক প্রাথমিক প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মুখ্য হিসাব কর্মকর্তা কর্তৃক তৈরি করণীয়। অতঃপর মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের পরিশীলনসহ এসব প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতি সরকারের বার্ষিক আর্থিক হিসাব অবয়বে সংসদের মাধ্যমে কমিটির কাছে উত্থাপনীয়। উপযোজন হিসেবে সংসদ কর্তৃক নির্দিষ্টকরণ প্রক্রিয়ায় বরাদ্দ অর্থের অতিরিক্ত বা বরাদ্দের বাইরে অনুমোদনবিহীন ব্যয়াদি উপযোজনের আওতায় সরকারী হিসাব সম্পর্কিত কমিটিতে অনুশাসন, নির্দেশ ও সুপারিশের জন্য আলোচনীয়। বলা প্রয়োজন এখন পর্যন্ত উপযোজন হিসাবাদি সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে নিয়মিতভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। এই অপারগতা দূর করার জন্য মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের তরফ থেকে সত্বর ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া ঈপ্সিত। এ সব ক্ষেত্রে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক যে নিরিখ প্রতিবেদন তৈরি ও উপস্থাপন করেন তার ভিত্তিতে সরকারী হিসাব কমিটি এই দায়িত্ব পালন করে থাকে। এর বাইরে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃক প্রজাতন্ত্রের অনুকূলে প্রাপ্ত যে কোন অর্থ, ভা-ার বা সম্ভার বিষয়ে নিরিখ প্রতিবেদন এই কমিটি পর্যালোচনা করে সরকার বা সংসদের কাছে যথা প্রয়োজন সমর্থন, সংশোধন বা অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করবে বলে অনুজ্ঞা দেয়া আছে। সমকালে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃক বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সরকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের ওপর কৃত নিরিখ প্রতিবেদনাদি এই কমিটির কাছে রাষ্ট্রপতি ও সংসদের মাধ্যমে উত্থাপিত হয়ে আসছে। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের লোকবল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে তিনি এক বছরে সকল সরকারী বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান সমূহের ১০% এর বেশী নিরীখ করতে সক্ষম নন। ক্ষেত্র ও সময় বিশেষে কমিটির অনুশাসন কিংবা স্বপ্রণোদনের ভিত্তিতে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক বিশেষ নিরিখ সম্পাদন করেন। এসব বিশেষায়িত নিরিখের বিকল্পে সময়ে সময়ে সম্পাদন নিরিখ সম্পন্ন করা হয়। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করার অক্ষমতা নিরিখের সংখ্যা ও উৎকর্ষ দুই-ই নিচে নামিয়ে রাখে। এসব নিরিখ প্রতিবেদনাদিও চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তিকরণের জন্য এই কমিটিতে উত্থাপিত হয়। তেমনি সরকারের আয় বিষয়ক কার্যক্রম, কর আরোপণ, প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক রাজস্ব আহরণ ও প্রশাসনের ওপর মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিরিখ সম্পাদন করে একই প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য কমিটির কাছে উত্থাপন করেন। বলা প্রয়োজন লোকবল স্বল্পতা এসব ক্ষেত্রেও নিরিখ সম্পন্নকরণ সীমিত করে রেখেছে। সংবিধানের ৭৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি ছাড়া প্রাক্কলন কমিটি এবং গণক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানবিষয়ক কমিটি, সরকারের আর্থিক কার্যাবলীর ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধানের লক্ষ্যও দায়িত্ব নিয়ে সংসদ কর্তৃক গঠিত। এ প্রেক্ষিতে এই তিনটি আর্থিক অবদর্শন বা তত্ত্বাবধায়ক কমিটিসমূহের মধ্যে লক্ষ্য ও কার্যাবলীর সমন্বয় থাকা ঈপ্সিত। এখন পর্যন্ত এরূপ কাজের ইপ্সিত সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়নি। ভারতে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত কমিটি রাজ্যসভার ৭ এবং লোকসভার ১৫ একুনে ২২ সদস্যসহ প্রতিষ্ঠিত। এই কমিটি ১ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। এই কমিটির চেয়ারম্যান স্পীকার কর্তৃক বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্য থেকে নিযুক্ত হন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ১৫ জন সদস্য নিয়ে ৫ বছর