ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের প্রাণভোমরা সাকিব

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২৬ জুন ২০১৯

বাংলাদেশের প্রাণভোমরা সাকিব

মিথুন আশরাফ ॥ বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ, সাকিব আল হাসান। নাম্বার ওয়ান সাকিব আল হাসান। সত্যিই তাই। বিশ্বকাপে এবার তিনি সেই সত্য আরও বেশি করে সামনে তুলে ধরছেন। যেন নিজের মনের মতো করে খেলছেন বাংলাদেশের বিশ্বসেরা ওয়ানডে অলরাউন্ডার সাকিব। যা করতে চাচ্ছেন, যেভাবে চাচ্ছেন সেভাবেই করতে পারছেন। ভারতকে চাপে ফেলেছে আফগানিস্তান। অথচ বাংলাদেশের সামনে পাত্তাই পায়নি আফগানরা। বাংলাদেশের এমন রেজাল্ট সম্ভব হয়েছে সাকিবের জন্যই। তিনি যে ব্যাট-বল হাতে আফগানদের উড়িয়ে দিয়েছেন। তাই আফগানিস্তানকে নাস্তানাবুদ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। শুধু কি তাই, সাকিব এমন খেলা খেলছেন সবার উর্ধে যেন চলে যাচ্ছেন। বিশ্বকাপে এখনও যে রেকর্ড নেই কার, তা করে দেখিয়েছেন সাকিব। আফগানদের বিপক্ষে ব্যাট হাতে ৫১ রান করার সঙ্গে ৫ উইকেট নিয়েছেন সাকিব। দলও ৬২ রানের সহজ জয় পেয়েছে। সাকিবও এক সঙ্গে কয়েকটি রেকর্ডের মালিক হয়ে গেছেন। বিশ্বকাপে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এক হাজার রান ও ৩০ উইকেটের কীর্তি গড়েছেন সাকিব। যা বিশ্বের আর কোন অলরাউন্ডারের নেই। বিশ্বকাপে সাকিবের রান এখন ১ হাজার ১৬। উইকেট শিকার সংখ্যা ৩৩টি। এখন পর্যন্ত কোন অলরাউন্ডার এমন কীর্তি গড়তে পারেননি। শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি অলরাউন্ডার সনাথ জয়সুরিয়া এর আগে ১১৬৫ রান ও ২৭ উইকেট নিয়েছিলেন। এক হাজার রান ও ৩০ উইকেট শিকারের কাছাকাছি সাকিবের পরের অবস্থানে আছেন জয়সুরিয়াই। আর কেউ সাকিবের ধারে কাছে নেই। কি দারুণ নৈপুণ্য ২০০৭ সাল থেকে চারবার বিশ্বকাপ খেলা সাকিবের। বিশ্বকাপে হাফ সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট শিকারেও সাকিব দেশের হয়ে রেকর্ড গড়েছেন। এই কৃতিত্ব এর আগে শুধু একজনই গড়তে পেরেছেন। তিনি ভারতের সাবেক অলরাউন্ডার যুবরাজ সিং। তিনি ২০১১ সালের বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ৫০ রান করার সঙ্গে ৩১ রান দিয়ে ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন। সাকিব আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫১ রান করার পর ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করেন। ২৯ রানে ৫ উইকেট নেন। তাতেতো দেখা যাচ্ছে, সাকিব এখানেও উর্ধেই আছেন। যুবরাজ থেকে রানও করেছেন বেশি। আবার কম রান দিয়ে ৫ উইকেটও নিয়েছেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবেও নিয়েছেন ৫ উইকেট। ওয়ানডেতে এর আগে ২০১৫ সালে মিরপুরে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৪৭ রান দিয়ে যে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন সাকিব, সেটি আগের সেরা বোলিং পারফর্মেন্স ছিল। আর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে ২০১১ আসরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে শফিউল ইসলাম যে ২১ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়েছিলেন, সেটি বাংলাদেশের কোন বোলারের সেরা বোলিং পারফর্মেন্স ছিল। এবার সাকিব সেরা হয়ে গেলেন। এবারের আসরে সব দল মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত এক ম্যাচে সেরা বোলিং সাকিবেরই। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এবার বিশ্বকাপে মোহাম্মদ আমির যে ৩০ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন, সেটিকে পেছনে ফেলেন সাকিব। শুধু তাই নয়, এবার বিশ্বকাপে বামহাতি স্পিনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি (১০টি) উইকেট এখন সাকিবেরই। সাকিব ২০০৭ সাল থেকে বিশ্বকাপ খেলে প্রতি আসরেই প্রথম ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। ২০০৭, ২০১১, ২০১৫ বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির দেখা পাননি। এবার টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছেন। ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছেন। তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপের একই আসরে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকারের কৃতিত্ব গড়েন সাকিব। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে এই কীর্তি গড়েছিলেন ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক কপিল দেব। ২০১১ আসরে গড়েন যুবরাজ। এবার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এমন কীর্তি গড়েন সাকিব। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে আবার হাজার রানের মাইলফলকও স্পর্শ করেন সাকিব। এই তালিকায় বাংলাদেশের মুশফিকুর রহীম (৮৩৭ রান) আছেন সাকিবের পরেই। