ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভেঙ্গে পড়েছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নেপথ্যে চাঁদাবাজি

যানবাহন নৈরাজ্যের লীলাভূমি ময়মনসিংহ

প্রকাশিত: ১০:১৯, ২৫ জুন ২০১৯

 যানবাহন নৈরাজ্যের লীলাভূমি ময়মনসিংহ

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ আহমদ তৌফিক চৌধুরী রচিত ‘শহর ময়মনসিংহ’ থেকে জানা যায়, ১৯৩৮ সালে জনৈক ব্যক্তি ময়মনসিংহ শহরে দুটি রিক্সা আমদানি করেছিলেন। সেই রিক্সা দেখা ও তাতে উঠে ঘুরে বেড়ানোর জন্য মানুষের ভিড় লেগে যেত। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা এবং গ্রাম থেকে আসা মানুষজন সখ করে এই রিক্সায় আরোহণ করে শহর চক্কর দিত। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নগরী ময়মনসিংহে বর্তমানে অসংখ্য রিক্সার ভিড় অসহনীয়। রাস্তা পার হওয়া যায়না বাহারি রিক্সার দাপটে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুহাম্মদ রিয়াজুল ইসলাম জানান, ময়মনসিংহ শহরে রিক্সা আমদানির আগে প্রথম অবস্থায় চলাচলের জন্য কোন যানবাহনই ছিল না। পরবর্তীতে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়। ব্যক্তিগত টমটম এবং গণপরিবহনের জন্য পালকি সদৃশ্য দুই ঘোড়ার গাড়ি ছিল। ঘোড়ার গাড়ির প্রধান আড্ডা ছিল শহরের গাঙিনাপাড়ে। বর্তমানে ওই জায়গায় মসজিদ, হকার মার্কেট ও প্রবাহ বিদ্যা নিকেতন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শহরবাসীর মল বহনের জন্য মহিষ টানা কয়েকটি গাড়ি ছিল, পরে যোগ হয় কয়েটি মোটর ট্রাক। ভারতের সীমান্ত প্রদেশ ও এলাহাবাদ থেকে আনা ‘মেথর’ শহরবাসীর মল সংগ্রহ করে ভোর রাতে রাস্তার পাশের পিপায় রেখে যেত। দিনের বেলায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে এই মল বহন করে দূরে নিয়ে যাওয়া হতো ফেলার জন্য। মহিষ টানা কিংবা সেই ঘোড়ার গাড়ির আজ হদিস নেই। এই জায়গা দখল করেছে রিক্সা, অটোরিক্সা, সিএনজি অটোরিক্সা, মাহিন্দ্র, পালকি, টেম্পো, ট্রাক, বাসসহ বাহারি নামের যানবাহন। আর অনুমোদন ও নিয়ন্ত্রণহীন এসব যানবাহনের কারণে নৈরাজ্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে শিক্ষা নগরী ময়মনসিংহ। ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮৭ সালের পহেলা মে। প্রথমে ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের নাম ছিল নাসিরাবাদ। ১৭৮৭ থেকে ২০১৯ সাল-এ সময়ে প্রথম শ্রেণীর ময়মনসিংহ পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হয়েছে গত ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে। দুই দশমিক ১৫ বর্গমাইলের ময়মনসিংহ পৌরসভা সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হয়ে এর আয়তন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০ বর্গকিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা ৩৩টি। আর লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক। ২৫ মাইলের রাস্তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ কিলোমিটার। রাস্তাঘাটের সঙ্গে গাণিতিক হারে বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যা। বেড়েছে ভোগান্তিও। নগরজুড়ে যানবাহনের নৈরাজ্য ॥ নগরজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন সিএনজি অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, ইজিবাইক, মাহিন্দ্র ও টেম্পো। এসব যানবাহনের চালক ও প্রভাবশালী মালিকেরা নগরীর যেখানে সেখানে খেয়াল খুশিমতো গড়ে তুলেছে বিভিন্ন স্ট্যান্ড। ফলে নগরজুড়ে যানবাহনের নৈরাজ্য স্থায়ীরূপ নিয়েছে। এমতাবস্থায় যানবাহনের নৈরাজ্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে ময়মনসিংহ নগরী। এতে দিনভর যানজটে নাকাল হচ্ছে শিক্ষার্থী ও কর্মজীবী মানুষসহ নগরবাসী। সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না কেউই। এ নিয়ে চরম ক্ষুব্ধ ও হতাশ ময়মনসিংহের নাগরিক নেতৃবৃন্দসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, পুলিশ আর নামধারী শ্রমিকদের বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণেই শৃঙ্খলা নেই যানবাহনে। ময়মনসিংহ ট্রাফিকের পরিদর্শক (প্রশাসন) কাজী আসাদুজ্জামান জানান, আমি নতুন এসেছি। সিটি কর্পোরেশন, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকসহ নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করব। নগরীর রাস্তার ওপর যত্রতত্র অবৈধ স্ট্যান্ড ॥ নগরীর চরপাড়া মোড় থেকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ পর্যন্ত ব্যস্ততম চারলেন মহাসড়কের প্রায় ৩০০ মিটার দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে সিএনজি অটোরিক্সা, মাহিন্দ্র ও এম্বুলেন্স স্ট্যান্ড। ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সামনে চারলেন মহাসড়কের এক লেন দখল করে এভাবে স্ট্যান্ড গড়ে উঠা নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতবাক নগরবাসী। এই স্ট্যান্ডের কারণে প্রতিদিন যানজটের কবলে পড়ছে নগরবাসী। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসা রোগীদের এই যানজট পার হয়ে আসতে হচ্ছে। ফলে রোগীদের ভোগান্তির কোন সীমা থাকছে না। ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের দাবি চরপাড়া মোড়ে কোন স্ট্যান্ডের অনুমোদন দেয়া হয়নি। নগরীর পাটগুদাম ব্রিজ মোড়, আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টার লেভেল ক্রসিং, টাউনহল মোড় ও সরকারী মুমিনুন্নিসা মহিলা কলেজের সামনেসহ অসংখ্য জায়গায় গড়ে উঠেছে অনুমোদনহীন বিভিন্ন স্ট্যান্ড। যানজট নিরসনে পাটগুদাম ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ মোড়ে কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তা সম্প্রসারণ করেছিল ময়মনসিংহ সড়ক বিভাগ। এই জায়গা জবরদখল করে গড়ে তোলা হয়েছে সিএনজি অটোরিক্সা ও মাহিন্দ্র পরিবহনের স্ট্যান্ড। ভেঙ্গে পড়েছে ট্রাফিক ব্যবস্থা ॥ ট্রাফিক পুলিশ আর মাস্তান চরিত্রের নামধারী শ্রমিকদের বেপরোয়া চাঁদাবাজির কারণে ভেঙ্গে পড়েছে ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। নগরীর প্রতিটি অনুমোদনহীন স্ট্যান্ড ঘিরে চলছে এই চাঁদাবাজি। দিনের বেলায় ব্যস্ততম নগরীতে পণ্যবাহী ট্রাকের অবাধ যাতায়াত, মালামাল লোড আনলোড, উল্টো পথে যানবাহনের যাতায়াতে নেই কোন মানা। যানবাহনের চালকরা কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে কোন তোয়াক্কা করছে না। ফলে নগরজুড়ে সৃষ্ট যানজটে প্রতিদিন নাকাল হচ্ছে নগরবাসী। দিনে দুপুরের ওপেন সিক্রেট এই চাঁদাবাজির কথা অনেকে জানলেও জানেনা কেবল পুলিশ! ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন চাঁদাবাজির ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন,‘ চাঁদাবাজদের সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে’। ময়মনসিংহ জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নজরুল ইসলাম জানান, সিএনজি অটোরিক্সা, মাহিন্দ্র ও থ্রি হুইলার স্ট্যান্ডের চিহ্নিত চাঁদাবাজরা শ্রমিক ইউনিয়নের কেউ নন। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল, তারাকান্দা ও ত্রিশালসহ প্রতিটি থানায় সিএনজি অটোরিক্সা ও মাহিন্দ্র পরিবহন চালকদের প্রত্যেককে ২০০ টাকা হারে মাসোহারা গুনতে হয়। এসবের বাইরে প্রতিটি সিএনজি অটোরিক্সা ও মাহিন্দ্র পরিবহনকে প্রত্যেক মাসে অন্তত একবার থানায় কিংবা পুলিশ ফাঁড়িতে গাড়িসহ সেবা দিতে হয়। তারপরও মামলা ও জরিমাণার খড়ক থেকে রেহাই পাচ্ছে না সিএনজি অটো রিক্সার চালকরা। পিছিয়ে নেই পোশাকি ট্রাফিক পুলিশও! ॥ চাঁদাবাজিতে পিছিয়ে নেই ট্রাফিক পুলিশও। অভিযোগ রয়েছে, টিএসসআই রাজ্জাক, নুরু, দেলোয়ার, রেকার ইনচার্জ এটিএসআই জসিম, রেকার চালক মোস্তফা ও নুরু, অবসরপ্রাপ্ত কনস্টেবল মুনসুর ওরফে ক্যাশিয়ার মুনসুর যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করে আসছে। টিএসআই রাজ্জাক, নুরু ও দেলোয়ার গত এক যুগ ধরে ঘুরে ফিরে ময়মনসিংহে কর্মরত। টিএসআই রাজ্জাক সিএনজি অটোরিক্সা ও মাহিন্দ্রসহ আটক করা যানবাহনের মামলা জরিমানার বিষয়টি দেখভাল করে আসছেন। চালকদের অভিযোগ মামলার পর জরিমানা করা হলেও তাদের কোন রসিদ দেয়া হয় না। তবে চাঁদাবাজির অভিযোগ স্বীকার করেননি ট্রাফিক পুলিশের কোন সদস্য। পুলিশের নজর কেবল মোটরসাইকেলে ॥ নগরজুড়ে যানবাহনের নৈরাজ্য চললেও পুলিশের দৃষ্টি কেবল মোটরসাইকেলের ওপর। প্রতিদিন নগরের মোড়ে মোড়ে চেক পোস্ট করে মোটরসাইকেল থামিয়ে কাগজপত্র তল্লাশি ও জরিমানা আদায়ের প্রতিযোগিতা চলছে। পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেনের দাবি-গত ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে চলতি সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৮৯০টি রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরসাইকেল চালককে জরিমানাসহ রেজিস্ট্রেশন করতে বাধ্য করা হয়েছে। সিটি মেয়র যা বলেন ॥ নবগঠিত ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র ইকরামুল হক টিটু শপথ নেয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, যত্রতত্র অবৈধ স্ট্যান্ড ও নগরীতে অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল বন্ধে পুলিশ প্রশাসনকে একাধিকবার লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে নির্বিকার। এ নিয়ে মেয়র ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, পুলিশের ‘শাপলা’ ‘শালুক’সহ নানান স্টিকার নিয়ে নগরীতে অবাধে চলছে অনুমোদনহীন অসংখ্য যানবাহন। আর এই কারণেই যানজটে নগরবাসীর ভোগান্তি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। সমস্যা সমাধানে পরিকল্পনা করে নতুনভাবে উদ্যোগ নেয়ার কথাও জানান এই নগরপিতা। ময়মনসিংহ পুলিশ প্রশাসন যা বলে ॥ ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন জানান, ময়মনসিংহ সিটিতে পুলিশ প্রশাসনের কোন কর্তত্ব নেই। কী ধরনের যানবাহন নগরীতে চলাচল করবে কিংবা কোথায় কোথায় স্ট্যান্ড হবে সেটি নির্ধারণ করতে সিটি কর্পোরেশন। এই ক্ষেত্রে সিটি মেয়র চাইলে পুলিশ সহায়তা দেবে। এ নিয়ে ময়মনসিংহ সিটি মেয়রের পত্রের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পুলিশ সুপার জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি খোঁজ নেবেন। তবে রেজিস্ট্রেশন ও রুট পারমিট ছাড়া কীভাবে যানবাহন রাস্তায় চলছে প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার জানান, এটি দেখার দায়িত্ব বিআরটিএ এর স্থানীয় কর্তৃপক্ষের। পুলিশ কেবল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নিয়ে কাজ করে থাকে বলে জানান তিনি। ময়মনসিংহ নাগরিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ॥ ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান যানবাহনের নৈরাজ্য নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, পুলিশ প্রশাসনের লাগামহীন দুর্নীতি আর টোকেন বাণিজ্যের কারণেই সমস্যা প্রকট হচ্ছে। পুলিশের নাকের ডগায় রেজিস্ট্রেশন ও রুট পারমিট ছাড়া অনুমোদনহীন সিএনজি অটোরিক্সা, মাহিন্দ্র, পালকি ও মারাত্মক পরিবেশ দূষণের অভিযোগে রাজধানী ঢাকা থেকে বের করে দেয়া নিষিদ্ধ টেম্পোর অবাধে চলাচল নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে এই নাগরিক নেতা আরও বলেন, পুলিশ প্রশাসনের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই এ দিকে তাদের দৃষ্টি নেই। ফলে নগরজুড়ে যানবাহনের নৈরাজ্য চলছে। অথচ পুলিশ ব্যস্ত মোটরসাইকেল আরোহীর হেলমেট ব্যবহার নিয়ে! বাংলাদেশ রুট ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএর বক্তব্য ॥ বাংলাদেশ রুট ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ এর স্থানীয় সহকারী পরিচালক আব্দুল খালেক যানবাহনে নৈরাজ্যের কথা অকপটে স্বীকার করে জানান তাদের লোকবল সঙ্কটের কথা। ফলে সড়কে অনুমোদনহীন রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস ছাড়া যানবাহন চলাচল পরীক্ষায় তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা যাচ্ছে না দাবি করে এই কর্মকর্তা আরও জানান, সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে খুব শীঘ্রই স্থানীয় প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনের সহায়তায় অভিযান চালানো হবে।
×