ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সজিনার পুষ্টি

অনন্য সবজি-পাতার গুণ আরও বেশি, সারা বিশ্বেই জন্মে

প্রকাশিত: ১০:১৪, ২৫ জুন ২০১৯

অনন্য সবজি-পাতার গুণ আরও বেশি, সারা বিশ্বেই জন্মে

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ সজিনা একটি অতিপরিচিত দামী এবং সুস্বাদু সবজি। যার উৎপত্তিস্থল পাক-ভারত উপমহাদেশ হলেও এ গাছ শীত প্রধান দেশব্যতীত সারাপৃথিবীতেই জন্মে। বারোমাসি সজিনার জাত প্রায় সারাবছরই বার বার ফলন দেয়। বসতবাড়ির জন্য সজিনা একটি আদর্শ সবজি গাছ। দেশী-বিদেশী পুষ্টি বিজ্ঞানীরা সজিনাকে অত্যাশ্চর্য বৃক্ষ বা অলৌকিক বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এর পাতায় আট রকম অত্যাবশ্যকীয় এমাইনো এসিডসহ ৩৮ শতাংশ আমিষ রয়েছে যা বহু উদ্ভিদেই নেই। সজিনা সবজির চেয়ে এর পাতার উপকার আরও বেশি। দক্ষিণ আফ্র্রিকায় এ গাছকে মায়েদের ‘উত্তম বন্ধু’ এবং পুষ্টির এক অনন্য সহজলভ্য উৎস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দিন দিন গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাওয়া সজিনা চাষ বৃদ্ধির জন্য বরিশালের গৌরনদী উপজেলার গ্রামীণ জনপদে চলতি মৌসুমে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ এক হাজার সজিনা চারা রোপণের কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা পূরণে ফলদ বৃক্ষরোপণ করে ব্যাপক প্রশংসিত হওয়ার পর গৌরনদী উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়নের বৃক্ষপ্রেমী চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু তার ইউনিয়নের ১৭ কিলোমিটার গ্রামীণ জনপদে আনুষ্ঠানিকভাবে সজিনা চারা রোপণের উদ্বোধন করেছেন। জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দা মনিরুন নাহার মেরী এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার খালেদা নাছরিন সজিনা চারা রোপণ কর্মসূচীর উদ্বোধন করেছেন। সজিনা চারা রোপণের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন ভেজাল খাদ্যগ্রহণের ফলে আমাদের শরীরে নানাবিধ রোগের উপদ্রব হচ্ছে। তাই ইউনিয়নবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পুষ্টির ডিনামাইট হিসেবে আখ্যায়িত সজিনা গাছকে ইউনিয়নের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সহস্রাধিক সজিনা চারা রোপণ কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। গৌরনদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানান, হৃদরোগ, রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধি, শ্বেতী, টাইফয়েড, প্যারালাইসিস, লিভার, ত্বক ও চোখের রোগসহ নানাবিধ রোগপ্রতিরোধকারী সজিনা চারা উপজেলাব্যাপী রোপণের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার খালেদা নাছরিন জনকণ্ঠকে জানান, সজিনা গাছের পুষ্টিমান, ঔষধি গুণ ও খাদ্য হিসেবে ব্যবহার অনুশীলন করে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য আরও ব্যাপকভাবে সজিনার ফল, টাটকা ও শুকনা পাতা ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত। সারাবছর এ সবজি খাওয়ার অভ্যাস বাড়ানো উচিত। তাই এর চাষ পদ্ধতি ও গুণাগুণ মিডিয়ার মাধ্যমে সারাদেশের জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য সব পুষ্টিবিজ্ঞানী, সাংবাদিক, কৃষিবিদ ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক ও সর্বস্তরের জনসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। তবেই সজিনা গাছের নামকরণ অত্যাশ্চর্য বৃক্ষ হিসেবে স্বার্থকতা পাবে। সজিনার পুষ্টি ॥ বিজ্ঞানীরা পুষ্টির দিক দিয়ে সজিনাকে ‘পুষ্টির ডিনামাইট’ আখ্যায়িত করে বলেন, এ গাছটি থেকে পুষ্টি, ঔষধি গুণ ও সারাবছর ফলন পাওয়া যায়। ফলে বাড়ির আঙিনায় এটি একটি ‘মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ’। এর পুষ্টিগুণ খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে খাদ্য শক্তি কি. ক্যাল ৪৩, পানি ৮৫.২ গ্রাম, আমিষ ২.৯ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, শর্করা ৫.১ গ্রাম, খাদ্য আঁশ ৪.৮ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৪ মি. গ্রাম, আয়রন ০.২ মি. গ্রাম, জিংক ০.১৬ মি. গ্রাম, ভিটা-এ ২৬ মি. গ্রাম, ভিটা-বি ১০.০৪ মি. গ্রাম, ভিটা-বি ২ মি. গ্রাম ০.০৪, ভিটামিন-সি ৬৯.৯ মি. গ্রাম। সজিনা পাতার গুণাগুণ ॥ বিজ্ঞানীরা মনে করেন সজিনার পাতা পুষ্টিগুণের আঁধার। নিরামিষভোগীরা সজিনার পাতা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতে পারেন। পরিমাণের ভিত্তিতে তুলনা করলে একই ওজনের সজিনা পাতায় কমলা লেবুর সাতগুণ ভিটামিন-সি, দুধের চারগুণ ক্যালসিয়াম এবং দুইগুণ আমিষ, গাজরের চারগুণ ভিটামিন-এ, কলার তিনগুণ পটাশিয়াম বিদ্যমান। সজিনা পাতায় ৪২ শতাংশ আমিষ, ১২৫ শতাংশ ক্যালসিয়াম, ৬১ শতাংশ ম্যাগনোসিয়াম, ৪১ শতাংশ পটাশিয়াম, ৭১ শতাংশ লৌহ, ২৭২ শতাংশ ভিটামিন-এ এবং ২২ শতাংশ ভিটামিন-সিসহ দেহের আবশ্যকীয় বহু পুষ্টি উপাদান থাকে। এক টেবিল চামচ শুকনা সজিনা পাতার গুঁড়া থেকে ১-২ বছর বয়সী শিশুদের অত্যাবশ্যকীয় ১৪ শতাংশ আমিষ, ৪০ শতাংশ ক্যালসিয়াম ও ২৩ শতাংশ লৌহ ও ভিটামিন-এ সরবরাহ হয়ে থাকে। দৈনিক ছয় চামচ সজনে পাতার গুঁড়া একটি গর্ভবতী বা স্তন্যদাত্রী মায়ের চাহিদার সবটুকু ক্যালসিয়াম ও আয়রন সরবরাহ করতে সক্ষম। সজিনার তেল ॥ সজিনার শুকানো বীজ ভাঙ্গিয়ে ৩৮-৪০ শতাংশ ভোজ্যতেল পাওয়া যায়। যাতে উচ্চ মাত্রার বিহ্যানিক এসিড থাকে যা বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক। এ তেলের কোন গন্ধ নেই এবং অন্য যে কোন ভোজ্যতেলের মতোই মানসম্পন্ন। তেল নিষ্কাশনের পর প্রাপ্ত খইল সার হিসেবে এবং পানি শোধনের কাজেও ব্যবহার হয়। সজিনার ঔষধি গুণ ॥ ভারতীয় আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র মতে, সজিনা গাছ ৩০০ রকমের রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। আধুনিক বিজ্ঞানও এ ধারণাকে সমর্থন করে। সজিনার কচি পাতা সবজি হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়। সজিনার বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ঔষধি গুণ রয়েছে। শরীরের কোন স্থানে ব্যথা হলে বা ফুলে গেলে সজিনার শিকড়ের প্রলেপ দিলে ব্যথা ও ফোলা সেরে যায়। কানে ব্যথা হলে সজিনার শিকড়ের রস কানে দিলে কানের ব্যথা সেরে