বা পুরো সংসদ কালের জন্য নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান সংসদ কর্তৃক সরকারী দলের নেতার মনোনয়ন অনুযায়ী নির্বাচিত হন। ভারত ও বাংলাদেশের সংসদীয় হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বিদিত কার্যাবলী প্রায় একই প্রকার। অবশ্য ভারতে গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতি ১৯৫২ থেকে প্রচলিত ও অনুসৃত থাকায় সেখানকার সংসদীয় হিসাব কমিটির মর্যাদা ও তাৎপর্য অনেক বেশি বিস্তৃত। বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে সংসদীয় হিসাব কমিটি বিস্তৃত, গভীরতর ও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে আসছে বলে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য এর আগের বছরগুলোর তুলনায় অধিকতর দীপ্তিমান হয়ে এসেছে। ভারতে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত কমিটি বিশেষ এলাকা ও অধিক্ষেত্রের বিষয়ে নিবিড় পর্যালোচনা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সরেজমিনে তদন্ত করার রীতি ও প্রথা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে এই রীতি ও প্রথা এখনও সৃষ্টি করা যায়নি। অবশ্য বলা প্রয়োজন বাংলাদেশে সংবিধান কিংবা সংশ্লিষ্ট আইন বা বিধানাবলীতে এই ধরনের বিশেষ পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধান বা সরেজমিন তদন্ত করার প্রতিকূলে কোন বিধান বা অনুজ্ঞা দেয়া নেই। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের পরবর্তী স্বৈরশাসনের সময় ১৯৯৬ পর্যন্ত দেশে সংসদীয় জবাবদিহিত্ব অপূর্ণাঙ্গ ও বাধাগ্রস্ত ছিল। এই সময়ে সরকারী আয় ব্যয়ের ওপর সংসদীয় হিসাব কমিটি ফলপ্রসূ তত্ত্বাবধানমূলক ভূমিকা রাখতে পারেনি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার সংসদ নেতৃত্বকালীন সময়ে সরকারের জবাবদিহিত্ব প্রতিষ্ঠিত ও প্রসারিত করার লক্ষ্যে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি জোরদার করা হয়। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সংসদ নেতৃত্বকালীন সময়ে আবারও এই কমিটি প্রায় অপ্রাসঙ্গিক ও অবহেলিত ভূমিকায় পর্যবশিত ছিল। ২০০৯ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার সমর্থন নিয়ে এই সংসদীয় কমিটি তৎপরতার সঙ্গে সংসদীয় সরকারের জবাবদিহিত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সুসংহতভাবে কাজ করে আসছে। দশম জাতীয় সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি মোট ১০৮টি বৈঠক অনুষ্ঠিত করে। প্রতিমাসের হিসাবে এই কমিটির বৈঠক সংখ্যা পূর্বের কমিটির তুলনায় প্রায় ২টিতে উন্নীত হয়। দশম সংসদের অন্যান্য সংসদীয় কমিটির বৈঠক সংখ্যার তুলনায় এই কমিটির বৈঠক সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রতিমাসে গড়ে প্রায় দুটি বৈঠক করে এই কমিটি ১৯৭৫ থেকে সংসদে পেশ করা ও জমে থাকা মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের প্রতিবেদনাদির অনিষ্পন্নতার জট দূর করতে সক্ষম হয়। এই সক্ষমতা সংসদীয় পর্যায়ে সরকারী আয় ব্যয় বিষয়ক নিরিখ প্রক্রিয়া প্রায় সমকালীন পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এই কমিটির সযত্ন বিবেচনায় এসব প্রতিবেদন সমকালীন পর্যায়ে বিবেচিত ও নিষ্পত্তি না হলে আর্থিক ক্ষেত্রে সংসদীয় জবাবদিহিত্ব কার্যক্ষম থাকে না। এর চেয়ে বড় কথা, সরকারী আয় ব্যয়ের সমকালীন নিরিখ ও তার ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার প্রক্রিয়ায় সরকারী হিসাব সম্পর্কিত কমিটি বার্ষিক বাজেট চক্রের পূর্ণায়ন ও তার মাধ্যমে সরকারের সব আয়ন ও ব্যয়ন প্রক্রিয়ায় সংবিধান অনুযায়ী অবদর্শন বা পরিবীক্ষণের দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গ ও নিশ্চিতভাবে পালন করতে সমর্থ হয়েছে বলা চলে। দশম সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত কমিটি ১০৮টি বৈঠকে সরকারের ২৮টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের ওপর মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃক রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সংসদে উপস্থাপিত ৮১টি নিরিখ প্রতিবেদন আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়। এই