ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

প্রত্যাশার তরী যেন থাকে ভাসমান

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ২৫ জুন ২০১৯

 প্রত্যাশার তরী যেন  থাকে ভাসমান

নতুন সরকারে চমক আছে। সাধারণত চমক থাকলে তার ফল খুব বেশি সুখকর হয় না। এর কারণ প্রত্যাশা। গোড়াতেই বলে নেই, ভোটের ফল পাওয়া পর্যন্ত ছিলাম নৌকার কড়া সমর্থক। এর অনেক কারণ। মূলত আত্মসম্মান বোধ, জাতি হিসেবে ইতিহাসের প্রতি দায়, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং ভয় তাড়ানোর জন্যই এই সমর্থন। ভীতি আমাদের যাবে না। যতদিন খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং তাদের মিত্ররা শুদ্ধ রাজনীতি না করবেন, ততদিন এই ভয় থাকবেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়া তারেক জিয়া তো আছেই। আমাদের ভয় যে অমূলক নয় তার বড় প্রমাণ অতীত। রাজপথে গ্রেনেড হামলাসহ সংখ্যালঘু নির্যাতন ও প্রগতিশীলদের ওপর প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর এই দল ও তার মিত্ররা দেশ শাসনে আসতে পারলে কারা বাঁচবেন আর কারা পারবেন না, তার হিসাব কমবেশি সবার জানা। ফলে আমরা কোনভাবেই তাদের সমর্থন করতে পারি না। আর একই কারণে আওয়ামী লীগ ধরে নেয়, আমরা তাদের দলের। চাইলেও আছি, না চাইলেও আছি। আমরা বলতে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কথা বলছি না। এদেশের প্রগতিশীল জনগোষ্ঠীকে তারা এভাবেই মূল্যায়ন করে বোধহয়। তাই ভয় তাদের বেলায়ও আছে। তারা যখন বিরোধী দলে থাকে বা দেশের শাসনভার পাবে কি পাবে না এই শঙ্কা কাজ করে তখন আচরণে বিনয় বা ভদ্রতার কমতি থাকে না। জেতার পর তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তখন আমরা দেখি উল্টোচিত্র। খুব বেশিদিনের কথা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন সিডনি সফরে। বাপরে বাপ! একখানা প্রবেশপত্র পাওয়া যেন হাতে চাঁদ পাওয়া! যখন প্রয়াত নেতা ও সিডনি তথা অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বাংলা কাগজ স্বদেশ বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক নূরুল আজাদ বেঁচেছিলেন তখন এতটা কষ্ট হতো না। তিনি সম্মান দিতে জানতেন। এখন দল বেড়েছে। বেড়েছে নেতাও। কে যে নেতা আর কে যে কর্মী বোঝা মুশকিল। সময়ে দেখলাম এতদিনের মেকি ব্যবহার, ভদ্রতা উধাও। যদিও বিনা তেল মালিশে একখানা প্রবেশপত্র মিলেছিল আর গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখেছিলাম ও কথা শুনেছিলাম, কিন্তু না গেলে তাদের সার্কাস মিস করতাম। কে মঞ্চে যাবেন আর কে যাবেন না সে লড়াইয়ে তাঁরা লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, মাস্টার, পন্ডিত সবাইকে কাৎ করে নিজেরা নিজের ভাগ করে নিয়েছিলেন সব। এমনধারা দেশেও আছে। প্রধানমন্ত্রী তো আমাদের সবার নেতা। আশার বাতিঘর। তিনি এসব জানেন না। জানার কথাও নয়। তার অগোচরেই ঘটে যায় আত্মঘাতী যত কান্ড। এবার তিনি অবশ্য কথা দিয়েছেন, দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্সে থাকবে সরকার। সেটা আমরা দেখতে চাই কাজে। খুশি হব যদি তিনি এমন বলেন যে, কথা কম আর কাজ বেশি হবে এবারের আদর্শ। সরকারে এমন কিছু মানুষের মুখ আছে যাদের ওপর ভরসা করি। বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রীর দুর্নীতি বিষয়ে কোন গল্প শুনিনি। তা বলে কি তিনি সার্থক না সফল? যেসব বই বিতরণের ছবিতে তিনি মিডিয়া ভরে তুলতেন তা কি তাঁর অবদান? না, জিপিএ ফাইভ পাওয়া বাচ্চাদের মেধা বিকাশে তাঁর কোন ভূমিকা ছিল? বরং এই টেস্ট সেই টেস্ট আর অকার্যকর সব ফলের নামে তিনি বাচ্চাদের রক্ত টেস্ট, অভিভাবকদের মেজাজ টেস্ট, ধৈর্য টেস্টের এক খেলায় মেতেছিলেন। গতবছর দেশে গিয়ে দেখি ভূরি ভূরি বিশ্ববিদ্যালয় আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ঠেলায় রাস্তায় হাঁটা-চলা দায়। চোখ তুলে তাকালেই রাশভারি নামের সব সাইনবোর্ড। এককালের গুদাম-গোডাউন নর্দমার ওপর পুরনো ভবন সব দখল করে যার যার ইচ্ছেমতো ইউনিভার্সিটি খুলে বসেছে। না আছে কোন মেধা, না কোন