যায়। সজিনার আঠা দুধের সঙ্গে খেলে কিংবা আঠা কপালে মালিশ করলে মাথা ব্যথা সেরে যায়। সজিনার আঠার প্রলেপ দিলে ফোঁড়া সেরে যায়। সজিনা ফুলের রস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে মূত্রপাথরি দূর হয়। এছাড়া সজিনার ফুলের রস হাঁপানি রোগের জন্য বিশেষ উপকারী। সজিনা পাতার রসের সঙ্গে লবণ মিশিয়ে খেতে দিলে বাচ্চাদের পেটে জমা গ্যাস দূর হয়। কুকুরের কামড়ে সজিনা পাতা পেষণ করে তাতে রসুন, হলুদ, লবণ ও গোলমরিচ মিশিয়ে সেবন করলে কুকুরের বিষ ধ্বংস হয়। সজিনা পাতার শাক খেলে যন্ত্রণাদায়ক জ্বর ও সর্দি দূর হয়। সজিনা পাতার রসে বহুমূত্র রোগ সারে। সজিনার ফুল কোষ্ঠকাঠিন্য দোষ দূর করে এবং দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে। সজিনার ফল নিয়মিত রান্না করে খেলে গেঁটে বাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। সজিনার কচি ফল ক্রিমিনাশক, লিভার ও প্লীহাদোষ নিবারক, প্যারালাইসিস এবং টিটেনাসরোগে হিতকর। সজিনার বীজের তেল মালিশ করলে বিভিন্ন বাত বেদনা, অবসতা, সায়াটিকা, বোধহীনতা ও চর্মরোগ দূর হয়। পাতার রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়। পোকার কামড়ে এন্টিসেপ্টিক হিসেবে সজিনার রস ব্যবহার করা হয়। ক্ষতস্থান সারার জন্য সজিনা পাতার পেস্ট বেশ উপকারী। সজিনা শরীরের প্রতিরোধক ব্যবস্থা শক্তিশালী করে। শরীর থেকে বিষাক্ত দ্রব্য, ভারি ধাতু অপসারণ এবং শরীরে রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি নিতে সহায়তা করে। ইন্টেস্টাইন ও প্রোস্টেট সংক্রমণ যেমন-সজিনা বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করে। শ্বাসকষ্ট, মাথা ধরা, মাইগ্রেন, আর্থাইটিস এবং চুলপড়া রোগের চিকিৎসায়ও সজিনা কার্যকর ভূমিকা রাখে। সজিনার ব্যবহার ॥ সজিনা খাবার টেবিলে সবজি হিসেবেই বেশি ব্যবহার হয়। মার্চ থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সজিনা বাজারে প্রচুর পাওয়া যায়। এ সময় খরিপ সবজির মধ্যে সজিনার যথেষ্ট কদর থাকে। আগাম সজিনা বাজারে নিতে পারলে আর্থিকভাবে প্রচুর লাভবান হওয়া যায়। সজিনা দিয়ে ডাল সবচেয়ে জনপ্রিয়। সজিনা শুধু ফল হিসেবেই নয়; সজিনার কচি পাতা ও ডাঁটা বা ডাল ভাজি কিংবা তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। পালং শাকের বিকল্প হিসেবেও সজিনা শাক খাওয়া হয়। মুরগির মাংস রান্নায় কচি সজিনা পাতা সুস্বাদু লাগে। কালিজিরা, কাঁচামরিচ, রসুনের সঙ্গে সজিনা পাতার ভর্তা একটি মজাদার খাবার। ছোট মাছের সঙ্গে সজিনা পাতার চর্চরি খুবই উপাদেয়। সজিনা পাতার বড়া, সালাদ, পাতা বাটা ও সজিনা পাতার পাউডার দ্বারা খাদ্য সুস্বাদু ও শক্তিবর্ধক হয়। যে কোন স্যুপের সঙ্গে শুকনা সজিনা পাতার পাউডার মিশালে খাদ্যমান বেড়ে যায়। চা বা কফি তৈরিতে সজিনা পাতার পাউডার ব্যবহার করা যায়। সজিনা থেকে তৈরি কয়েকটি বিশেষ খাবারের রেসিপি হলো-মসুর ডালে সজিনা, সজিনা লাউ নিরামিষ, সজিনা পাতার পাকোড়া, আলু সজিনার তরকারি, সজিনা দিয়ে ইলিশ মাছ, চিংড়ি নারিকেলে সজিনা মালাইকারি, আম সজিনার ঝোল, দই সজিনা, সজনে পাতার সবুজ ভাত, সজনে পাতার সবুজ রুটি, পেলকা ইত্যাদি।
×