প্রক্রিয়ায় কমিটি এর আগে আলোচিত মোট ৩০২টি নিরিখ প্রতিবেদনের উপরে প্রদত্ত কমিটির সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের অগ্রগতিও পর্যালোচনা করে। এসব পর্যালোচনায় কমিটির সিদ্ধান্তসমূহ সরকারের সংশ্লিষ্ট নিরিখ ও নির্বাহী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নের গতি অধিকতর ত্বরান্বিত করার ওপর জোর দেয়া হয়। কমিটির কার্যক্রম, মোটা দাগে, সরকারের সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের ওপর সংসদের তরফ থেকে ঈপ্সিত আর্থিক শৃঙ্খলা আরোপণ ও বিস্তারন করতে সক্ষম হয়। উপরোক্ত ১০৮টি বৈঠকে মোট ১৭৭৬টি নিরিখ আপত্তি পর্যালোচনা করা হয়। এসব আপত্তিসমূহের মধ্যে ১৪৯টি আপত্তি আলোচনাক্রমে নিষ্পত্তি করা হয় এবং অবশিষ্ট ৩৪১টির ক্ষেত্রে তদন্তকরণ, বিভাগীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক অনিয়ম বা অভিযোগ খতিয়ে দেখা এবং আর্থিক অনিয়ম ও আত্মসাতের ক্ষেত্রে দায়েরকৃত মামলাসমূহের পরিবীক্ষণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। উপরোক্ত ১৭৭৬টি আপত্তি সংশ্লিষ্ট মোট ১৫১১০ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বিপরীতে, ৪১২৩ কোটি ৫১ লাখ টাকার আপত্তি নিষ্পত্তি এবং ১৩১৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আদায় করে সরকারী কোষাগারে জমা দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় ১৩১১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা আদায়ের লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ বা সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেয়া, ৪৯০৪ কোটি টাকা আদায়করণের লক্ষ্যে অধিকতর তদন্তকরণ বা বিভাগীয় পদক্ষেপের বা দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দায়েরকরণের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এর বাইরে ১৮৫০ কোটি ৯১ লাখ টাকা আদায়করণের প্রমাণক এবং অন্যান্য আপত্তিতে জড়িত ২৪৪০ কোটি ৮ লাখ টাকা আদায় বা সমন্বিত করণের ওপর সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়। এ সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপসমূহ কমিটি কর্তৃক সংসদীয় কার্যপ্রণালী বিধির ২১৬ বিধি অনুযায়ী ২৩টি প্রতিবেদনে সংসদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। সংসদীয় অন্য কোন কমিটি কর্তৃক এই সময়ে এত সংখ্যক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়নি। এসব প্রতিবেদনে উল্লিখিত ও সুপারিশকৃত কার্যক্রমের বিপরীতে সংসদ ভিন্নতর কোন সিদ্ধান্ত বা অনুশাসন দেয়নি। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রে কমিটির এসব সিদ্ধান্ত সংসদের সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হয়ে সংশ্লিষ্ট সব সরকারী বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানসমূহে সেসব বাস্তবায়নের দায়িত্ব অর্পিত করে। দশম সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এসব কার্যাবলী ও তৎপরতা অন্যান্য দেশের সংসদ ও আর্থিক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনার গণতান্ত্রিকতা ও বলিষ্ঠ সংসদীয় কার্যক্রমের অনুকূলে অকুণ্ঠ সমর্থন আগের সংসদসমূহের আপেক্ষিকতায় ইতিবাচক ফল দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক, যুক্তরাজ্য ও কানাডীয় আন্তর্জাতিক সদস্য সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ এই কমিটির কার্যাবলী পর্যালোচনা করে একে আগের সংসদীয় হিসাব কমিটির তুলনায় অধিকতর সফল ও বলিষ্ঠ কমিটি হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলত ১০ম সংসদের সরকারী হিসাব কমিটি সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ভারত, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত দেশসমূহের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সমূহের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সমর্থন নিয়ে পরিচালিত বিশ্ব সংসদীয় নেটওয়ার্ক দশম সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কার্যাবলীর দিকে যথার্থ দৃষ্টি ও স্বীকৃতি দিয়েছে। লোকবলের স্বল্পতা সত্ত্বেও মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক