ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর ১৩০ পয়েন্টে বাস থামে না, চালক পথচারী সবাই বেপরোয়া

প্রকাশিত: ১০:৫৬, ২৫ জুন ২০১৯

  রাজধানীর ১৩০ পয়েন্টে বাস থামে না, চালক পথচারী সবাই বেপরোয়া

রাজন ভট্টাচার্য ॥ শত চেষ্টার পরেও ঢাকার গণপরিবহনে খুব একটা শৃঙ্খলা ফেরেনি। গাড়ি চলে চালকের ইচ্ছামতো। তাই যাত্রী ওঠানামাও নিয়মের মধ্যে আনা সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীর ১৩০ পয়েন্টে বাস থামার স্থান নির্ধারণ করা হলেও সড়কের চিত্র ভিন্ন। খুব কম বাসই আছে নির্ধারিত স্থানে থামে। যে কেউ হাত উঁচু বা ইশারা করলেই বাসে ওঠা যায়। সড়কে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েও যত্রতত্র পথচারী পারাপার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। শুধুমাত্র নিজেদের সুবিধামতো চলাচল করতে রাজধানীর অনেকস্থানে সড়ক দ্বীপের কাঁটাতারের বেড়া কেটে ফেলা হয়েছে। কেটে দেয়া হয়েছে স্টিলের রেলিংও। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হয়ে অনেকে বাসে ওঠেন। যাত্রী নিরাপত্তায় বিমানবন্দর সড়কে রোড ডিভাইডারের ওপর দেয়া হচ্ছে স্টিলের বেড়া। এই বিবেচনায় পথচারীদের বেপরোয়া আচরণও বন্ধ হয়নি। অথচ বিআরটিএ ও মহানগর ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান চলমান রয়েছে। ২৩ জুন পর্যন্ত এ মাসে ১৫ দিনের পুলিশী অভিযানে ৯০ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। অর্থাৎ দিনে মামলা হয়েছে ছয় হাজার। অভিযানে ডাম্পিং করা হয়েছে দুই শতাধিক গাড়ি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ট্রাফিক আইন অমান্য ও উল্টোপথে গাড়ি চালানোয়। পুলিশ বলছে, মামলা ও জরিমানায় সঙ্কট সমাধান হবে না। এজন্য জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন বাস টার্মিনালকেন্দ্রিক সভার আয়োজন করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় পথসভা, সচেতনতামূলক পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ কার্যক্রম চলছে। সড়কের বাঁ পাশের লেনে হলুদ রঙ দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করা। এর মাঝখানে লেখা রয়েছে বাস থামবে। কোথাও বাংলা কোথাও ইংরেজিতে লেখা। আর ফুটপাথ ঘেঁষে রয়েছে ‘বাস থামবে’ লেখা সংবলিত সাইনবোর্ড। সঙ্গে আধুনিক যাত্রী ছাউনি। ডিএমপির পক্ষ থেকে বাস থামানোর স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (সিএএসই) শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে আধুনিকমানের বসার স্থান নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। রাজধানীর বেশিরভাগ সড়কের এখন এমনই চিত্র। মূলত পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে এই উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তবতা হলো অন্তত পঞ্চাশের বেশি পয়েন্ট ঘুরে দেখা গেছে নির্দিষ্ট স্থানে বাস থামে না। চালকের ইচ্ছামতো এখনও বাস চলাচল করে খোদ রাজধানীতে। যেখানে ইচ্ছা থামানো, যাত্রী ওঠানো, দুই বাসের রেষারেষি এখনও সড়কের নিয়মিত চিত্র। ফলে সড়ক দুর্ঘটনাও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। গতবছরের ২৯ জুলাই হোটেল রেডিসনের সামনে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে জাবালে নূর পরিবহনের বাস চাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশের প্রতিটি স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে। দেশব্যাপী নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবি ব্যাপক মাত্রা ছড়ায়। এই ঘটনায় নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই হস্তক্ষেপ করেছিলেন। নিরাপদ সড়কের জন্য দেয়া হয়েছিল ২৩ দফা নির্দেশনা। কিন্তু কাজের কাজ খুব একটা হয়নি। কাগজে-কলমে সেই নির্দেশ বাস্তবায়নে কিছুদিন তোড়জোড় দেখা গেলেও সড়ক দুর্ঘটনা রোধ দেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রাজধানীতে ১৩০ বাস স্টপেজ নির্মাণ করতে বলা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সে অনুযায়ী ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করা স্থানগুলোতে দুই সিটি কর্পোরেশন বাস স্টপেজ নির্মাণও করে। কিন্তু সেসব স্টপেজে গাড়ি দাঁড়াতে এবং যাত্রী ওঠানামা করতে দেখা যায় না। সিটি কর্পোরেশন বিষয়টি জানিয়ে পুলিশ, পরিবহন মালিক সমিতি ও বিআরটিএকে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর পরিবহন মালিক ও চালকদের আইন পালনে বাধ্য করতে পুলিশকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তবে পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিষয়ে পুলিশ, বিআরটিএসহ বাস মালিক সমিতির দৃশ্যমান তৎপরতাও দেখা যায়। অথচ বাস্তবে তৎপরতার খুব একটা সুফল মিলছে না। সরেজমিন দেখা গেছে, বাস স্টপেজ নির্মিত হলেও সেখানে গাড়ি থামা নিশ্চিত করতে পুলিশের পক্ষ থেকে কোন ভূমিকা নেই। ফলে চালকের স্বেচ্ছাচারিতা বাড়ছে। সোমবার রাজধানীর বাসাবো, খিলগাঁও, মালিবাগ, মতিঝিল, খিলক্ষেত, রেডিসন হোটেলের সামনে, মহাখালীসহ বিভিন্ন স্পটে নির্ধারিত স্থানে বাস না থামতে দেখা গেছে। এসব স্থানে বাস থামানোর জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে কোন তৎপরতাও দেখা যায়নি। চালক যেমন বাধ্য নয় তেমনি চালককে জোর করে বাধ্য করাও হচ্ছে না। এসব বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা নির্দেশ দিয়েছি, নির্ধারিত স্থান ছাড়া যাত্রী ওঠানামা না করতে। চুক্তি বা টার্গেটভিত্তিক কোন যান চালানো যাবে না। চালানোর সময় দরজা বন্ধ রাখতে হবে। প্রতিমাসে চালক ও হেলপারদের সঙ্গে মালিকদের মতবিনিময় করতে হবে, যারা এসব করবে না আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এর আগে অনেক চালক, মালিক ও হেলপারকে পুলিশে দেয়া হয়েছে। অনেকের সাংগঠনিক নিবন্ধন বাতিল করেছি। তিনি বলেন, দীর্ঘদিনের সমস্যা অল্প সময়ে শেষ করা যাবে না। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ’১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে পৃথক দু’টি চিঠি দেন। ট্রাফিক বিভাগ থেকে নগরীতে বাস স্টপেজ নির্মাণের জন্য দুই সিটি কর্পোরেশনকে ১৪০ স্থান চিহ্নিত করে দেয়ার বিষয়টি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে দক্ষিণে ৭০ এবং উত্তর সিটিতে ৭০ স্থান রয়েছে। বাস স্টপেজ নির্মাণের পাশাপাশি ৩৮ স্থানে যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে ২৮ দক্ষিণ সিটিতে এবং দশটি উত্তরে। আরও ১২ যাত্রী ছাউনি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সোমবার খিলগাঁও, সবুজবাগ বিশ্বরোড এলাকার পুলিশ ফাঁড়ি সংলগ্ন বাস স্টপেজে দেখা গেছে, স্টপেজ থাকলেও ফ্লাইওভারের গোড়াসহ সড়কের বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রী ওঠানামা হচ্ছে। নির্ধারিত স্থান থেকে দুই-একটি বাসকে যাত্রী তুলতেও দেখা যায়। একই অবস্থা দেখা গেছে, মালিবাগ রেলগেট সংলগ্ন স্টপেজে। এই স্টপেজে কোন যানবাহনকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। লাব্বায়েক ও এমএন লাভলী পরিবহনের যাত্রীরা জানিয়েছেন, বাসাবো বৌদ্ধমন্দির থেকে যাত্রী তোলার পর ১১ গজ দূরত্বে বাস স্টপেজে ফের গাড়ি থামে। সেখান থেকে বাসাবো স্টপেজ হয়ে ফ্লাইওভার পার হয়ে অন্তত চারবার বাস থামে। অথচ উড়াল সড়ক থেকে নামার পর ১০০ গজ সামনে নির্ধারিত বাস স্টপেজ দেয়া আছে। মতিঝিল, শাহবাগ, পল্টন, ফার্মগেট, বাড্ডা, নতুনবাজার সহ সব এলাকার চিত্র একই রকমের। চালকরা বলছেন, বাস স্টপেজের বিষয়ে তারা যেমন সচেতন নন তেমনি যাত্রীরাও। তাই যেখানেই যাত্রীদের দেখা মেলে সেখান থেকেই ওঠানো হয়। যাত্রীদের ইচ্ছামতো না নামালে নানা কথা শুনতে হয়। তাই যেখানে সেখানে বাস থামানোর প্রবণতা থামছে না। ডিএসসিসির ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব খাদেম বলেন, ‘বাস স্টপেজ নির্মাণের জন্য পুলিশ আমাদের ৭০ স্থানের তালিকা দিয়েছে। প্রতিটি স্থানেই বাস স্টপেজ নির্মাণ করে দিয়েছি। দুই সিটিতে ৩৮ যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা করা হয়েছে। এগুলো যাত্রীবান্ধব। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আমরা বাস স্টপেজ ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করে দিলেও কোন পরিবহনই সেই নিয়ম মানছে না।’ উল্টোপথে চলা ও ট্রাফিক আইন ভঙ্গে বেশি মামলা ॥ ট্রাফিক আইন মেনে চলতে নানা কৌশল ও প্রচার চালানো অব্যাহত আছে। তেমনি ভিআইপিসহ সাধারণ মানুষ উল্টোপথে গাড়ি নিয়ে চলাচল করায় সম্প্রতি তোলপাড় হয়েছে গণমাধ্যমে। তবুও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। ১৩ জুন উল্টোপথে চলায় ১ হাজার ৫৭ বেশি মামলা, ১৫ জুন একই অপরাধে এক হাজার ২৪৩, ১৭ জুন একই অপরাধে এক হাজার ৭৪৯ মামলা হয়। ২২ জুন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ৭ হাজার ২০৯ মামলা ও ৩১ লাখ ৭৮ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা করেছে ট্রাফিক বিভাগ। এছাড়াও অভিযানকালে ৩৭ গাড়ি ডাম্পিং ও ৭৬৩ গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।
×