ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

টাঙ্গাইলে যমুনার ভাঙন ॥ প্রতিরোধের পূর্ব প্রস্তুতি নেই

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৬ জুন ২০১৯

টাঙ্গাইলে যমুনার ভাঙন ॥ প্রতিরোধের পূর্ব প্রস্তুতি নেই

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল ॥ বর্ষা এলেই টাঙ্গাইলে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্বপাড়ে যমুনা নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনে নেমে আসে বিভীষিকা। তারা থাকেন চরম আতংকে, কখন যেন বাড়িঘর চলে যায় আগ্রাসী যমুনার পেটে। ঠাঁই নিতে হবে খোলা আকাশের নিচে বা অন্যের জায়গায় আশ্রিত। এবার বর্ষা মৌসুম আসার আগেই সেই আতংকে দিশেহারা কালিহাতী উপজেলা ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের হাজারো মানুষ। তবে কর্তৃপক্ষের নেই প্রতিরোধের পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কোন ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু সেতুর অদুরে কালিহাতী উপজেলার গড়িলাবাড়ী গ্রামের মানচিত্র যমুনার ভাঙনে বহুদিন আগেই পাল্টে গেছে। নদীর একেবারে কোল ঘেষে ভাঙনের অপেক্ষায় থাকা আলী তালুকদারের বাড়ি গেলে সংবাদকর্মী পরিচয় পেয়ে তারা এক প্রকার বিরক্তিই প্রকাশ করেন। ক্ষোভের কন্ঠে প্রায় ৭০ বছর বয়সী জনাব আলী বলেন, আপনারা’ত প্রতিবারই লেইখা নিয়া যাইন। আমাগো কোন লাব অয় না তো। এহন পর্যন্ত ৮ বার বাড়ি পালটাইছি। এবারও নদীর দুই এক চাপ পরলেই আমার বাড়িডা ভাইংগা যাইব। জনাব আলীর স্ত্রী লাইলী বেগম (৬০) বলেন, আমরা কৃষিকাজ কইরা খাই। এবার বাড়ি ভাঙলে আমরা আর বাড়ি করতে পারমু না। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার নদী তীরবর্তী চরপৌলী গ্রামের মোশারফ হোসেন বলেন, আগে আমাদের বাড়ি ছিল কালিহাতীর দুর্গাপুর ইউনিয়নের চর সিংগুলি গ্রামে। আমাদের শত বিঘা জমি ছিল। আমরা ছিলাম এলাকার বড় গিরস্থ। কিন্তু যমুনা নদীই আমাদের সর্বনাশ করে দিছে। নদীতে আমাদের বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে এখন ৭ বারের বেলায় বাড়ি নিছি চরপৌলীতে। এবারো রয়েছি আতংকে। এখন আমরা প্রতি শতাংশ জমি বছর ভিত্তিতে ২০০ টাকা করে দিয়ে বাড়ি বানাইছি। আর কেউ জমি দিতে চায় না। বঙ্গবন্ধু সেতুর দেড় কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে দেখা যায়, গত বছর ভাঙ্গনরোধের জন্য ফালানো জিও ব্যাগগুলো নদী গর্ভে চলে যাচ্ছে। কিছু কিছু স্থানে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। তীরবর্তী কালিহাতী উপজেলার গড়িলাবাড়ি, বেলটিয়া, আলীপুর, শ্যামসৈল, বিনোদ লুহুরয়িা, ভৈরববাড়ী, বেনুকুর্শিয়া এবং টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলী, কাকুয়া, ধুলবাড়ী, পানাকুড়াসহ ১৫-২০টি গ্রামে শতশত পরিবার রয়েছে ভাঙন আতংকে। হুমকির মুখে রয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা, বাজার ও রাস্তা ঘাট। তাছাড়া এইসব গ্রামের অসংখ্য মানুষ বাড়িঘর নদীগর্ভে হারিয়ে আজ নিঃস্ব হয়ে গেছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, নদীর