ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রভাবশালীর মৎস্য প্রকল্পের কবলে ৫৩ পরিবার

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ২৫ জুন ২০১৯

প্রভাবশালীর মৎস্য প্রকল্পের কবলে ৫৩ পরিবার

নিজস্ব সংবাদদাতা, গোপালগঞ্জ, ২৪ জুন ॥ কাশিয়ানীতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মাহমুদপুর বিল এলাকার ৫৩ সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবার। স্থানীয় এক প্রভাবশালীর কথিত মৎস্য প্রকল্পের ঘেরে দিন দিন বেদখল হয়ে যাচ্ছে তাদের সব কৃষি-জমি। ঘেরের মধ্যে আটকা পড়ে জমিগুলো হয়ে পড়েছে পতিত। আবাদ করতে না পেরে থেমে গেছে তাদের জীবন-জীবিকা; অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটে তাদের অনেকের। প্রভাবশালীর নির্যাতন-নিপীড়নে এখন তারা দিশেহারা। প্রশাসনের দরজায়ও কড়া নাড়তে নাড়তে তারা বড় ক্লান্ত। তাদের পূর্ণ নিরাপত্তাসহ কৃষিজমিগুলোর সুরক্ষার জন্য সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও স্থায়ী সমাধান না পেলে দেশান্তর হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। সরেজমিন গেলে ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু জমির মালিকরা অভিযোগ করে বলেন, পার্শ্ববর্তী পারুলিয়া গ্রামের প্রভাবশালী দিদার হোসেন অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ১১২নং মাহমুদপুর মৌজায় ওই বিলের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে তিনি প্রায় ৬২ বিঘা কৃষি জমি ক্রয় করেন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিলসংলগ্ন বাপাউবোর ২.৩৭ একর জমি ইজারা নিয়ে বিলজুড়ে ‘মাতবর এ্যাগ্রো ফিশারিজ’ নামে মৎস্য প্রকল্পের সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেন। এরপর অবৈধভাবে শুরু করেন বিলের চারপাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ। তখন থেকেই নিজেদের কৃষি-জমিগুলো সুরক্ষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন স্থানীয় সংখ্যালঘুরা। পরে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ওই ইজারা বাতিল করে দেয় বাপাউবো। এ নিয়ে আশপাশের সব ইউপি-চেয়ারম্যান-মেম্বর ও গণ্যমান্যদের সমন্বয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সালিশ-দরবার হয়েছে বহুবার। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে সেখানকার সংখ্যালঘু নারী-পুরুষ এক হয়ে গোপালগঞ্জ শহরে এসে মানববন্ধন, বিক্ষোভ-সমাবেশ করেন। সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেন বার বার। কিন্তু ফল হয়নি কোন। বরং প্রশাসনের সব নির্দেশ অমান্য করে কোন অনুমতি ছাড়াই প্রভাবশালী দিদার হোসেন সেই থেকে প্রতিবছর তার মৎস্য ঘেরের কাজ এগিয়ে নিয়েছেন। নিজের জমি দাবি করে অন্য মালিকানার কৃষিজমিগুলোও তিনি ইচ্ছেমতো কেটে মৎস্য ঘের নির্মাণ করে যাচ্ছেন। সরকারী কোন লম্বা ছুটি এলেই রাতের আঁধারে তিনি তার লোকজনসহ সেখানে এস্কেভেটর নামিয়ে দেন এবং প্রশাসনের বাধা না পাওয়া পর্যন্ত বাঁধের কাজ চালিয়ে যান। এ বছরও ঈদের লম্বা ছুটি শুরু হলে তার শ’ খানেক লোক রাতের আঁধারে এস্কেভেটর নিয়ে সেখানে নামে। বাধা দিতে গিয়ে যাচ্ছে-তাই গালিগালাজ, দেশ থেকে বের করে দেয়া ও মেরে ফেলার হুমকিসহ মারধরের শিকার হতে হয় অনেকের। ভীত সন্ত্রস্ত দিশেহারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষগুলো বরাবরের মতোই নিজেদের অসহায়ত্বের কথা জানান জেলা প্রশাসককে। পরে কাশিয়ানীর ইউএনও এএসএম মাঈনউদ্দীন ও ওসি আজিজুর রহমানসহ পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়ে এস্কেভেটর তুলে দেন। কিন্তু ততক্ষণে বিলের দক্ষিণপাশের আরও প্রায় ৩শ’ গজ বাঁধের কাজ এগিয়ে যায়। তারা আরও জানান, এভাবেই গত কয়েক বছরে একটু একটু করে অপ্রতিরোধ্য দিদার হোসেন মৎস্য প্রকল্পের নামে অবৈধভাবে বিলের চারদিকে বাঁধ দিয়ে ঘিরে ফেলেছেন ওই বিলের প্রায় দেড় শ’ বিঘা জমি। ঘেরের মধ্যে এখনও রয়েছে ৫৩টি সংখ্যালঘু পরিবারসহ ৫৮টি পরিবারের ৬৪ বিঘা কৃষিজমি; যা পরিবারগুলোর বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সেখানে দিদার হোসেনের রয়েছে ৬২ বিঘা এবং বাকি সব সরকারী জমি। আর একবার সুযোগ পেলে হয়তো তিনি বাঁধের বাকি কাজটুকুও শেষ করে নেবেন। তাই দিদার হোসেনের এই আগ্রাসনের হাত থেকে রেহাই পেতে তারা সরকারের সুদৃষ্টি ও জরুরী পদক্ষেপ কামনা করছেন। বিষয়টি নিয়ে দিদার হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি গড়িমসি করে সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, একজন ব্যক্তি অবৈধভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কৃষি-জমির ক্ষতি হয় এমনকিছু কার্যকলাপ করছে। খবর পেয়ে আমি তাৎক্ষণিক কাশিয়ানীর ইউএনও এবং ওসিকে নির্দেশ দেই। তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে সব দেখেশুনে এস্কেভেটর তুলে বাঁধ নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেন। ইতোমধ্যে ইউএনও এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয়েছে। খুব শীঘ্রই সামাজিকভাবে এটির শান্তিপূর্ণ স্থায়ী সমাধান হবে।
×