অনলাইন |
আজকের পত্রিকা |
ফিচার পাতা |
সাময়িকী |
১৯৭১ সালের ২৭ জুন দিনটি ছিল রবিবার। এই দিন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল কুমিল্লার খোলাপাড়ায় পাকসেনাদের একটি টহলদার দলকে এ্যামবুশ করে। এতে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। সুবেদার আবদুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ১৮ সদস্যের একটি দলকে কসবা থেকে ইমামবাড়ি যাওয়ার পথে কসবা রেল স্টেশনের কাছে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। বুড়িগঙ্গা নদীতে অবস্থানকারী একটি সাঁজোয়া জাহাজ থেকে হানাদারবাহিনী মেশিনগান দিয়ে রাজাপুর, গোপালনগর ও মধ্যনগরে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। বর্বরদের গুলিতে মধ্যনগরে আমান উল্লাহ ও রাজাপুরের অজ্ঞাত পরিচয় এক কৃষক নিহত হয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং নয়াদিল্লীতে বলেন, ভারত সব সময়ই বাংলাদেশের সঙ্কটের একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধান আশা করে আসছে। শরণার্থী আগমনের ফলে ভারতে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য শরণার্থীদের নির্বিঘ্নে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য ভারতকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হতে পারে। ওয়াশিংটনে জনৈক মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, প্রধান সাহায্যদাতা দেশগুলো পাকিস্তানে নতুন অর্থনৈতিক সাহায্যের বিবেচনা কয়েক মাসের জন্য স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া বন্ধ রাখছে না। এয়ার মার্শাল আসগর খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে করাচী থেকে ঢাকায় আসেন। সাবেক প্রাদেশিক মন্ত্রী ডি. এন. বাড়োড়ী এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের অখ-তার প্রতি তার আস্থার কথা পুনর্ব্যক্ত করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করতে ভারতকে রাজি করানোর জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান। রাজধানী শহর ঢাকার অদূরে বর্তমান মানিকগঞ্জ জেলার ‘শিবালয় উপজেলা’ নদীবিধৌত বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নদী পদ্মা ও যমুনার পাড় ঘেঁষে অবস্থিত। এই দিন আরুয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলে শিবালয় থানার সহকারী দারোগা মোঃ রফিকের নেতৃত্বে কয়েকজন পুলিশ অবস্থান করে, গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজ-খবর দিতে থাকে। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল আক্রমণ করে। এ আক্রমণে ঢাকা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডার অব ক্যাপ্টেন আঃ হালিম চৌধুরীর নেতৃত্ব গুলি করে দারোগা রফিককে হত্যা করে এবং দারোগাসহ অন্যান্য পুলিশের অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে। দি নিউইয়র্ক টাইমস ’যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান, অস্ত্র যখন ধর্মতাত্ত্বিক সমস্যা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, নিক্সন প্রশাসন গত সপ্তাহের জানতে পেরেছে যে দেশটির পূর্ব অংশে গৃহযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই তারা মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানে পাঠানোর ওপর নিজেরাই যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তা উপেক্ষা করেছে। ২৫ মার্চে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবার পরেও সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই অন্তত তিনটি মালবাহী জাহাজ নিউইয়র্ক বন্দর থেকে করাচীর পথে ছেড়ে গেছে এবং ঐ দিনের পর বেআইনীভাবে আরও নতুন রফতানি আদেশ দেয়া হচ্ছে, এতে প্রশাসন প্রকাশ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে সংসদীয় অসন্তোষ এবং ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। এই ঘটনাটি পূর্ব পাকিস্তানের কার্যত বিস্ফোরক পরিস্থিতির প্রতি ওয়াশিংটনের দ্যর্থক মনোভাবকে আরও স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিতে কাজ করেছে, যেখানে বাঙালী স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর চালানো দমন-পীড়নে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০০০০ বাঙালী নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে এবং ষাট লাখ শরণার্থীকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যেতে বাধ্য করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই বেশ কয়েকজন সিনেটরকে আশ্বস্ত করেছিল যে পাকিস্তানের জন্য কোন অস্ত্রের চালান পাঠানোর কথা নেই, হতবাক হয়ে যায় যখন তারা দুটো মালবাহী জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার কথা জানতে পারে এবং ছুটে যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে এর ব্যাখ্যা চাইতে। পেন্টাগন তাদের কম্পিউটার ঘাটে এবং তথ্য পরিবেশন করে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চমকে দিয়ে, যে ২৫ মার্চের অস্ত্রের চালানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা মাত্র ৬ এপ্রিলে এসে কার্যকর হয়েছে। পাকিস্তানের মালবাহী জাহাজ যেটি গত সপ্তাহান্তে নিউইয়র্ক বন্দরে মালামাল তুলছিল, সেটি বন্দর ছেড়ে গেছে ১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার সমমূল্যের গোলাবারুদ, সামরিক বিমান, সাঁজোয়া যান এবং জীপগাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ এবং বিমানবিধ্বংসী গোলন্দাজদের প্রশিক্ষণের জন্য বেতার-নিয়ন্ত্রিত চালকবিহীন ছোট বিমান নিয়ে। ভারতীয় নীতি, যুক্তরাজ্য