যোগ্যতা। প্রাইভেট পড়াশোনার ব্যাপারটা কি নিয়ম, নিয়ন্ত্রণের বাইরে? তাহলে তো প্রশ্ন থাকে- যারা টাকার জোরে বা খুঁটির জোরে চিকিৎসক হবেন, ব্যারিস্টার হবেন কিংবা টিচার হবেন তাদের কাছে কি আমাদের শরীর, আইন বা মেধা নিরাপদ? এ প্রশ্নের উত্তর পাইনি কোথাও। নতুন মন্ত্রীর মেধা নিয়ে সংশয় নেই। তিনি যখন বিদেশমন্ত্রী ছিলেন তখন অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। পরিশ্রমী দীপু মনি এ বিষয়ে যথেষ্ট পারদর্শী। আমরা আশা করব, এবার তাঁর আমলে আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা আর কিছু পাক বা না পাক, অন্তত শান্তি ও নিরাপত্তা পাবে। তারা জানবে মানুষ হতে হলে কিছু নম্বর প্রাপ্তি আর আঙুল উঁচিয়ে ভি সাইন দেখানো যথেষ্ট নয়। এই জায়গা থেকে জাতিকে বাঁচাতে বা আগামী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে আনতে যে সাহস ও ধৈর্যের দরকার, সেটাই এবার দেখার বিষয়। এমন পরিবর্তন আরও বহু জায়গায় জরুরী। চমকের মূল কথা যদি জনসেবা আর জবাবদিহিতা না হয় তো তার মূল্য থাকবে না। শুরুতেই চমক দিতে গিয়ে বিপাকে আছেন প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক। তাড়াহুড়োয় মাথায় হেলমেট পরতে ভুলে যাওয়া প্রতিমন্ত্রী কিন্তু আইন মানেননি। যাতে এটা প্রমাণিত, এই যাওয়া ছিল তাঁর চমক। তা পলকের চমক বেশি সময় টেকেনি। বরং তাঁকে মাফ চাইতে হয়েছে। এমন চমক আমরা চাই না। আপনি গাড়িতেই আসুন। কিন্তু মানুষের কথা শুনুন, মানুষের মন বুঝুন, তাহলেই হবে। আরেক বিপদ দেখছি জোটের নেতাদের ধূমায়িত বেদনায়। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন মন্ত্রিত্ব পাক্কা। এই ধারণার জন্য তাঁরা যতটা দায়ী, তার চেয়ে অধিক দায়ী আশা। এই আশা যেভাবে আসে বা যায় তার গোড়াটা ধরতে পারেননি তাঁরা। এরা একজনও নির্বাচন হলে, ভোট সঠিক হলে নৌকা ছাড়া জিততে পারবে না। জেতার জন্য যা যা দরকার তার জন্য এদের দরদ কোথায়? একজন ধরে নিয়েছিলেন মন্ত্রিত্বের মূল কথাই খালেদা জিয়ার বিরোধিতা। বলতে বলতে লাগামহীন তিনি দলের ব্যাপারে, জোটের ব্যাপারেও সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। বলে বসলেন, আমরা নাকি কারও দয়ায় মন্ত্রী হই। যুক্তি দিলেন এই বলে, আওয়ামী লীগ আশি পয়সা হলে তারা বিশ পয়সা। যার মিলন ছাড়া একটাকা হবে না। সেই একটাকা যখন একক আর একা একাই এক শ’ তখন তিনি হতাশ। অর্থাৎ জোটে থাকার কারণ মন্ত্রী হওয়া। সেই তারা যে সহযোগিতা করবেন না, এটা সুস্পষ্ট। মিডিয়ায় দেখলাম সাম্যবাদী দলের নেতা দীলিপ বড়ুয়া বলেছেন, জোটের কাঁধে ভর করে বৈতরণী ও দুঃসময় পার হওয়া সরকারী দল তাদের এখন চিনতে পারছে না। এই ভদ্রলোককে এলাকার কজন মানুষ চেনেন? ’৯১ সালে তিনি ছয় থেকে সাত শ’ ভোট পেয়ে পেছনদিক থেকে রেকর্ড করেও পরে শিল্পমন্ত্রী হয়েছিলেন। লোভ আর পাওয়ার এটাই বড় বিপদ । একবার তা এলে মনে মানুষ আর তা ভুলতে পারে না। দলের বাঘা বাঘা নেতাও মন্ত্রিত্ব পাননি। শেখ হাসিনার ক্যারিশমা, জনপ্রিয়তা আর মেধার কাছে অসহায় বলে চুপ করে আছেন। তা বলে এটা বলা যাবে না, তাঁরা সব সময় তাই থাকবেন। নতুন মন্ত্রিসভার নতুন মন্ত্রীদের কাছে সময় হানিমুনের নয়। বরং ঘরে-বাইরে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই চলতে হবে। সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ কিন্তু জনমন। সেখানে প্রশ্ন আর চাওয়ার পাহাড়। তা ডিঙ্গাতে হলে মেধা-প্রজ্ঞা আর সাহসের বিকল্প নেই। মানুষ এবার তাদের চাওয়া-পাওয়ার পাশাপাশি দেশ ও সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ও ইতিবাচক কিছু চায়। সেটা নতুন প্রজন্মের জন্য জরুরী। তার অন্যথা বা বিকল্প কিছু নেই। চমক দিতে আসা নতুনরা যেন অতীতের অভিজ্ঞতা-কারো হাসি, কারো অতিকথন, কারো আচরণগত বদভ্যাসের শিকার না হন। তাদের কাজকর্ম আর নতুনত্ব দেখে যেন বলতে না হয়- যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। ভাল কিছুর জন্য আমাদের প্রত্যাশার পালে হাওয়া লাগলেই নৌকা ভাসবে উন্নয়নের জোয়ারে। বাদবাকি সময়ের হাতে। [email protected]
×