ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৭১-এর এই দিনে ॥ ২৬ জুন, ১৯৭১ ॥ ভাওয়ালিয়াবাজুর ঘাট প্রতিরোধযুদ্ধ

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ২৬ জুন ২০১৯

৭১-এর এই দিনে ॥ ২৬ জুন, ১৯৭১ ॥ ভাওয়ালিয়াবাজুর ঘাট প্রতিরোধযুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২৬ জুন দিনটি ছিল শনিবার। বাংলায় স্বাভাবিক অবস্থা বাঙালীরাই ফিরিয়ে আনবে। সমগ্র বাঙালী জাতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যেÑ কোটি বাঙালীর নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করবে। হানাদার বাহিনীকে বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করবে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করে, ২৪ বছরের অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রতিশোধ ও ক্ষতিপূরণ আদায় করে বাংলায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবেই। এদিন ময়মনসিংহে হাবিলদার রেফাজউদ্দিন এক প্লাটুন যোদ্ধা নিয়ে মুক্তাগাছা থানা আক্রমণ করেন। থানায় প্রহরারত পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তাগাছা থানা দখলে সমর্থ হয় এবং এতে অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়। এ সংঘর্ষে ৪ জন পুলিশ নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। কুমিল্লার সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ কাফলাতলী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এতে কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় ও ক্যাম্প মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। সিলেট-তামাবিল সড়কে শ্রীপুর নামক এলাকা শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে সুবেদার বি আর চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের পরপরই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পিছু হটে। এতে জাফলং থেকে শ্রীপুর পর্যন্ত এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে এসে যায়। মেজর আফছারের নেতৃত্বে ভাওয়ালিয়াবাজু যুদ্ধে ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান শহীদ হন। মেজর আফছারের নেতৃত্বে বাটাজোর, বড়চালা, সোনাখালি, পাড়াগাঁও যুদ্ধ অন্যতম। চিলির প্রেসিডেন্ট ড. সালভেদর আলেন্দে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে প্রেরিত পত্রে ভারত আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের নাগরিকদের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে অবিলম্বে শরণার্থীদের সম্মানজনকভাবে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। জামায়াত নেতা গোলাম আযম বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানের মর্যাদার ওপর আঘাত হেনেছে।’ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ নাটোর সফর করেন। নাটোরের স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতারা জেনারেল হামিদকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘তারা বেঁচে থাকতে দুষ্কৃতকারীরা (মুক্তিযোদ্ধা) নাটোরে স্থান পাবে না।’ ভারতে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশের শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৯৮ জন। দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের বিবৃতি উল্লেখ করে লিখেন, ’বাঙালীর কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধানই সঙ্কট নিরসনের পথ বলে মনে করে বিশ্বশক্তিগুলো। জনাব শরণ সিং সংসদে বলেন, সম্প্রতি তিনি কয়েকটি দেশ পরিদর্শন করেন এবং তারা মনে করেন পূর্ববাংলার জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন কোন পদক্ষেপ নিলেই কেবল উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধান করা সম্ভব। আরও কিছু বিষয় চুক্তিতে উঠে আসে। বাংলাদেশে সব রকম সামরিক কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, উদ্বাস্তু প্রবাহ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে তাদের বাড়িতে ফিরে আসার অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে। এতে করে শরণার্থীরা বাংলাদেশে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে নিরাপদে ফিরে যেতে পারবে। বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ এবং তা এ অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি বলেন, বিশ্বনেতারা এটা একমত হয়েছিলেন যে পূর্ববাংলা থেকে ভারতের অভ্যন্তরে ছয় মিলিয়ন উদ্বাস্তুর এই বিশাল অন্তঃপ্রবাহ সরকারের জন্য অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। মনুষ্যসৃষ্ট এই দুর্যোগে এই দেশে আসা পূর্ববাংলার জনগণের জন্য এখানকার পরিস্থিতিও গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এটি আমাদের ওপর একটি বিশাল বোঝা। এর ফলে এই অঞ্চলের শান্তি এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না- সেটি তাদের অবগত করা হয়েছে। বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণকে আন্তর্জাতিক নজরদারির মাধ্যমে দেয়া মানবিক সহায়তা ছাড়া অন্য যে কোন ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা দিলে সেটা কেবল সেদেশের সংখ্যালঘু সামরিক জান্তা, যারা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে, তাদের ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করবে, এবং এটা হবে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি দুর্ভাগ্যজনক হস্তক্ষেপ। তিনি ৬ জুন থেকে ২২ জুনের মধ্যে, মস্কো, বন, প্যারিস অটোয়া, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং লন্ডন সফর করেন। এসব রাজধানীতে প্রতিটি সরকারপ্রধান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। দৈনিক কালান্তর প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও সামরিক শিক্ষাসহ সর্বপ্রকার সাহায্য করতে হবে’- ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য পরিষদের এক বিবৃতিতে এই দাবি করেন। অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য দাবি জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখার জন্য এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ও শরণার্থীদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, সমর্থক এবং জনসাধারণকে আহ্বান জানিয়েছেন। অধিবেশন শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন ও সংহতি জানানো সারা ভারতবর্ষের জনগণের এখন জরুরী কর্তব্য বলে কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পরিষদ মনে করেন। প্রায় ষাট লক্ষাধিক মানুষ ইয়াহিয়ার অত্যাচারের মুখে দেশ ছেড়ে শরণার্থী হিসেবে এসেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা যাতে তাদের দেশকে যথাসত্বর মুক্ত করতে পারেন তার জন্য তাদের অস্ত্র, সামরিক শিক্ষা ও অন্যান্য সম্ভাব্য সর্বপ্রকার সাহায্য করতে হবে। এর ফলেই গৃহহীন মানুষ তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারবে বলে পরিষদ মনে করে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×