দশম সংসদের এই সংসদীয় কমিটির কার্যকালে দায়িত্বশীল ও সংবেদনময় ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মাসুদ আহমদের ভূমিকা সপ্রশংসভাবে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে বলা চলে। এসব কৃতবিদ্য প্রদর্শন ও স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও অর্পিত দায়িত্ব পালন ও সম্পাদনক্রমে অভিজ্ঞতার আলোকে দশম জাতীয় সংসদের সরকারী হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি কতিপয় ক্ষেত্রে সংসদীয় জবাবদিহিত্ব প্রসারণকল্পে কয়েকটি পদক্ষেপের প্রয়োজন তুলে ধরতে পারে- ১. কমিটি এখনও সংসদের কার্যপ্রণালীর ২৩৩ বিধি অনুযায়ী সরকারের উপযোজন বিষয়ে যথাযথ পর্যালোচনা করতে সমর্থ হয়নি। বস্তুত ১৯৭২ সালে থেকেই উপযোজন বিষয়ক পর্যালোচনা প্রধানত মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের তরফ হতে মূলত লোকবল স্বল্পতার কারণে এক্ষেত্রে পর্যালোচনীয় প্রতিবেদন প্রস্তুত না করার জন্য হাতে নেয়া ও সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতন দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন, ২. কমিটির পর্যালোচনায় এখন পর্যন্ত মূলত সরকারের ব্যয়-সম্পর্কিত প্রতিবেদন তথা আর্থিক নিরিখ প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। ব্যয়-সম্পর্কিত নিরিখের পরিসর বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে সরকারের আয়-সম্পর্কিত নিরিখ প্রতিবেদন কমিটি কর্তৃক যথাযথভাবে পর্যালোচনা করা কর্মানুগ হবে। বিশেষত সরকারের ঋণগ্রহণ ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত নিরিখ এবং কর্মসম্পাদন বিষয়ক পর্যালোচনা সাম্প্রতিককালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের দাবিদার হয়ে উঠেছে। এদিকে এখন পর্যন্ত মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারী হিসাব-সম্পর্কিত কমিটি যথা ঈপ্সিত মনোযোগ দিয়েছে বলা চলে না, ৩. মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দফতরকে লোকবল ও অনুষঙ্গ দিয়ে এবং একটি সুনির্দিষ্ট নিরিখ আইন বা অডিট এ্যাক্টের ভিত্তিতে অধিকতর শক্তিশালী ও কর্মক্ষম করা প্রয়োজন। কমিটির সমকালীন আলোচনায় স্থান পাওয়া নিরিখ প্রতিবেদনাদির গুণগত উৎকর্ষ বাড়ানোর পরিধি যথেষ্ট বিস্তৃত বলে সদস্য ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা। একটি নিরিখ আইনের খসড়া এই সংসদীয় কমিটির সমর্থনসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ে নবম সংসদকালীন সময়ে জমা দেয়া হয়েছে। ৪. কমিটিকে গবেষণা ও বিশ্লেষণভিত্তিক সহায়তা দেয়ার জন্য যথাযোগ্য গবেষক ও বিশ্লেষককে আকর্ষিত করা সময়ের প্রেক্ষিতে অতীব প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বা ভারতীয় লোকসভায় লভ্য বিষয় জ্ঞানভিত্তিক এই ধরনের গবেষণা ও বিশ্লেষণ করার পৃথক সার্ভিস কিংবা চাকরি কাঠামো সৃষ্টি করা বিধেয় বলে মনে হচ্ছে, ৫. সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি যথাযথভাবে সংশোধন করে সংসদীয় সরকারী হিসাব কমিটির বৈঠক জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এবং কমিটির বৈঠকে সব অভ্যাগত ব্যক্তির উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। অধিকন্তু সংবিধানের ৭৬ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সংসদ কমিটিকে সাক্ষীগণের হাজিরা বলবৎ করবার এবং শপথ, ঘোষণা বা অন্যকোন উপায়ের অধীনে সাক্ষ্যগ্রহণ কিংবা দলিলপত্র দাখিল করতে বাধ্য করবার ক্ষমতা সংবলিত আইন প্রণয়ন করেনি। কমিটির উন্মুক্ত বৈঠক জনগণের কাছে জনপ্রতিনিধিসহ সব নির্বাহীর জবাবদিহিত্ব জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন বিশেষভাবে সহায়ক হবে। এসব প্রয়োজন যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে মেটানোর মাধ্যমে সরকারী হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে অধিকতর কর্মক্ষম ও শক্তিশালী করে রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃপক্ষের আয় আহরণ ও ব্যয়ন বিষয়ক সব কার্যক্রমের ওপর সংসদীয় তত্ত্বাবধান ও জবাবদিহিত্ব বিস্তৃত করা বিধেয় হবে। লেখক : সংসদ সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী
×