ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুবরাই আলোকময় ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ২৪ জুন ২০১৯

 যুবরাই আলোকময় ভবিষ্যত

লেখার শিরোনামে যথার্থ খুঁজতে গিয়ে দেখি, খোকা থেকে টগবগে তরুণ মুজিবের স্বপ্ন থেকেই বাংলাদেশ জন্ম ও বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হয়েছে। আর এই মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালীর তরুণ-তরুণীরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ হয়েছে। দুই লাখেরও বেশি নারীর সম্ভ্রম বিনাশ হয়েছে। যাদের অধিকাংশই ছিল তরুণ-তরুণী। সে সময় আমার বাবাও ছিল টগবগে তরুণ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যুদ্ধ করে বাংলাদেশ জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতা অর্জন করেছে। যুবদের অতীত ইতিহাস সোনালি হলেও বর্তমানে তা অনেক ক্ষেত্রে মুখথুবড়ে পড়েছে। মাদক আর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জঙ্গীবাদ। সর্বশেষ হলি আর্টিজান জঙ্গী হামলা শিক্ষিত যুবক শ্রেণীকে রীতিমতো প্রশ্নবিদ্ধ করার পাশাপাশি জাতিকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তার কারণ কী- এটি খুঁজতে গিয়ে দেখি, বেকারত্ব, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, বন্ধুত্বে দ্বন্দ্ব, হতাশা, রাগ, ক্রোধ, পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদির জন্য তরুণ-প্রজন্ম এক প্রকার মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে একসময় অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। আর এই সুযোগে এক শ্রেণীর যুবককে কৌশলে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে ব্রেনওয়াশ করে বিপথগামী করে তুলছে। যদিও এসব কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী অপরাজনৈতিক এবং গোষ্ঠী বা ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের তাগিদেই। যতটুকু জানি, মানবজীবনের প্রথম কাজ জীবিকার জন্য ছুটে চলা নয় বরং প্রথম প্রয়োজন হচ্ছে সুস্থতা। আর সুস্থতার জন্য প্রয়োজন ক্রীড়া ও ক্রীড়াযুক্ত কর্ম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা ক্রীড়াযুক্ত কর্ম নিশ্চিত করতে পারছি কি? বেকারত্বের অভিশাপ থেকে তরুণ-তরুণীদের আমরা কতটুকু মুক্ত করেছি? আবার সামাজিক বৈষম্য দূর করতে আমাদের উল্লেখযোগ্য অর্জন কি? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সারাদেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। যার মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার শিক্ষিত তরুণ-তরুণী উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা অবস্থায় আছে অর্থাৎ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বলতে গেলে প্রায় ৪০ শতাংশের মতো! ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট এ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩-২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বেকারের সর্বোচ্চ হারের দিক থেকে আফগানিস্তান ও মালদ্বীপের পরে বাংলাদেশ তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। আবার আইএলওর হিসাব মতে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে ২০ লাখ, ২০১২ সালে ছিল ২৪ লাখ আবার ২০১৬ সালে তা ২৮ লাখ পর্যন্ত উঠেছে। তবে, ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি হওয়ার আশঙ্কাও করছে আইএলও। বেকারত্বের হার বেশি হলেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যান্য দেশের চেয়ে সবচেয়ে বাংলাদেশে নাজুক (ভালনারেবল) কর্মসংস্থানের হার কম। আইএলও তথ্যনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ২৫ লাখ। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৫৮ শতাংশ কর্মসংস্থান ছিল নাজুক। আর এই নাজুক অবস্থান ভারতের ক্ষেত্রে ৭৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ৬০ শতাংশ, নেপালে ৭৯ শতাংশ, ভুটানে ৭১ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৪০ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য, আনুষ্ঠানিক চুক্তিহীন কাজকে আইএলও নাজুক শ্রেণীতে রেখেছে। আর এই শ্রেণীতে পড়ে সাধারণ দিনমজুর ও গৃহকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, আইএলও বেকারের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে তা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। কর্মে নিয়োজিত ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষের মধ্যে