এবং কানাডার অবস্থান হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের ব্যবস্থা করা যাতে সে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে পাকিস্তানকে সব ধরনের বৈদেশিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত করার দাবি তাদের। এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব অস্পষ্ট। পেন্টাগনের প্রবৃত্তি হচ্ছে ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার সুসম্পর্কের ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে কোন মূল্যে পাকিস্তানের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। সম্প্রতি বার্লিন থেকে প্রকাশিত জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সরকারের এক ইশতেহারে ঘোষণা করা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশ থেকে লাখ লাখ নর-নারী আর যাতে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য না হয় এবং ইতিমধ্যেই যে ৬০ লাখ বাঙালী দেশ ছেড়ে ভারতে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে তারা যাতে অবিলম্বে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে এবং বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষ যাতে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন এবং তাদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হয় তার জন্য কালবিলম্ব না করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যেই বাস্তবসম্মত, উপযুক্ত এবং স্থায়ী সমাধানের পথ নিহিত আছে। জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের এই ইশতেহারে আরও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা এবং সেখানকার নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের পরামর্শ ও পরিকল্পনার ভিত্তিতেই মৌলিক রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের এক সঠিক ও সহজপথ খুঁজে পাওয়া যাবে। জার্মান গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের এই ইশতেহারকে বিশ্বের সব দেশের রাজনৈতিক মহল তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। তারা বলেন, এই ইশতেহারে বাংলাদেশ থেকে যেসব শরণার্থী ভারতে চলে গেছে তাদের সমস্যাকে শুধু যে আন্তর্জাতিক সমস্যা বলে বর্ণনা করা হয়েছে তা নয়। এই ইশতেহারে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক নেতার মুক্তি, আওয়ামী লীগের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, গণনির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রভৃতি। ইউরোপ ও আমেরিকার পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টেলিভিশনসমূহের প্রকাশিত ও প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ এবং মন্তব্যে বলা হয়, গত ২৫ মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশে যে বর্বরতা চালিয়েছে তাতে বাংলাদেশ থেকে আরও লাখ লাখ নর-নারী দেশছাড়া হতে বাধ্য হবে। ১৯৭০ সালের নবেম্বরে বাংলাদেশে যে ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল তাতে আনুমানিক ১৮ থেকে ২০ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছে এবং এই ব্যাপক প্রাণহানির মূল্যেও পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রচ্ছন্ন কারসাজি ছিল। যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করলে ঘূর্ণিঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যুর হাত থেকে শতকরা ৯৫ জন অব্যাহতি পেতে পারত, পশ্চিম পাকিস্তানীরা তথা ইয়াহিয়া সরকার ইচ্ছা করেই সেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমন কি ব্যাপক প্রাণহানির খবর পর্যন্ত চেপে গেছে। বাইরের জগত যেটুকু জেনেছে তা বাংলাদেশের বেসরকারী কতগুলো পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এবং বিদেশী সাংবাদিকদের খবর থেকে। গত ২৫ মার্চ থেকে ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালল, এর খবরও তারা চেপে গেছে। পাক বাহিনী ইতোমধ্যে ১০ লাখ নর-নারীকে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। ল-নে কমনওয়েলথ প্রেস সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা থেকে এই তথ্য উদ্ধৃত করা হয়। সুইডেন থেকে প্রকাশিত দ্য দাগেন্স নাইহেটার পত্রিকায় ’হিংসাত্মক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পূর্ববাংলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে প্রায় চার মাস। পালিয়ে যাওয়া মানুষ এখনও ভারতে সীমান্তজুড়ে অবস্থান করছে। পাকিস্তানী সামরিক একনায়কত্বের নিষ্ঠুরতার কোন সীমা নেই! এই যুদ্ধ যত দীর্ঘ হবে, নিপীড়ন এবং ধ্বংস চলতেই থাকবে। সরকার রক্তক্ষয় বন্ধ করার জন্য কোন একটি দৃঢ় প্রচেষ্টা নেয়নি। আমরা বাঙালী নারীর চোখে নির্যাতনের যে চিত্র দেখেছি তা আমাদের যুগের শাসনতন্ত্রের একটি বিরল চিত্র। পাকিস্তানের দাতাগোষ্ঠী সম্প্রতি মানবিক বিবেচনায় নতুন করে সাহায্য মঞ্জুর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তটি সম্ভবত পাকিস্তানে সৃষ্টি হওয়া অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে নেয়া হয়েছে- যেহেতু পাকিস্তানী একনায়ক সরকার পূর্ববাংলাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে- যে সামান্য বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সেগুলো দিয়ে তারা আরও বেশি অস্ত্র কিনছে সহিংসতা আরও বাড়ানোর জন্য। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসী নীতিমালার বিরুদ্ধে এটি প্রথম আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
sumahmud78@gmail.com