ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বহুতল আবাসন, শুদ্ধ অক্সিজেন এবং বিপন্ন পরিবেশ

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২৬ জুন ২০১৯

বহুতল আবাসন, শুদ্ধ অক্সিজেন এবং বিপন্ন পরিবেশ

বন বিভাগের বাংলোর বিস্তৃত লনে দাঁড়িয়ে একের পর এক গাছের নাম বলে যাচ্ছেন বন কর্মকর্তা। একেকটা নাম যেন স্মৃতির দরজায় টোকা দিয়ে নিয়ে যায় শৈশব-কৈশরে। সকালের সোনারোদে ঘাস ফড়িঙের পেছনে ছোটা, সন্ধ্যায় সূর্যের আলো নেভার পর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক অথবা হেমন্তের দুপুরে নরম তুলোর মতো ভেসে যাওয়া মেঘ-কত দৃশ্য কত স্মৃতি! দুদিনের ছুটিতে প্রাকৃতিক পরিবেশে পা রাখতেই মন কেমন করে ওঠে! সেই লেবু পাতায় রোদ ছায়ার খেলা, বন তুলসীর অকারণ বেড়ে ওঠা, গাঢ় সবুজ কচু গাছের বুকচিরে বেরিয়ে আসা লাল ফুল। দল বেঁধে শৈশব ভিড় করে চারপাশে। মনে হয় এইসব কিছু এই সোঁদা মাটি, আশ শ্যাওড়া, তুলসী, কচু সব যদি নেয়া যেত দুই হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে। বারান্দার রেলিং ঘিরে ছোট-বড় অসংখ্য টব। নানা প্রজাতির পাতাবাহার, ক্যাকটাস থেকে শুরু করে দোপাটি, নয়নতারা, জারুল, হাস্নুহানা শুধু নয়, নিম, তুলসী, মেহেদির মতো ঔষধী গাছও রয়েছে তাতে। বিশাল ফ্ল্যাটে এক চিলতে অক্সেজেন ফ্যাক্টরি কিংবা সবুজে ছাওয়া আঙ্গিনা। প্রকৃতির কোল থেকে বিচ্ছিন্ন নগরবাসীর কেউ কেউ গভীর মমতায় এভাবেই আঁকড়ে রেখেছে রাখে। আক্ষেপ না, ঢাকার এই যানজট ঘনবসতি থেকে দূরে গেলে মন উদাস হয়ে যায় নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসে কিন্তু বাস্তবতাকে একটুও উপেক্ষা করা যায় না। শহরের দিগন্ত ছেয়ে ফেলা উঁচু ভবন তৈরির পেছনের কারণ বা পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক বহু আছে, কিন্তু বসবাসের বাস্তবতা অস্বীকার করে না বলে অনেকেই নিজের আবাস নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। রাজধানীর পশ এলাকায় ২০ তলা এ্যাপার্টমেন্টের ১২ তলা। দুই হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। দক্ষিণমুখী দুটো বারান্দাসহ মোট তিনটা বারান্দা। দীর্ঘ ফয়ারের প্রান্তে খোলা জানালা তাও দক্ষিণমুখী। ড্রয়িং, ডাইনিংয়ে সরাসরি বাতাস খেলে যায়। বাড়ির মালিক স্বামী-স্ত্রী দু’জনই মস্ত ব্যবসায়ী। প্রচুর টাকা তাদের। শহরের বাতাসে ধুলোবালি, কার্বন ডাই-অক্সাইড। তারা চান না তাদের ঘরে এসব আসুক। তাই পুরো বাড়ি কাঁচে মুড়ে সেন্ট্রাল এসি করিয়ে নিয়েছেন। যখন তখন বৃষ্টি এসে বারান্দা ভিজিয়ে প্যাচ প্যাচে করে দেয় বলে বারান্দায়ও কাঁচের পাল্লা লাগিয়েছেন। পুরো শহর তো মুড়ে দেয়া যায় না, তাদের আয়ত্তে যেটুকু আছে তার সুরক্ষা যথাসাধ্য করেছেন। বেঁচে থাকার অপরিহার্য বায়ু অক্সিজেনের উৎস কি? সেন্ট্রাল এসি নাকি ওজনখানেক টব? অনেকে অবশ্য নির্মল বাতাস নিশ্চিত করতে টব বসায় না। তাজা গাছের সবুজ সান্নিধ্যই তাদের বেশি টানে। হোক না ছোট্ট টবে ছোট গাছ তবু তো প্রকৃতির প্রতিনিধি। টবের কাছে গেলে প্রশান্তিতে মন ভরে যায়। ওই প্রশান্তিই হয়ত বেঁচে থাকার অক্সিজেন। ঘরে ঘরে যদি সেন্ট্রাল এসির বন্দোবস্ত হয় তাহলে প্রকৃতির কি হবে? মানুষেরই বা কি হবে? এই যে জলবায়ু গেল, প্রকৃতি গেল বলে এত চেঁচামেচি এর দায় কি শুধু প্রকৃতির খেয়ালের ঘাড়ে চাপিয়ে এড়ানো যাবে? মানুষের দায় তো কোন অংশে কম নয় বরং বেশি। