চারদিকে প্রচ- গরম। মানুষ গরমের উৎপাতে দিশেহারা। বিশেষ করে যাদেরকে বাধ্য হয়ে প্রচ- গরমে খোলা মাঠে চলাফেরা বা কায়িক পরিশ্রম করতে হয়। গরমের অনেক বিপদের মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থার নাম হিট স্ট্রোক।
হিট স্ট্রোক কি?
গরমের দিনের একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত সমস্যার নাম হিট স্ট্রোক। চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা ১০র্৫ ফারেনহাইট ছাড়িয়ে গেলে তাকে হিট স্ট্রোক বলে। তখন শরীর ঘামতে শুরু করে। ঘাম বাষ্পীভূত হয়ে উবে গিয়ে শরীরকে শীতল করে।
স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। পরিবেশের তাপমাত্রা বেড়ে গেলেও শরীর চেষ্টা করে নিজের তাপমাত্রা বজায় রাখতে। কোন কারণে শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে ত্বকের রক্তনালী প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। প্রয়োজনে ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে অনেকক্ষণ থাকলে বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। এক পর্যায়ে প্রচ- গরমে ঘাম ঝরা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শরীর আরও গরম হয়, এতে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায় এবং হিট স্ট্রোক দেখা দেয়।
হিট স্ট্রোক কাদের বেশি হয়?
প্রচণ্ড গরমে ও আর্দ্রতায় যে কারুরই হিট স্ট্রোক হতে পারে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। যেমন :
১. শিশু ও বৃদ্ধ : তাদের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকায় হিট স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিগণ প্রায়ই অন্যান্য রোগে ভুগে থাকেন কিংবা নানা ওষুধ সেবন করেন যা হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
২. যারা দিনের বেলায় প্রচ- রৌদ্রে কায়িক পরিশ্রম করেন, তাদের ঝুঁকি বেশি। যেমন কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক, শিল্পকারখানায় গরম পরিবেশে যারা কাজ করেন।
৩. ভারি বা মোটা কাপড়চোপড় পরে গরমে চলাফেরা করলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
৪. প্রচ- রোদে শিশুরা খেলাধুূলা করলে।
৫. শরীরে পানিস্বল্পতা হলে অথচ প্রয়োজনীয় পরিমাণে পানি বা অন্যান্য কোন পানীয় পান না করলে ঝুঁকি বাড়ে।
৬. কিছু কিছু ওষুধ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষ করে প্রস্রাব বাড়ানোর ওষুধ, বিষণœতার ওষুধ, মানসিক ব্যাধির ওষুধ ইত্যাদি।
হিট স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ কি?
তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রোকের পূর্বে আপেক্ষাকৃত কম মারাত্মক হিট ক্র্যাম্প অথবা হিট এক্সহসশন হতে পারে। হিট ক্র্যাম্পে শরীরের মাংসপেশী ব্যথা করে, দুর্বল লাগে এবং প্রচণ্ড পিপাসা লাগে। এর পরের ধাপে হিট এক্সহসশনে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস, মাথা ব্যথা, ঝিমঝিম করা, বমিভাব, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি দেখা দেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ঠিক থাকে এবং শরীর প্রচণ্ড ঘামতে থাকে। এ অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়া হলে হিট স্ট্রোক হতে পারে। এর প্রধান লক্ষণসমূহ হলো :
১. শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত ১০র্৫ ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়।
২. শরীরের ঘাম নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়। ত্বক শুষ্ক ও লালচে বর্ণের হয়ে যায়, জ্বালাপোড়া করে।
৩. শরীর প্রচ- ব্যথা, দুর্বল লাগা, প্রচ- পিপাসা, নিঃশ্বাস দ্রুত হয়।
৪. নাড়ীর স্পন্দন ক্ষীণ ও দ্রুত হয়। রক্তচাপ কমে যায়। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়।
৫. খিচুনি, মাথা ঝিম ঝিম করা, অস্বাভাবিক ব্যবহার, হ্যালুসিনেশন, অসংলগ্ন আচরণ ইত্যাদি। রোগী শকেও চলে যায়। এমনকি অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
৬. সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগী মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে।
প্রতিরোধের উপায় কি?