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারে স্পিনার আব্দুর রাজ্জাককে (২০ উইকেট) আগেই পেছনে ফেলেন সাকিব। দেশের প্রথম বোলার হিসেবে ৩০ উইকেট নেয়ার যোগ্যতা দেখান। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ৫১ রান করায় আবার বিশ্বকাপে ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শীর্ষে ওঠেন। সাকিবের রান এখন ৬ ম্যাচে ৯৫.২০ গড়ে ৪৭৬ রান। মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচ শুরুর আগ পর্যন্ত সাকিবই শীর্ষে ছিলেন। সাকিব আবার একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে এবার বিশ্বকাপে ব্যাটিং ও বোলিংয়ের সেরা ১০ ব্যাটসম্যান ও বোলারের তালিকায় আছেন। এখন পর্যন্ত সাকিবের ব্যাটিং-বোলিং পরিসংখ্যান এমনÑ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৫, ১/৫০, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬৪, ২/৪৭, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ০/৭১, ১২১, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২/৫৪, ১২৪*, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ০/৫০, ৪১, আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫১, ৫/২৯। একটি ম্যাচে শুধু পঞ্চাশোর্ধ রান করতে পারেননি সাকিব। আর সব ম্যাচে ৫০ রানের বেশি করেছেন। দুটি ম্যাচে আবার আছে সেঞ্চুরি। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের পর দেশের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছেন সাকিব। সাকিব আরেকটি স্থানে উর্ধে উঠে আছেন। বিশ্বকাপ ইতিহাসে এর আগে কোন ক্রিকেটারই এক টুর্নামেন্টে ৪০০ রানের পাশাপাশি ১০ উইকেট নেয়ার কীর্তি গড়তে পারেননি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সাকিবই প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এ কীর্তি গড়েছেন। বিশ্বকাপে দেশের হয়ে সর্বাধিক ম্যাচ সেরার পুরস্কারও জিতেছেন সাকিব। তিনবার এ পুরস্কার নিজের করে নিয়েছেন সাকিব। এবার বিশ্বকাপে এক আসরে তা করে দেখিয়েছেন সাকিব। তিন ম্যাচেই জিতেছে বাংলাদেশ। এর আগে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ দুবার ম্যাচসেরা হয়েছিলেন ইমরুল কায়েস (২০১১ বিশ্বকাপে) ও মোহাম্মদ আশরাফুল (২০০৭ বিশ্বকাপে)। সাকিব বিশ্বকাপের এক টুর্নামেন্টেই পেছনে ফেলেন তাদের। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয় দিয়ে শুরু। সে ম্যাচে ৭৫ রানের পাশাপাশি ৫০ রানে ১ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন সাকিব। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরির পাশাপাশি ২ উইকেট নিয়ে হন ম্যাচসেরা। আর আফগানিস্তানের বিপক্ষে ফিফটির পর ২৯ রানে ৫ উইকেট শিকার করে ম্যাচসেরা হন। অবিস্মরণীয় সাফল্য পাচ্ছেন সাকিব। কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব হচ্ছে? এক্ষেত্রে শারীরিক ফিটনেসকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন সাকিব। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে আইপিএল খেলার সময় দীর্ঘদিন একাদশে সুযোগ মিলেনি। সেই সময় সাকিব অনুশীলনের পাশাপাশি নিজের ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছেন। তাতে সাকিবের মানসিক ভিতও নাকি মজবুত হয়েছে। নিজেই বলেছেন, ‘শারীরিক ফিটনেস আমাকে মানসিকভাবেও শক্ত হতে অনেক সাহায্য করেছে। কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে শারীরিক ফিটনেসটা দরকার। আমার মনে হয়, সে জন্যই আমি কঠিন পরিস্থিতিতে ভাল খেলতে পারছি।’ আফগানিস্তানের বিপক্ষে জেতায় পাঁচদিন ছুটি মিলেছে টাইগারদের। সাউদাম্পটন থেকে বার্মিংহ্যামে মঙ্গলবার পৌঁছেই সেই ছুটির শুরু হয়ে যায়। সাকিব তার পরিবার নিয়ে ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড ছুটি কাটাতে যান। ফুরফুরে মেজাজেই আছেন। থাকারই কথা। যা কোনদিন বিশ্বকাপে কোন বাংলাদেশী ক্রিকেটার করতে পারেননি, তা যে করে দেখাচ্ছেন সাকিব। দেশের সেরা অলরাউন্ডার তকমাতো আগেই লেগেছে। দেশের সেরা ক্রিকেটারের তকমাও গায়ে লেগে গেছে। বাংলাদেশের ‘লিজেন্ড’ও কী সাকিব? তাকে প্রশ্ন করা হলে জবাব দেন, ‘আমি কিভাবে বলব বলেন! এটা আপনারা ভাল বলতে পারবেন। এটা নিয়ে আসলে কখনাও চিন্তা করিনি। আমি আমার পারফর্মেন্সকে র‌্যাঙ্ক করি না। তবে এটা তৃপ্তিদায়ক যে ব্যাটে-বলে সমান অবদান রাখতে পারছি। নতুন রেকর্ড গড়তে ভাল লাগে। কোন লক্ষ্য থাকলে সেটা অর্জনের তাড়না থাকে। অর্জন করতে পারলে ভীষণ ভাল লাগে।’ সাকিবের অর্জন মানেই বাংলাদেশের জয়। সামনে ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষেও সাকিবের অর্জন অব্যাহত থাকুক, বাংলাদেশও জয় পাক; সেই প্রত্যাশাই সবার। সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছেন সাকিব। উর্ধে উঠছেন। সেই উর্ধমুখী পারফর্মেন্স আরও উর্ধ হোক, সেই আশাই করছেন সবাই।
×