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়ার মূল দায় মানুষেরই। কলকারখানা, নানা ধরনের যানবাহন থেকে অনর্গল বেরোচ্ছে কার্বন ডাই-অক্স্াইড। এসির গরম বাতাসও নির্দোষ নয়। এসি থেকে বেরোনো সিএফসি বা ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন পাকে চক্রে ওই কার্বন মনো অক্স্াইড বা কার্বন ডাই-অক্স্াইডে পরিণত হয়। সেন্ট্রাল এসিকে বলা যায়, উটপাখির বালিতে মুখ লুকানো। এই যে এত বড় বড় এ্যাপার্টমেন্ট হচ্ছে, অবিরাম হয়েই যাচ্ছে এর পরিণতি ভাবা যায় না। বিশেষজ্ঞরা শঙ্কিত। ঘন ঘন ভূমিকম্প হানা দিচ্ছে। ভূস্তরের পানি নেমে যাচ্ছে। জলবায়ুর ধারাবাহিকতা নষ্ট হচ্ছে। তাপ বেশি বেড়ে যাওয়ায় নানা ধরনের দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। গত ১৫০ বছরের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা নাকি এখন সবচেয়ে বেশি। তাপ বেড়ে যাওয়ার কারণেই কোন দেশে বন্যা কোথাও অগ্ন্যুৎপাত আবার কোথাও বরফ গলছে। প্রচ- দাবানলে পুড়ছে রাশিয়ার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। যেসব এলাকায় বন্যা হতো সেখানে দাবানল ছড়িয়ে পড়ায় মানুষ আতঙ্কে ভুগছে। এদিকে এভারেস্টের বরফ গলছে। গ্রীনল্যান্ডের হিমবাহ থেকে একশ’ বর্গমাইল আয়তনের বরফের বিশাল চাঁই ভেঙে পড়েছে। গত পঞ্চাশ বছরে এরকম ঘটনা নাকি এই প্রথম ঘটেছে। এই হিমবাহ থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবছর বরফের চাঁই খসে তবে সেগুলোর আয়তন অনেক ছোট। চীনে হয়ে গেল ভূমিধস ও বন্যা। কি হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের? প্রকৃতিতে প্রতি পঞ্চাশ বছর পর নাকি বড় ধরনের ডিজাস্টার দেখা দেয়। তবে কি সেই পঞ্চাশ বছরের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা? ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতাও নাকি ক্রমশ বাড়ছে এবং তা নাকি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের একজন শিক্ষক একটি দৈনিকে লিখেছেন, ‘সমগ্র পৃথিবীর মানুষ এ মুহূর্তে তাদের সব কর্মকা- বন্ধ করে দিলেও সমুদ্র সমতলের বৃদ্ধি ঘটতে থাকবে। সমস্যা হল সমুদ্র সমতলের বর্তমান বৃদ্ধির হার নিয়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর যেসব জায়গায় পানি জমাটবদ্ধ হয়ে আছে তা আবহাওয়া ম-লের তাপমাত্রা বাড়ার জন্য দ্রুত গলতে শুরু করেছে। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, হিমালয় পর্বতের অন্তত ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ হিমবাহ খুব দ্রুতগতিতে গলছে। গঙ্গোত্রী হিমবাহ, যেখান থেকে গঙ্গা নদীর উদ্ভব সেটি প্রতিবছর প্রায় ২৩ মিটার ক্ষয় হচ্ছে। এভাবে আর্কটিক, এ্যান্টার্কটিক ও বিভিন্ন পর্বতের চূড়ায় জমে থাকা বরফ গলে সমুদ্র তলের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছেÑ ফলস্বরূপ পৃথিবীর যেসব দেশের উচ্চতা সমুদ্র সমতল থেকে খুব বেশি নয় সেগুলো সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য তলিয়ে যেতে পারে। এই তলিয়ে যাওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে।’ ঝম ঝমিয়ে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় টবের গাছপালা। এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে শহুরে কিশোরী ভিজতে ভিজতে হারিয়ে যায় দূরে ... ঘাসে ভরা প্রান্তরে যেখানে আকাশ মিশেছে মাটিতে। গাছেরা সব ভেজা হাওয়ায় মাতাল হয়ে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। ধন্যবাদ এই নির্মাতা কোম্পানিকে। যারা এমন দ?িণমুখী বারান্দা বানিয়েছে। এ শহরে অনেক ফ্ল্যাটে দেখা যায় পরিকল্পনাহীন আর্কিটেকচার। ডিজাইনের জন্য অযথা জায়গা খরচ হয়েছে অথবা অতিরিক্ত কিপটেমির জন্য বসবাসের জায়গা পরিণত হয়েছে দমবন্ধ খোঁয়াড়ে। একটু পরিকল্পনা একটু সৃজনশীলতা যদি খাটানো যায় তাহলে এক চিলতে আবাসেও আনা যায় প্রকৃতির আলো-বাতাস খানিকটা হলেও। যারা এ সব ঘরদোর বানাচ্ছেন এ বিষয়ে তাদের পর্যাপ্ত পড়াশোনা থাকলে ক্রমশ বেড়ে ওঠা এ্যাপার্টমেন্ট কালচার অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক হবে। পরিবেশও রক্ষা পাবে খানিকটা হলেও।
×