কৃষিক্ষেত্রে আছেন ২ কোটি ৪৭ লাখ, শিল্পে ১ কোটি ২৪ লাখ এবং সেবা খাতে যুক্ত ২ কোটি ৩৭ লাখ মানুষ। কর্মক্ষম তবে শ্রমশক্তির বাইরে থাকা ৪ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজারের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৩৩ হাজার এবং পুরুষ ১ কোটি ১৯ লাখ ৪৭ হাজার। বিশ্বব্যাংকের একটি তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ বিদেশে আছে। তাদের বার্ষিক আয় ১৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। ভারত, ফিলিপিন্সের সমপরিমাণ জনশক্তি আমাদের থেকে কয়েকগুণ বেশি আয় করছে। এর প্রধান কারণ হলো, আমরা দক্ষ মানবসম্পদ বিদেশে পাঠাতে পারছি না। আমাদের যুবদের যে কোন ‘বিষয়’ খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করার সুনাম থাকলেও প্রযুক্তিজ্ঞান ও বিদেশী ভাষায় দক্ষতার অভাবে অনেক সময় যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে পড়ছে। এই জায়গায় আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। দেশ ও বিদেশের কর্মক্ষেত্রে যুবরা যেন মানসম্মত বেতন পায়, সেটা নিশ্চিত করতে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যদিকে আমাদের দেশ থেকে মাত্র দুই থেকে তিন লাখ মানুষ তাদের শ্রমশক্তি দিয়ে প্রতিবছর ছয় বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি ভেবে দেখার প্রয়োজনবোধ করছি। তবে আশার কথা হলো- সরকার যুবদের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেছে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন প্রস্তাবও দিয়েছে। এর একটি হলো সব প্রশিক্ষণার্থীর মান বৃদ্ধি করা। প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্তৃপক্ষের কাছে নিবন্ধন করতে হবে এবং তাঁদের প্রশিক্ষণপ্রণালি, প্রশিক্ষক, যাচাই মানসহ সব কার্যক্রম জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষণ করবে। তখন তরুণ-তরুণীরা দেশ-বিদেশের যে কোন কর্মবাজারে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। শেখ হাসিনাও ব্যক্তিগতভাবে তরুণ-তরুণীদের ভবিষ্যতের প্রতি যে আন্তরিক- এটি তাঁর সরকার আরও বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত। আমাদের মোট জাতীয় বাজেটের শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ যুব ও ক্রীড়া বাজেটের অন্তর্ভুক্ত রেখেছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৪৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বর্তমানে ২০১৯-২০ এ প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমাণ প্রায় ৩২০ কোটি টাকার মতো রাখা হয়েছে। আমাদের সব জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তরুণ-তরুণীদের আমরা এখনও পুরোপুরি সম্পদ হিসেবে গড়তে পারিনি। জাতীয় বাজেট অনুসারে ২৩টি মন্ত্রণালয় যুবদের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের আরও বেশি আন্তরিক হয়ে এগিয়ে আসতে হবে, গুরুত্ব দিতে হবে। গ্রাম-শহরের যুবদের সমান গুরুত্ব দেয়া জরুরী। কারণ, শহরের যুবসমাজ ক্রমে মাদক, নেশা, অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। ইন্টারনেট আর বিদেশী সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হওয়ার ফলে তারা নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান তেমনটা সমৃদ্ধ করতে পারছে না। আমরা যদি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যুবদের এক করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে এদেশে বৈষম্য দেখা যাবে না। যুবদের জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট যেন সঠিকভাবে এবং সঠিক খাতে ব্যয় হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির মূল পরিবর্তন আসবে যুবদের হাত ধরে। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যুবদের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে হবে। সমন্বয় করে যুবদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় আনাও প্রয়োজন। যুবদের জন্য নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি, নতুন নতুন প্রকল্পের মাঝে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ের সরকারের সঙ্গে যুবদের যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুবরাই আমাদের মূল চালিকাশক্তি এবং আলোকময় ভবিষ্যত। আর এই যুবরাই যদি দেশের সব কার্যক্রমে নিজেদের স্বক্রিয় করতে পারে, সামনে থেকে নিজেরা নেতৃত্ব দিতে পারে। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ) [email protected]
×