প্রচ- গরমের দিনে কিছু সতর্কতা মেনে চললে হিট স্ট্রোকের মতো বিপদ থেকে বেঁচে থাকা যায়। এগুলো হলো :
১. হাল্কা, ঢিলেঢালা কাপড় পরুন। কাপড় সাদা বা হাল্কা রঙের এবং সুতি কাপড় হলে ভাল হয়। শরীর যতটা সম্ভব ঢেকে রাখা ভালো।
২. যথাসম্ভব ঘরের ভিতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন। প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না গেলেই ভাল।
৩. বাইরে যেতে হলে মাথায় চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি, ক্যাপ বা ছাতা ব্যবহার করুন।
৪. বাইরে যারা কাজকর্মে নিয়োজিত থাকেন, তারা মাথায় ছাতা বা মাথা ঢাকার জন্য কাপড় জাতীয় কিছু ব্যবহার করতে পারেন। শিল্পকারখানায় প্রচ- গরমে যারা কাজ করেন, তারা ঢিলেঢালা কাপড় পরবেন। মাঝেমধ্যে গরম পরিবেশ থেকে খোলামেলা হাওয়াযুক্ত স্থানে আসবেন।
৫. প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল পান করুন। মনে রাখবেন, গরমে ঘামের সঙ্গে পানি ও লবণ দুই-ই বের হয়ে যায়। তাই পানির সঙ্গে সঙ্গে লবণযুক্ত পানীয় যেমন খাবার স্যালাইন, ফলের রস, লাচ্ছি ইত্যাদিও পান করতে হবে। পানি অবশ্যই ফোটানো হতে হবে।
৬. তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারী পানীয় যেমন চা ও কফি যথাসম্ভব কম পান করা উচিত।
৭. রোদের মধ্যে শ্রমসাধ্য কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। এসব কাজ সম্ভব হলে রাতে বা খুব সকালে করুন। যদি দিনে করতেই হয়, তবে কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিতে হবে এবং প্রচুর পানি ও স্যালাইন পান করতে হবে।
৮. প্রয়োজনমতো পরিষ্কার পানিতে গোসল করতে হবে এবং শরীরের ঘাম রুমাল বা তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেলতে হবে।
আক্রান্ত হলে কি করণীয়?
প্রাথমিকভাবে হিট স্ট্রোকের পূর্বেই যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেই যা করতে পারেন তা হলো :
১. দ্রুত শীতল কোনও স্থানে চলে যান। যদি সম্ভব হয়, ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন। সম্ভব না হলে অন্তত তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করতে পারেন।
২. ভেজা কাপড়ে শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করুন।
৩. প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। চা বা কফি পান করবেন না।
কিন্তু যদি হিট স্ট্রোক হয়েই যায়, তবে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে, ঘরে চিকিৎসা করার কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে রোগীর আশপাশে যারা থাকবেন তাদের করণীয় হলো :
১. রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে বা গাছের নিচে নিয়ে যান।
২. শরীরের কাপড় খুলে দিন বা ঢিলে করে দিন।
৩. শরীর পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে বাতাস করুন। সম্ভব হলে ভেজা কাপড়ে শরীর মুছে ফেলতে হবে। এভাবে তাপমাত্রা কমাতে থাকুন।
৪. সম্ভব হলে কাঁধে, বগলে ও কুচকিতে বরফ দিন।
৫. রোগীর জ্ঞান থাকলে তাকে খাবার স্যালাইন বা লবণ মিশ্রিত পানি পান করতে দিন।
৬. অজ্ঞান হয়ে গেলে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করুন।
৭. সব সময় খেয়াল রাখবেন হিট স্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাস প্রশ্বাস এবং নাড়ি চলছে কি-না। প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হতে পারে।
হিট স্ট্রোকে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে। তাই এই গরমে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে এর থেকে বেঁচে থাকা উচিত।
লেখক : সাবেক ডিন ও চেয়ারম্যান, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: