ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিবচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিজেই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ২১ জুন ২০১৯

শিবচর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিজেই  দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত

নিজস্ব সংবাদদাতা, মাদারীপুর, ২০ জুন ॥ জরুরী বিভাগে চিকিৎসক থাকেন না, অফিস চলাকালীন বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিকে গিয়ে রোগী দেখেন চিকিৎসকরা, হাসপাতাল থেকে ওষুধ সরবরাহ না করা, ভর্তি রোগীদের জন্য নিম্নমানের খাবার, সেবাবঞ্চিত হয়ে হাসপাতাল থেকে রোগী ফিরে যাওয়া, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ডাক্তারদের অসদাচরণ এমন নানা অভিযোগ ও অনিয়মের কারণে শিবচর উপজেলার একমাত্র সরকারী চিকিৎসা কেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিজেই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত। এ অবস্থায় তার চিকিৎসা করবে কে? এমন প্রশ্ন ভুক্তভোগীদের। হাসপাতালের এ দুর্দশা দেখে জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী এমপি নিজেও ক্ষুব্ধ। জানা গেছে, শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক থাকলেও তাদের অবহেলায় ভেঙ্গে পড়েছে চিকিৎসাসেবা। এ উপজেলার প্রায় সাড়ে চার লাখসহ পার্শ্ববর্তী জাজিরা ও মাদারীপুর সদর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের লোকজন এ হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। এখানকার এক্স-রে মেশিন, ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন দীর্ঘদিন ধরে অকেজো। এতে কারো মাথাব্যথা নেই। বাইরে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বাধ্য হন রোগীরা। বাইরের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের সঙ্গে আরও কথা বলে জানা যায়, হাসপাতাল থেকে ওষুধ সরবরাহের কথা ব্যবস্থাপত্রে থাকা সত্ত্বেও রোগীদের কোন ওষুধ সরবরাহ করা হয় না। কর্তব্যরত নার্স ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের যোগসাজশে রোগীদের দিয়ে কৌশলে ওষুধ ক্রয় করানো হয়। আন্তঃবিভাগের বরাদ্দকৃত ওষুধ রোগীদের নামে থাকলেও ওষুধ কোথায় যায় তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। জরুরী বিভাগে সার্বক্ষণিক সেবা দেয়ার কথা থাকলেও জরুরী বিভাগে চিকিৎসক থাকেন না বলে অভিযোগ চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের। ব্রাদার বা চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাই জরুরী বিভাগে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। আর কর্তব্যরত ডাক্তার থাকেন বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ও প্রাইভেট হসপিটালে। জরুরী বিভাগে গুরুতর রোগী এলে ফোন দিয়ে ডাক্তারদের ডেকে আনেন কর্মচারীরা। হাসপাতাল চলাকালীন জরুরী বিভাগের চিকিৎসকদের বাইরের চেম্বারে রোগী দেখার বিষয়টি এখন সকলের জানা। খোদ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এম এ মোকাদ্দেসের বিরুদ্ধে দায়িত্বরত অবস্থায় হাসপাতালের বাইরে গিয়ে রোগী দেখা ও সিজার করার বিস্তর অভিযোগ। হাসপাতাল কর্মচারীদের কেউ কেউ বেনামে ফার্মেসি ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। রোগী এলে ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে তাদের সেখানে যেতে বলা হয়। আবার কখনও দালাল নিয়োগ করে ডাক্তাররাই তাদের পছন্দমতো ক্লিনিকে রোগী নিয়ে যান। নিম্নমানের খাবার পরিবেশনের কারণে বেশিরভাগ ভর্তি রোগীরা বাইরে থেকে খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে। হাসপাতালের রোগ নির্ণয় যন্ত্রপাতির প্রায় সবক’টিই অকেজো। অপারেটর ও টেকনোলজিস্ট নেই। রোগ নির্ণয়ের জন্য বাধ্য হয়েই বেসরকারী ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে হচ্ছে। সেখানে রোগী গেলে ক্লিনিকে ভর্তি করে নেয় ক্লিনিক মালিকরা। ৫০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালটিতে নামেমাত্র চলছে চিকিৎসাসেবা। কয়েক ডাক্তারের মধ্যে আবার একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। তিনি অফিস সময়ে আউটডোরে রোগী দেখেন না। অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত। দুইজন ছুটিতে বা প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ায় ৪/৫ চিকিৎসক দিয়েই চলছে পুরো উপজেলার চিকিৎসা কার্যক্রম। গাইনি কনসালটন্টে ও ডেন্টিস্ট না থাকায় নারী রোগীরা চিকিৎসা গ্রহণ করতে এলে পড়তে হয় বিপাকে। সাধারণ রোগী ও এলাকাবাসীর অভিযোগ দুপুর ১টা বাজতে না বাজতেই ডাক্তারা তাদের পরিচিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অথবা প্রাইভেট হাসপাতালে প্রাকটিসে চলে যান। শিবচরে যত ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল রয়েছে, প্রত্যেক হাসপাতালের একজন বা দুজন করে প্রতিনিধি ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি করেন। এ সকল লোকজন ডাক্তারদের বিভিন্ন ধরনের অফার দিয়ে রোগীদের তাদের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান। অভিযোগ পাওয়া যায় প্রত্যেক ডাক্তার তাদের পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতাল চুক্তিবদ্ধ থাকেন। ঐ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতলে এসকল ডাক্তার চুক্তিবদ্ধ থাকেন যে কোন রোগী ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতলে ভর্তি হয় তাহলে সেখান থেকে ডাক্তারের ফোনে কল আসে যে স্যার আমাদের এখানে আপনার একটি রোগী আছে। যদি ঐ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্রাইভেট হাসপাতল খানিকটা দূরে হয় সে ক্ষেত্রে এসকল রোগী তাদের অফিস আওয়ারের পরে (দুপুর ১টার পর) তারা এসে সিজারসহ সকল অপারেশন করবেন ও রোগী দেখবেন। আর সরকারী হাসপাতালের আশপাশে হলে ফোন আসা মাত্রই চলে যান রোগীর সেবায়। রোগী পরিবহনের একমাত্র এ্যাম্বুলেন্সের সেবা নিয়েও নৈরাজ্যের অভিযোগ শিবচরের সচেতন মহলের। সাধারণ কাটা ছেড়াসহ যে কোন রোগী হাসপাতালে আসার সঙ্গে সঙ্গে বড় একটি সিøপ ধরিয়ে দেয়া হয়। হাসপাতালে সাধারণত গজ, পবিসেফসহ সাধারণ ওষধও নাকি থাকে না অভিযোগ রোগীর আত্মীয় স্বজনের। শিবচর উপজেলার যোগদাহের মাঠ এলাকার রোগী জুলেখা বেগম বলেন, ‘তিন দিন ধরে এখানে ভর্তি হয়েছি। এর মধ্যে মাত্র একবার ডাক্তারের দেখা পাইছি।’ বহেরাতলা গ্রামের ভর্তি রোগী হালিমা বলেন, ‘পিত্তথলির রোগ নিয়ে এখানে ভর্তি আছি। ডাক্তররা আসার পরই ফরিদপুর চলে যেতে বলছে। কিন্তু আমার মতো গরিব রোগী কি আর ফরিদপুর গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারে?’ এমন আরও অনেক রোগীই আছেন তাদের অভিযোগ ও ক্ষোভের শেষ নেই। শিবচর থেকে নির্বাচিত জেলা পরিষদের সদস্য আয়শা সিদ্দিকা বলেন, ‘সমগ্র বাংলাদেশে যখন উন্নয়নের জোয়ার বইছে। তখন শিবচরের দুস্থ রোগীদের শেষ আশ্রয় এ হাসপাতালটির অব্যবস্থাপনা ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। নৈরাজ্য, অনিয়ম ও চিকিৎসকদের এমন আচরণ কাম্য নয়। তারা সেবার মানসিকতা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে এমনটাই আশা করি।’ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এম এ মোকাদ্দেস অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দালাল মুক্ত করার জন্য স্থানীয়দের সহযোগিতা প্রয়োজন। দুই একজন ডাক্তার অনিয়ম করেন। কয়েক দিন আগে আমি নিজেই অফিস চলাকালেন স্থানীয় একটি ক্লিনিকে গিয়ে একজন ডাক্তারকে হাতেনাতে ধরি এবং তাকে শোকজ করি। এছাড়া হাসপাতালে কিছু সমস্যাও আছে।’ মাদারীপুর সিভিল সার্জন ডাঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালের কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি অকেজো এ বিষয় আমরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আরও কোন প্রশ্ন করার আগেই তিনি তড়িঘড়ি করে মোবাইল কেটে দেন। নানা সঙ্কটে ঝিকরগাছা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্টাফ রিপোর্টার যশোর অফিস থেকে জানান, ঝিকরগাছা উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জনবল সঙ্কটে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে সেবা নিতে আসা মানুষ। চিকিৎসক, সেবিকা ও কর্মকর্তার ৯২ জনের মধ্যে আছে ৫১ পদ খালি। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ১৯ পদের মধ্যে আটটি খালি। শুধু জনবল নয় যন্ত্রপাতিরও সঙ্কট রয়েছে। এতে রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। জানা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন), জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু), মেডিক্যাল অফিসার পদে ছয়টির মধ্যে চারটি খালি আছে। ১১টি ইউনিয়নে এমও পদের সাতটি খালি। খাতা কলমে চারজন থাকলেও দু’জন ঢাকায় আছেন। এছাড়াও নার্সিং সুপারভাইজার ১টি, সিনিয়র স্টাফ নার্স ১টি, পুষ্টিবিদ ১টি, ক্যাশিয়ার ১টি, অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক ২টি, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ডেন্টাল) ১টি, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ফার্মাসিস্ট) ২টি, স্টোর কিপার ১টি, সহকারী সেবক (সেবিকা নার্স) ১টি, স্যাকমো ১টি, স্বাস্থ্য পরিদর্শক ৩টি, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ৪টি, স্বাস্থ্য সহকারী ১৭টি পদ দীর্ঘদিন ধরে খালি রয়েছে। সব মিলে ৯২ জনের মধ্যে আছে ৫১ পদ খালি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সম্পর্কে জরুরী বিভাগের চিকিৎসক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জরুরী বিভাগে দু’জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও এখানে আছে একজন। রোগীর ব্যাপক চাপ। জনবল সঙ্কট। তবুও কার্যক্রমের জন্য জরুরী বিভাগে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছি।
×