ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আফসার বাহিনীর প্রতিরোধযুদ্ধ ॥ ২৫ জুন, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:০৩, ২৫ জুন ২০১৯

  আফসার বাহিনীর প্রতিরোধযুদ্ধ ॥ ২৫ জুন, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৫ জুন দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিন মুক্তিযোদ্ধারা লাবিবুর রহমান ও সরোয়ার লাল্টুর নেতৃত্বে কাদের বাহিনীর পাঁচ ও এগারো নম্বর কোম্পানি নাগরপুর থানার ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ঝটিকা আক্রমণের মুখে পুলিশরা আত্মসমর্পণ করে। এতে থানার বেতার যন্ত্র, অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে। ভালুকা থানার রাজৈ গ্রামের আওয়ামী লীগের কর্মী মোঃ আবদুল হামিদ মিঞার কাছ থেকে একটি রাইফেল ও ৩১ রাউন্ড গুলি সংগ্রহ করেছিলেন আফসার উদ্দিন। মাত্র একটি অস্ত্র নিয়ে ‘আফসার বাহিনী’র পথচলা। প্রতিরোধের শপথ। দেশ মাতৃকার টানে একের পর এক ‘আফসার বাহিনীতে যোগ দিতে থাকেন মুক্তিকামী মানুষ। অল্প সময়ের মধ্যেই সাড়ে চার হাজার অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধার এক বিরাট বাহিনী গড়ে ওঠে। মূলত ২৫০ কোম্পানির সমন্বয়ে বাহিনী গঠন হয়। একে একে ১৫০ যুদ্ধে অংশ নেয় এই বাহিনী। বাহিনী প্রধান আফসার ৭৫ যুদ্ধে অংশ নেন। এ বাহিনীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল একাত্তরের এই দিন। সেদিন ময়মনসিংহের ভালুকার ভাওয়ালীয়া বাজুরঘাটে আফসার উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর একটানা বিয়াল্লিশ ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনীর ১২৫ জন সেনা নিহত হয়। এই যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা আফসার উদ্দিনকে ‘মেজর’ উপাধি প্রদান করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিলদার মতিন মর্টারের সাহায্যে পাকসেনাদের লক্ষ্মীপুরের বাগবাড়ি ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ আক্রমণে কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। মৌলভীবাজারে মুক্তিযোদ্ধারা হ্যান্ড গ্রেনেডের সাহায্যে বিয়ানীবাজার থানা সার্কেল অফিস আক্রমণ করে। সফল আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে। মৌলভীবাজারে মুক্তিবাহিনী সমনবাগ চা বাগানের কারখানা আক্রমণ করে। এতে ১০ জন প্রহরী ও হানাদার বাহিনীর ৫ জন দালাল নিহত হয়। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জেদ্দায় ইসলামী সম্মেলন সংস্থার মহাসচিব টেংকু আবদুর রহমানের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় বাংলাদেশে চলমান গণহত্যা বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ২২ জাতি ইসলামী সম্মেলনে পাকিস্তানের জাতীয় ঐক্য ও আঞ্চলিক অখ-তা রক্ষার প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং লোকসভায় বক্তৃতাকালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক সেনাবাহিনী প্রেরণের আহ্বান জানান। মুসলিম লীগ প্রধান আব্দুল কাইয়ূম খান দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশ এক গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। কাজেই দ্বিধাবিভক্ত মুসলিম লীগকে এক পতাকাতলে সমবেত হয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ স্বাধীন বাংলা বেতারের বরাতে জয়বাংলার ১ম বর্ষ ৭ম সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে যে বর্বরোচিত ও সুপরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে তারই অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও তাদের সমর্থকদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এই নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ পিতামাতাও রেহাই পায়নি। গত সাতদিন চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে প্রায় ১৫০ জন পাক হানাদার মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে এবং বহু স্থান থেকে পাকসেনা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র জানিয়েছে। সমগ্র পূর্ব রণাঙ্গনে গেরিলাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কক্সবাজারে বহু পাকসেনা হতাহত হয়েছে। এদিকে মর্টার ও মেশিনগানসহ আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ২০০ জন পাকসেনাকে হত্যা করেছে। স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা গত ১৯ জুন সিলেট সেক্টরে একটি এলাকায় পাক-হানাদারদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে ১৩ জন পাকসেনা খতম করেন এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদসহ ৩ জন পাকসেনাকে আটক করেছেন। এর আগেরদিন প্রচ- সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী সিলেটের কয়েকটি স্থানে আক্রমণ চালিয়ে ২২তম রেজিমেন্টের একজন সৈন্যকে আটক করেছেন। মুক্তিবাহিনী রংপুরে বজরাপাড়ায় পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের নাজেহাল করে ছেড়েছেন। এই আক্রমণে অনেক খানসেনা হতাহত হয়েছে। সেই দিনই পাকসেনারা মৃত সৈন্যদের লাশ ও আহত সৈন্যদের নওগাঁয় নিয়ে যায়। এই আক্রমণে একজন অফিসারসহ দুজন পাকসেনাকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা গ্রেফতার করেছেন। কয়েকদিন আগে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা ঠাকুরগাঁওয়ের কাছে মর্টার ও মেশিনগান থেকে মুক্তি ছাউনির ওপর আচমকা গুলি চালায়। গত দুই সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামে অধিকসংখ্যক গাড়ি ও সৈন্য নিয়ে পাকসেনাদের চলাফেরা করতে দেখা যায়। কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে মেহেরপুর এলাকায় এক দুঃসাহসিক আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী কমপক্ষে ৩০ জন পাকসেনাকে খতম করেছেন, সেখানকার কুতুবপুরে মুক্তিবাহিনী খানসেনাদের ওপর আকস্মিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে ১০ জন খানসেনাকে হত্যা করেন। .... হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের খবরে বলা হয়েছে, ভারতীয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ আজ এক বার্তায় সতর্ক করে বলেন, যদি পূর্ববাংলার রাজনৈতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান না হয় তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। সিঙ্গাপুরে এক প্রেস কনফারেন্সে তিনি বলেন, বড় শক্তিধর দেশগুলোর উচিত পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা এড়ানোর জন্য সেখানে রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে চাপ দেয়া। তিনি বলেন- জেলে থাকা শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে। পাকিস্তান সরকারের উচিত রহমান সাহেবের সঙ্গে আলোচনায় বসা। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×