ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ ॥ ২১ জুন, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ২১ জুন ২০১৯

 অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ ॥ ২১ জুন, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২১ জুন দিনটি ছিল সোমবার। এইদিন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, আমাদের এ সংগ্রাম সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। বাঙালীর এই অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে প্রণীত হয়েছিল ৬-দফা কর্মসূচী। এই ৬-দফাই আমাদের মুক্তির একমাত্র সনদ। মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার বিজয়পুর ব্রিজের উপর পাকসেনাদের দুটি গাড়িকে এ্যামবুশ করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচ- গুলি বিনিময় ঘটে। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর আটজন সৈন্য নিহত হয় ও গাড়ি দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। ফেনী-নোয়াখালী সড়কে বোগাদিয়া নামক স্থানে নোয়াখালী গেরিলা হেডকোয়ার্টারের একদল যোদ্ধা পাকবাহিনীর দুটি ট্রাককে এ্যামবুশ করে। এ এ্যামবুশে পাকবাহিনীর ট্রাক দুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং ১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। নোয়াখালী-ফেনী সড়কে মুক্তিযোদ্ধারা বজরা নামক স্থানে পাক সেনাদের একটি টহলদার দলকে এ্যামবুশ করে। এতে দু’জন পাকসেনা নিহত ও দু’জন আহত হয়। আখাউড়া-সিলেট রেলপথে তেলিয়াপাড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর মনতলা অবস্থানে পাক হানাদার বাহিনী বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। ক্যাপ্টেন নাসিমের অবস্থানের ওপর দুই ব্যাটালিয়ন, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুঁইয়ার অবস্থানের ওপর পশ্চিম দিকে চান্দুরা থেকে এক ব্যাটালিয়ন ও লে. মোরশেদের অবস্থানের ওপর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মুকুন্দপুর থেকে এক ব্যাটালিয়ন পাকসেনা আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে পিছু হটে। ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে ঘাতকদের বর্বরতার প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাস বলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণহত্যার নীতি অনুসরণ করে চলছে।’ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী চিপ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে ঢাকা আসেন। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজম লাহোরে জামায়াত কর্মীদের এক সভায় বলেন, দেশকে খন্ড-বিখন্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া আর কোন বিকল্প ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বলেন, বে-আইনী আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক গোলযোগ ১৮৫৭ সালে সংঘটিত বাংলার বিদ্রোহ-আন্দোলনের চেয়ে ১০ গুণ শক্তিশালী ছিল। বাংলাদেশে সফররত চার সদস্য ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলের সদস্য জিল নাইট বলেন, ‘ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকায় প্রতিনিয়ত পাকিস্তানের অত্যাচারের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু সেখানে এ ধরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি। বাংলাদেশের প্রশ্নে যে কোন শীর্ষ সম্মেলনের আগে অবশ্যই হত্যাকান্ড এবং নির্যাতন বন্ধ করতে হবে বলে সাংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা। নিউজউইক, ঘৃণ্য হত্যাকান্ড, বসবাসের জন্য শ্রেয়তর স্থান’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহ থেকে ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্রোতের মতো শরণার্থীদের আগমন স্তিমিত হয়ে আসতে শুরু করেছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা কলেরা মহামারীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছিল তা এখনও চলছে। ৫০০০-এর ও বেশি শরণার্থী ইতোমধ্যেই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে; মহামারীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে, কবর খোদকরা এতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে তারা আর কাজ করতে পারছিল না, এবং হিন্দু ধর্মের প্রথানুযায়ী শবদেহ দাহ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের সরবরাহ পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছিল। যদিও ভাড়া করা বিমানে করে প্রতিদিনই খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ঔষধ আসছে, তারপরও ভারত এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ শরণার্থীর পরিচর্যা করার জন্য যে ২০ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক সাহায্য প্রয়োজন তার দশ ভাগের এক ভাগ হয়তো পেয়েছে। ‘যে পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করা হয়েছিল’, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে গত সপ্তাহে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন সংসদকে বলেন, তা এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যা হয়ে উঠেছে। নিউজউইকের টনি ক্লিফটন গত সপ্তাহে তারবার্তায় জানান। আক্ষরিক অর্থে জীবন, তাদের শরীরে পুনরায় প্রবেশ করিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং আপনি চাক্ষুষ করবেন যে বোতল যতই খালি হতে থাকে ততই তারা ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে পেতে থাকে। আমরা আমাদের এ্যাম্বুলেন্সগুলোকে বাইরে পাঠাই রাস্তা থেকে রোগীদের তুলে আনতে’, ব্যাখ্যা করেন সিস্টার