পানির তীব্র ¯্রােত, নদী থেকে প্রভাবশালীদের অবৈধ বালু উত্তোলন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতিই এরজন্য দায়ী। তারা সবসময় আতংকে থাকেন কখন যেন বাড়ি ঘর চলে গেল। এলাকাবাসী বলেন, নদীভাঙনের প্রভাব এক সময় গিয়ে পরতে পারে বঙ্গবন্ধু সেতুর উপর। গত বছর গড়িলাবাড়ি ও বেলটিয়া গ্রামের আকবর আলী আকন্দ, চাঁন মিয়া হাজী, আব্দুল আলী মন্ডল, আব্দুস সালাম, দোকানদার আবুল হোসেন, কোরবান আলী, আকবর সিকদার, আশরাফ আলী, সোলায়মান, শফিক উদ্দিন, জহুরুল ইসলাম, খালেদ মন্ডলসহ আরো অনেকের বাড়ি ঘর নদী গর্ভে চলে গেছে। তাদের অনেকেই অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ভাঙনের শিকার আজিজ মিয়া নামের এক জেলে বলেন, আমাগো পাকা ঘরবাড়ি ও টয়লেট সব ছিল। আমাগো অবস্থা এতো খারাপ আছিল না। নদী সব কিছুই নিয়া নিছে। এহন কষ্ট করে কোন মতে বাঁইচা আছি। কিন্তু আমাগো কাঁনদন কেউ শুনে না। সরকার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে দিলেই আমরা বাঁচমু। বেলটিয়া গ্রামের ফরিদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, শুকনা মৌসুমেও আমাদের পাড়ে পানি থাকে। যখন নদীতে পানি কম হয় তখন যদি সরকার কাজ করতো তাহলে এই ভাঙন হতো না। শতশত মানুষ বাড়ি ঘর হারিয়ে নিঃস্ব হতো না। জনপ্রতিনিধিদের কাছে আর প্রতিশ্রুতি চাই না। চাই স্থায়ী সমাধান। গোহালিয়াবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, নদীগর্ভে ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে বল্লভবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেলটিয়া কমিউনিটি ক্লিনিক, পাকা মসজিদ ও ঐতিহ্যবাহী ঈদগা মাঠ, আলীপুরের বেলটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর হুমকিতে রয়েছে গড়িলাবাড়ী ও বিয়ারা মারুয়া দাখিল মাদ্রাসা এবং শ্যামশৈল, বেনুকুর্শিয়া, কুর্শাবেনু মসজিদ, বেলাটিয়া সুতার মিলসহ অসংখ্য গ্রামীণ রাস্তা। এই এলাকার মানুষকে বাঁচালে হলে দ্রুত স্থায়ী বাঁধই নির্মাণ করতে হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) এর বঙ্গবন্ধু সেতুতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল বলেন, নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণেই এই ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ভাঙনে বঙ্গবন্ধু সেতুর কোন ক্ষতি হবে না। সেতু থেকে ২০০ মিটার বাদ দিয়ে ভাঙন রোধের দায়িত্ব পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সেতু এলাকার ৬ কিলোমিটারের মধ্যে নদী থেকে বালু উত্তোলন সম্পূর্ন অবৈধ। কেউ বালু উত্তোলন করে কিনা আমার সেটা জানা নেই। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমি বঙ্গবন্ধু সেতু পাড়ের যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকায় পরিদর্শন করেছি। এখনও ভাঙন শুরু হয়নি। ভাঙ্গন শুরু হলে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া টাঙ্গাইলে স্থায়ীভাবে ২২ কিলোমিটার এলাকায় নদী ভাঙন রোধে গাইড বাঁধ নির্মাণের জন্য ২১৯৩ কোটি টাকার একটি মেগা প্রকল্পের প্রপোজাল তৈরি করা হচ্ছে।
×