ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল হান্নান

সততা ও আদর্শের দৃষ্টান্ত আমার বাবা

প্রকাশিত: ০৯:২১, ২৬ জুন ২০১৯

সততা ও আদর্শের দৃষ্টান্ত আমার বাবা

১৬ জুন ছিল বাবা দিবস। ছেলেমেয়ের জীবনে বাবা-মার অবদান অপরিসীম। সঙ্গত কারণেই এ দিনটি পালন করে বাবাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানানো হয়। এ দিনটিতে আমার বাবার কথা বেশি করে মনে পড়ে। হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান আমার বাবা প্রতিদিন ৫ মাইল হেঁটে লোকের বাড়ি জায়গির থেকে ১০ পয়সার অভাবে গোমতি নদী সাঁতার কেটে পার হয়ে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও লেখাপড়া করে বিএ পাস করেন কেবলমাত্র দৃঢ় মনোবল ও সংকল্পের কারণে। তিনি ছিলেন সৎ, নীতিনিষ্ঠ, নিরহঙ্কার ও আপোসহীন। তার চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যের জন্য আমাদের চরম মাসুল দিতে হয়েছে, তার নিজেকে অনেক অপমান ও হয়রানি ভোগ করতে হয়েছে। আমাদের সংসারে আর্থিক অনটন ও অভাব সহ্য করতে হয়েছে। একদিন একটি লোক আম্মাকে ৫০ হাজার টাকা দিতে চাইল। আম্মা তা নিতে অস্বীকার করলেন। বাবা তখন স্পেশাল পুলিশ স্টাবলিশমেন্টের এসপি। তিনি শুনে বললেন বেশ করেছেন। এক প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ পাটের ব্যবসায়ী যে সরকারের লাখ লাখ টাকা কর ফাঁকি দিয়ে আসছে তাকে আমি ধরেছি। দেখি বেটা কোথায় যায়। দু’দিন পর চীফ সেল্ডেটারি এনএম খাঁর কাছ থেকে তলব এলো। এনএম খাঁ বললেন, কেসটি উঠিয়ে নেন। বাবা বললেন, তা কেমন করে হয়? আমি কেসটির চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করে ফেলেছি। আমাকে মাফ করবেন, স্যার। কিছুদিন পর বাবাকে সরিয়ে ওএসডি করা হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হন গবর্নর ফজলুল হকের ভাগ্নে কবীর। ’৫২ সালে বাবা নোয়াখালীর এসপি। আইজি দোহা পরিদর্শনে এলেন। বাবা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, সিভিল সার্জন ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে ৬ জনের একটি ডিনার দিলেন। দোহা বলল, গতকাল আমি চাটগাঁ ছিলাম। বড় জেলা, বড় ডিনার। এখানে ছোট জেলা ছোট ডিনার। বাবা প্রমাদ গুনলেন। দোহা যথারীতি পরিদর্শনের ‘উপঢৌকন’ না পেয়ে ঢাকা ফিরে গিয়ে বাবাকে তার পদ থেকে নামিয়ে ঢাকার এডিশনাল এসপি করে আদেশ পাঠালেন। বাবার দৃঢ় ন্যায়নীতি ও নিয়ম-নিষ্ঠার জন্য আমাদের সারা জীবন কষ্টের সীমা ছিল না। ’৪৩-এর মন্বন্তর দুর্ভিক্ষে যখন বাংলার ৩০ লাখ মানুষ অনাহারে মারা যায়, তখন বাবা নড়াইলের পুলিশ ইন্সপেক্টর। আমরা দু’বেলা মিষ্টি আলু ও রুটি খেয়ে থেকেছি। একদিন মা বললেন, ছেলেমেয়েরা এসব খেতে চায় না। বড় দারোগা কালী বাবুর বাসায় তো দু’বেলা ভাত রান্না হয়। বাবা বললেন কে কি খায় জানি না। যা জানি তা হলো, লাখ লাখ মানুষ একফোঁটা ভাতের ফ্যানের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরে রাস্তাঘাটে মরে পড়ে রয়েছে। ’৫৬ সালে বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। তখনও আমাদের কারোরই লেখাপড়া শেষ হয়নি। টাকা-পয়সার দারুণ টানাটানি। মা দেরি করে বেলা ৩টা/৪টার সময় রান্না করে আমাদের দুপুরের খাবার দেন। এত দেরি করে রান্না হয় কেন? মাকে জিজ্ঞেস করলে মা বলেন, তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস কর। উনি তো বেলা ১২টার পরে বাজার করতে যান। বাবা বললেন, আরে বাবা ১২টার পর মাছ, তরকারি একটু সস্তায় পাওয়া যায়। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের পর বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে এলেন। ঢাকায় তখনও বিক্ষিপ্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল। আমার সরল আব্বা পুলিশ অফিসার হয়েও আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাকে এবং আমার ভাই মোমেনকে মহকুমা শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তদানীন্তন বিখ্যাত অন্নদা হাইস্কুলে ভর্তি করে দিলেন। মোমেন ভাই ’৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ফরিদপুর চলে গেল। বাবা তখন ফরিদপুরের এসপি। আমি তখন হাফপ্যান্ট পরা নবম শ্রেণীর ছাত্র। ছুটিতে একা ট্রেনে চড়ে নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছে স্টিমার ঘাটে গিয়ে টিকিট কিনে স্টিমারে শুয়ে থাকতাম। পরদিন সকাল ৮টায় স্টিমার ছেড়ে রাত ৮টায় গোয়ালন্দ ঘাটে পৌঁছে আবার ট্রেনে চেপে রাজবাড়ী স্টেশনে নেমে সারারাত ওয়েটিং রুমে বসে থাকতাম। পরদিন সকাল ৮টায় ফরিদপুরের গাড়ি। বাসায় গিয়ে আমি মাকে বললাম যে, একা-একা আসতে আমার ভয় করে। মা বাবাকে বললেন, একজন সেপাইকে তো পাঠাতে পারেন হান্নানকে আনতে। বাবা রুষ্ট হয়ে বললেন, এমন কথা মুখে আনবেন না। সেপাই তো আমার চাকর নয়, সে সরকারী চাকরি করে। জীবনে একলা চলতে হবে। এখন থেকে একলা চলে সাহস অর্জন না করলে কখন করবে? ’৪৬ সালে বাবা তখন নড়াইলে। স্থির করলেন আমি আর মোমেন ভাই কলকাতায় চাচার বাসায় থেকে হেয়ার স্কুলে ইংরেজী মাধ্যমে লেখাপড়া করব। আমরা আনন্দে আত্মহারা। কল্পনায় কলকাতা তখন আমাদের কাছে লন্ডন যাওয়া। কলকাতায় শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে একটা মানুষ টানা রিক্সায় চেপে বসতেই প্রথম ধাক্কাটা খেলাম। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। রিক্সা অনেক রাস্তা পেরিয়ে গলি, তস্য গলির মধ্যে ঢুকে যেতে থাকল। রিক্সা অবশেষে একটা পুরনো ভাঙ্গা দো’তলা বাড়ির নিচে এসে দাঁড়াল। দো’তলায় উঠে দরজা খুলতেই দেখি ৫/৬ জন লোক তাস খেলছে। তারা আমাদের দেখে চিৎকার করে উঠল। ভাতিজারা আইছো? ঘরে ৫টা চৌকি। একটি আমাদের জন্য বাকি ৪টা আনিস চাচা ও তার বন্ধুদের জন্য। পরে জেনেছি এটাকে কেরানীদের মেস বলে। আমাদের হেয়ার স্কুলে পড়া হয়নি। আনিস চাচা আমাদের আলিয়া মাদ্রাসার ইংরেজী বিভাগে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বিকেলে শুনি হৈ-চৈ, তুমুল ঝগড়া। কেউ মোহনবাগান, কেউ মহামেডান স্পোর্টিং-এর সমর্থক। রাত ১২টায় আনিস চাচার বন্ধুরা সিনেমা দেখে এসে বলতে শুনলাম ‘দেবদাস যখন পার্বতীকে বেত মারল তখন মনে হইছিল দেবদাসকে ফালাইয়া দিয়া পার্বতীকে জড়াইয়া ধরি।’ ভাগ্যিস কিছুদিন পর বাবা বদলি হয়ে কলকাতায় এলেন। আমরা অশ্লীল মেস জীবন থেকে নিষ্কৃতি পেলাম। নইলে হয়তো আমরা উচ্ছন্নে যেতাম, নষ্ট হয়ে যেতাম। অবাক লাগে বাবা কত সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল আমরা কলকাতায় ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হব। কিন্তু জানতেন না তার ভাই কি পরিবেশে থাকে। আমার বাবা কখনও গায়ে হাত তুলে আমাদের শাসন করেননি। তার সততা ও আদর্শের দৃষ্টান্ত দিয়ে শাসন করেছেন। তবুও আমরা তাকে খুব ভয় করে চলতাম। জীবনে আমরা কোনদিন তাঁর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সাহস পাইনি। এখন তো ছেলেমেয়েরা বাপের সামনে টেবিলে পা তুলে কথা বলে। সময় বদলেছে। আমরা আধুনিক হয়েছি। আমার মা ছিলেন চিঠি লিখতে পারা স্বল্প শিক্ষিতা বনেদি চৌধুরী পরিবারের মেয়ে। বাসর রাতে সেই যে বাবা একজন অপরিচিতা মহিলাকে আপনি বলে সম্বোধন করে শুরু করেছিলেন তা থেকে তিনি আর কখনও সরে আসতে পারলেন না। এমনই ছিল তাঁর স্ত্রীর প্রতি সম্মানবোধ ও ভালবাসা। তাঁদের বৃদ্ধ বয়সে গভীর রাতে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে রাজ্যের গল্প বলতে শুনেছি। এখন তো বিয়ের পর সব কথা ফুরিয়ে যায়। অর্থ-বিত্ত-বৈভবের প্রতি বাবা চিরকালই উদাসীন ও নির্লিপ্ত ছিলেন। দেশ ভাগের পর বাবা যখন ঢাকায় এলেন তখন হিন্দুরা জমিজমা পানির দরে বিক্রি করে কলকাতায় চলে যাচ্ছিল। মা একটা জমি কিনতে বললে বাবা বলেছিলেন, ওইসব ফেলে যাওয়া জমিতে কষ্ট আছে, দীর্ঘশ্বাস আছে। ওই জমি কিনলে আপনি সুখী হবেন না। অবশেষে ’৫৬ সালে বাবা যখন অবসর নিয়ে আমাদের আত্মীয়ের বাড়ি রেখে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন অপ্রত্যাশিতভাবে তার এক পুরনো বন্ধু, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব পানাউল্লাহ বাবার নামে ধানম-িতে ৫ হাজার টাকা মূল্যে এক বিঘা জমি বাবার নামে বরাদ্দ করে একটা চিঠি নিয়ে এলেন। বাবা বললেন, আমার কাছে ৫শ’ টাকাও নেই। চিঠিটা নিয়ে যান। আপনাকে ধন্যবাদ। মা চিঠিটা নিয়ে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে জমির মূল্যের একটা কিস্তি দিয়ে জমিটির দখল নিলেন। বাবার মৃত্যুর দু’দিন আগে তিনি আমাকে তার পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমাদের এই এক বিঘা জমি দিয়ে গেলাম। আর জমি কিন না। শহরে জনসংখ্যার তুলনায় জমি অপ্রতুল। প্রয়োজনের অধিক জমি তুমি কিনলে অন্যকে বঞ্চিত করবে। আমি ভাবি, বাবা পুলিশ অফিসার না হয়ে শিক্ষক হলে ভাল মানুষ গড়ার কারিগর হতে পারতেন। আজকে আমাদের সমাজ মূল্যবোধের চরম নৈতিক অবক্ষয় ও সঙ্কটে আক্রান্ত। আজকে যখন নষ্ট-ভ্রষ্ট রাজনীতি, প্রতারণা, চাটুকারিতা, দুর্বৃত্তায়ন এবং সীমাহীন দুর্নীতি ও হয়রানিতে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ, বিপর্যস্ত ও বিপন্ন তখন প্রয়োজন প্রত্যেক পরিবারে আমার বাবার মতো সৎ, নিষ্ঠাবান ও নৈতিক সাহসী মানুষ। যাতে সমাজটা বদলে যায়। সুশাসনের সুবাতাস বইতে পারে। আমরা নিরাপদে সুখ, শান্তি ও স্বস্তি ফিরে পাই। আমার বাবা আমার রোল মডেল, প্রেরণা ও আমার বন্ধু। বাবা দিবসে বাবাকে বলি, ‘জীবন ও মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে।’ লেখক : সাবেক কূটনীতিক
×