ইমাকুলেট, হৃষ্টপুষ্ট, ত্রিশোর্ধ চিকিৎসক যিনি এই হাসপাতালটি পরিচালনা করেন। এদের কেউ কেউ কাদা এবং বৃষ্টিতে পড়ে ছিল এবং সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত অবস্থায়। তারপরেও যদি না তারা আক্ষরিক অর্থে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহলে ওদের বেশিরভাগকেই আমরা সুস্থ করে তুলতে পারি। হয়তো ভারতের এই চলমান দুর্দশার কথা চিন্তা করেই, পাকিস্তানের সরকার শরণার্থীদের তাদের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তাদের সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব, খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা সেবা এবং তাদের আগের বসতবাড়ি পর্যন্ত পরিবহনসহ পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। গত সপ্তাহের আনুমানিক এক হিসাব অনুযায়ী, কয়েক হাজার বাঙালী ইতোমধ্যেই সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছে এই প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত, ৫ লাখ গৃহহীন মানুষের বেশিরভাগ মনে করছে বলে মনে হয় যে, এত সমস্যা থাকার পরেও, এই মুহূর্তে ভারত বসবাসের জন্য শ্রেয়তর স্থান। টাইম ম্যাগাজিন ’বাঙালী শরণার্থী : দুঃখের শেষ নেই’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে, একটি ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একটি গৃহযুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে প্রায় আরও ২ লাখের বেশি। দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়েছে এবং আরও বাড়ছে। কলেরা শুরু হবার আগেই কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৫ হাজার জীবন। একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিপর্যয়ের তালিকা আস্তে আস্তে আরও বড় হবে। গত সপ্তাহে নতুন করে প্রতিদিন প্রায় ১ লাখের মত উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করছে এবং তাদের মুখে মুখে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও ভারতের পাঁচটি প্রদেশের সীমান্তে ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর চাপে শরণার্থী শিবিরগুলোতে দুর্গন্ধ এবং দুর্ভিক্ষ ও অন্যান্য মহামারীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শরণার্থীদের ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হয় মার্চে যখন পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে ধ্বংস করে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যখনই পাকিস্তানী দুঃসাহসী পাঠান ও পাঞ্জাবি বাহিনীর সঙ্গে বাঙালী মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয় তখনই প্রায় ১৫ লাখ পূর্ব পাকিস্তানী-হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে দেশ ছেড়ে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, অসম, মেঘালয় ও বিহার প্রদেশে আশ্রয় নেয়। পালিয়ে যাওয়া মানুষের বেশিই হিন্দু এবং তারা অত্যাচার, ধর্ষণ ও বেপরোয়া হত্যাকা-ের কাহিনী বর্ণনা করছে। নতুন শরণার্থীদের মতে পাকিস্তান সরকার সদ্য অবৈধ ঘোষিত হওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পাকিস্তানের ১ কোটি হিন্দুদের দোষারোপ করছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে গৃহবন্দী থাকা মুজিবকে সত্যিকার অর্থেই হিন্দুরা অন্ধসমর্থন দেয়। যা মুসলিমরাও দেয়, যার ফলেই গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের ১৬৭টি তে জয়লাভ করেছিল। কিন্তু হিন্দুরা সংখ্যালঘু হওয়ায় আক্রমণের তুলনামূলক সহজতর লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে মেরে ফেলা হচ্ছে অগণিত মানুষকে। দূষিত খাবার পানি, পরিচ্ছন্নতার অভাব ও লাখ লাখ শরণার্থীদের সবাইকে কর্তৃপক্ষ টিকা দিতে না পারায় কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। কলেরা ভারত ও পাকিস্তানে খুবই পরিচিত একটি ব্যাকটেরিয়া-জনিত রোগ যা মারাত্মক বমি ও ডায়রিয়া ঘটায় যার ফলে দেহে পানি শূন্যতা হয় ফল প্রাণহানি। আক্রান্তদের ইনজেকশনের মাধ্যমে বা পানীয় হিসেবে প্রচুর পরিমাণে লবণের দ্রবণ, স্যালাইন ও গ্লুকোজ খাওয়ানো গেলে বাঁচানো সম্ভব। জনাকীর্ণ হাসপাতালগুলোতে অসুস্থ ও মৃতপ্রায় রোগীদের একসঙ্গে জড়ো করে রাখা হয়েছে এবং হাসপাতালের কাজের চাপে জর্জরিত স্টাফরা সময় বের করে মৃতদেহ সরিয়ে নেবার আগ পর্যন্ত মৃতদের জীবিতদের সঙ্গে রাখা হয়। যদিও ভারত সাময়িক সময়ের জন্য শরণার্থীদের রাখতে আপত্তি করেনি এবং তাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তাদের সাহায্য করার জন্য কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এই দরিদ্র মানুষের এই ক্রমবর্ধমান ঢলকে শুধুই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগ হিসেবেই দেখছে। শরণার্থী সমস্যাটা ভারতকে আগস্ট ১৯৪৭ এ উপমহাদেশ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হবার পর থেকেই পীড়া দিয়ে যাচ্ছে। উত্তর ভারতে বিনিময়টা প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ, ৬০ লাখ মুসলিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে এবং প্রায় ৬৫ লাখ হিন্দু শিখ ভারতে প্রবেশ করছে। দেশ ভাগের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ৪৩ লাখ হিন্দু ভারতে পালিয়ে গেছে, বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গে। এসব সমস্যার মুখোমুখি হয়ে ভারত সরকার শরণার্থীদের ‘উদ্বাস্তু’ বা ‘পলায়নকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে এবং আশা করছে’ নিজেরাই গরিব রাষ্ট্র হওয়ায়’ তারা একসময় তাদের নিজেদের দেশে ফিরে যাবে। পূর্ব ভারতের এক শরণার্থী শিবিরে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, ‘আমরা চাইলেও আপনাদের সারাজীবন এখানে রাখতে পারব না।’ পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সম্ভাব্য গেরিলা যুদ্ধের মুখে তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া নিকট ভবিষ্যতে সম্ভব না। দুর্ভিক্ষ আঘাত হানার সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। সম্প্রতি হেলসিঙ্কিতে বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদক ম-লীর এক বৈঠকে বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী সামরিক তৎপরতার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর হত্যা, ধ্বংস ও লুণ্ঠন বন্ধ করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি বৈঠকে আহ্বান জানানো হয়। বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকম-লী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যান্য রাষ্ট্রবর্গের প্রতি এই মর্মে দাবী জানান যে, তারা যেন পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য দান একেবারে বন্ধ করে দেন। বাংলাদেশের শরণার্থী প্রসঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে এক আবেদনে বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকম-লী বলেন, যারা মানবিকতার নীতিকে অস্বীকার করে, যারা মানবতাকে হত্যা করে- বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র, সভ্যতা ও মানবতাকে একসঙ্গে খুন করেছে তাদের ক্ষমা নেই। বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকম-লী বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘শান্তি ও মানবতার প্রতি আজও যারা শ্রদ্ধাশীল তাদের প্রত্যেকেরই উচিত পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের কাছে এমন অনুকূল অবস্থা সৃষ্টির দাবি করা, যাতে বাংলাদেশের শরণার্থীরা তাদের স্বদেশে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবন বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকম-লী পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে জনগণ কর্তৃক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করেছেন। বিশ্বশান্তি সংসদের সম্পাদকম-লীর বৈঠকে বাংলাদেশের সংগ্রামকে সাহায্য করার ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিশ্বের সকল শান্তি সংস্থার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বানের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বহু দেশ থেকে বহু মানবদরদী ও শান্তি সংস্থা সেক্রেটারি জেনারেল উত্থান্টের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। এসব তারবার্তায় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলী যেহেতু ‘মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক অধ্যায় সেই কারণেই বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে আলোচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। অথচ কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ইয়াহিয়া সরকার তার বেতার, টেলিভিশন ও কূটনৈতিক মিশনসমূহের মাধ্যমে এই ঘটনাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে প্রচার করছিল। বাংলাদেশে তাদের সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যাকে তারা বাঙালী-অবাঙালীর মধ্যে সংঘর্ষ ও কতিপয় দুষ্কৃতকারীর কার্যকলাপ বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সে অপকীর্তি বিশ্ববিবেকের চোখে এখন পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছে। জানি না ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার এই কেলেঙ্কারির পর আবার কোন কাহিনীর আশ্রয় নেবেন- তবে সত্য ঢাকতে গিয়ে, অপরাধ গোপন করতে গিয়ে তারা যে কৌশলই অবলম্বন করুন না কেন পরিণতি তাদের একই হবে। দৈনিক স্টেটসম্যান ইউএনআই এবং পিটিআই-এর বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন, যে কোন সম্মেলনের আগে পূর্ববাংলায় গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। পূর্ববাংলায় ঘটিত সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ফলশ্রুতিতে সেখান থেকে প্রচুর শরণার্থীর অনুপ্রবেশ এর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি বলেন, তাদের চিরদিন এভাবে ভারতে রেখে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানানো হয়েছে যে সেখানকার পরিস্থিতি বিপদসঙ্কুল ও উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে ভারত তার ওপর নজর রাখছে। এই মুহূর্তে এই সমস্যার কোন সমাধান তার কাছে নেই। ভারতের পরিকল্পনা কি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ভারতের আবেদনে সাড়া দিতে যদি পাকিস্তান ব্যর্থ হয় তাহলে পরিস্থিতি দেখব তারপরে প্রেসকে জানাব। এই দিন ভারতের দৈনিক যুগান্তর প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রামের বরাত দিয়ে লিখেন, আজ সেনাবাহিনীর অফিসার ও জওয়ানদের বলেছেন, পাকিস্তানীদের বেপরোয়া কাজের ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হোক তার মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন যে, পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলে ভারতের সীমান্ত লঙ্ঘন করছে। ‘আমরা শান্তিকামী, যুদ্ধ চাই না। কিন্তু আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার মতো পরিস্থিতিই পাকিস্তান সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের লোকদের ভারত আসতে বাধ্য করে পাকিস্তান ‘দূরভিসন্ধিমূলক আগ্রাসন’ ঘটিয়ে যাচ্ছে। এর পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য। ভারতীয় সৈন্যরা যে কোন আগ্রাসন মোকাবিলায় পূর্বাপেক্ষা ভালভাবে প্রস্তুত। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×