ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসির সিয়াম

বৃষ্টির আনন্দ

প্রকাশিত: ১১:৫১, ৬ জুলাই ২০১৯

বৃষ্টির আনন্দ

আগামীকাল ক্লাসে বর্ষাকাল রচনা পড়া ধরবেন মিস। সন্ধ্যা থেকে তাই খুব মনোযোগ দিয়ে বর্ষাকাল রচনা পড়ছে রুমকি। কিন্তু বইয়ের রচনার সঙ্গে রুমকির দেখা এখনকার বর্ষাকালের কিছুই যেন মিলতে চাইছে না। পড়তে পড়তে বইয়ের পাতা থেকে কোথাও একটা হারিয়ে যাচ্ছে সে। চোখে ভাসছে রচনায় থাকা বর্ষার সময়কার সজীব এক গ্রাম বাংলার দৃশ্য। বৃষ্টির পানি এসে জমে থাকে বাড়ির উঠোন ঘাটে। গাছের সবুজ পাতাগুলোতে সতেজতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। অন্যদিকে নদী-নালা, খাল-বিলগুলো কানায় কানায় ভরে ওঠে বৃষ্টির পানিতে। নতুন পানি পেয়ে মাছেরা দুষ্টু ছেলের দলের মতো খেলতে শুরু করে। পানিতে ডুবে যাওয়া খাল বিলগুলোতে কলাগাছ কেটে ভেলা বানিয়ে ভেসে বেড়ায় ছেলেমেয়েরা। গ্রীষ্মের ফেটে পড়া রোদ্দুরে এই বর্ষাকালই প্রকৃতিকে নতুনভাবে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়। এমন সময় অফিস থেকে বাসায় ফিরলেন বাবা। ঘেমে একাকার হয়ে আছেন তিনি। ঘেমে যাওয়া মুখের দিকে তাকাতেই কষ্ট হলো রুমকির। তাড়াতাড়ি করে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে হাতে দিল বাবার। সোফায় বসে পানি খেতে খেতেই বলতে শুরু করলেন বাবা, আর বলিস নারে মা। এই বর্ষাকালেও সারাটাদিন কেমন গ্রীষ্মকালের মতো প্রচন্ড রোদ সহ্য করতে হয়। এদিকে রাতের বেলাতেও যে একটু শীতল হয়ে উঠবে প্রকৃতি, তারও কোন নজির নেই। কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গরম লেগেই আছে। -এমন কেন বাবা? একটু আগেও বইয়ে বর্ষাকাল রচনা পড়ছিলাম। তার সঙ্গে যে কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যায় না। একটু মলিন করে হাসলেন বাবা। বললেন, গ্রাম বাংলাতেও এখন আর বইয়ে পড়া বর্ষাকালের চিত্র দেখা যায় না। অবশ্য এর পেছনে আমরাই দায়ী। প্রকৃতিকে ইচ্ছে মতো বদলে বেড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত। ইচ্ছে মতো গাছপালা কেটে দেশের বনভূমির পরিমাণ কমাচ্ছি। প্রকৃতি আর এরপর নিজের মতো করে রূপে বহমান হবেই বা কি করে! -গাছপালার সঙ্গে বৃষ্টির কি সম্পর্ক বাবা? -গাছপালার সঙ্গেই তো বৃষ্টির সম্পর্ক। একটা দেশের শতকরা পঁচিশ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশে সেটুকুও নেই। এরপরও অবাধে গাছপালা কেটে বনভূমির পরিমাণ কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। যার জন্যই প্রকৃতির এমন করুণ দশা। আর যেখানে গাছপালার পরিমাণ কম, সে জায়গায় বৃষ্টিপাতও তুলনামূলক কম হয়। -তাহলে আমাদের সকলেরই গাছপালা নষ্ট করা বন্ধ করা উচিত নয় কি, বাবা? -অবশ্যই। সেইসঙ্গে খুব ভাল হয়, যদি আমরা প্রত্যেকে নিয়মিত বৃক্ষরোপণও করি। তাহলে যদি প্রকৃতির ভারসাম্যটুকু ধরে রাখা যায়! সেজন্যই বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় যতটা সম্ভব গাছ লাগাতে চেষ্টা করি। -আমিও এখন থেকে বাড়ির ছাদে গাছ লাগাতে শুরু করব, বাবা। -অবশ্যই মামণি। আমি তোকে অনেকগুলো গাছ কিনে দেব। বাড়ির ছাদে সুন্দর একটা বাগান তৈরি করিস তুই। -তুমিই তো বললে নিয়মিত গাছ লাগানো আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব। আমি নিজেই টাকা জমিয়ে ধীরে ধীরে একটা বাগান তৈরি করবো, বাবা। প্রতিমাসে অন্তত একটা করে গাছ লাগাব আমি। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদেরকেও বলব। ওরা সবাই যেন প্রতি মাসে অন্তত একটা করে হলেও গাছ লাগায়। মেয়ের কথায় ভীষণ খুশি হলেন বাবা। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। বললেন, এভাবে তোর মতো সবাই যদি সচেতন হয়ে উঠত রে মা। প্রকৃতির এমন বেহাল দশা নিয়ে আর ভুগতে হত না। যাই হোক, পড়তে বস গিয়ে। আমিও হাতমুখটা ধুয়ে নেই এবার। পরেরদিন সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার সময় বাবার হাতে কিছু টাকা দিল রুমকি। সবই তার টিফিনের টাকা থেকে জমানো ছিল এতদিন। অফিস থেকে ফেরার সময় বাবা যেন বাগানের জন্য চারাগাছ কিনে নিয়ে আসেন, সেজন্যই বাবার কাছে টাকাগুলো দেয়া। বাবাও মেয়ের ইচ্ছে মতো সেই টাকাগুলো দিয়ে চারাগাছ কিনে নিয়ে আসলেন। রুমকিও নিজের মতো করে বাগান তৈরির কাজ শুরু করে দিল। বাবার কিনে নিয়ে আসা পাঁচটা গোলাপের চারাগুলোর যতœ করেই কেটে যায় তার বিকেলগুলো। এভাবেই কেটে গেল কয়েকটা দিন। ছুটির দিন হওয়ায় বাসায়ই আছে রুমকি। আজ দুপুর থেকেই চারপাশটায় একটা অশান্ত ভাব। কিছুক্ষণ পরপর দমকা হাওয়া বইতে শুরু করছে। চারদিক থেকে ধুলোবালি উড়ে আসছে। মনে হয় সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে সেই দমকা হাওয়া। বাবার কাছে জিজ্ঞেস করল রুমকি, থেকে থেকেই তো দমকা হাওয়া বইছে, বাবা। অবশেষে আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে। তাই না বাবা? জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন বাবা। বললেন, তাই তো মনে হচ্ছে রে মা। আকাশে মেঘও করেছে বেশ। চারদিকটা অন্ধকার হয়ে আসছে। মুষুল ধারে একটা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না। প্রকৃতি একটু শীতল হলে আমরাও শান্তি পাব। কথাগুলোর মাঝেই এক দুই ফোঁটা করে মুষুল ধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। জানালার কাঁচে ছিটে ছিটে এসে জমছে বৃষ্টির পানি। গুমোট ভাব ধরে থাকা প্রকৃতি যেন মুহূর্তেই সজীব হয়ে উঠল। আচমকাই টিভিটা বন্ধ হয়ে গেল। লোডশেডিং হয়েছে। বাবার মুখের দিকে তাকাতেই রুমকিকে বলে উঠলেন তিনি, লোডশেডিং হয়েছে তো কি! এমন বৃষ্টির সময়ে আমরা কি টিভিতে কার্টুন দেখতামই নাকি! -তাহলে এখন কি করব বাবা? বৃষ্টি দেখতে দেখতে গল্প শোনাবে আমাকে? মুচকি হাসলেন বাবা। উত্তর দিলেন, গল্প তো শোনাবই। তবে ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গল্প করব আমরা। বাবার কথার মাঝে যেন নিজের মনের কথাটাই খুঁজে পেল রুমকি। মায়ের বকা খাওয়ার ভয়ে শুধু বৃষ্টিতে ভেজার কথা বলতে পারছিল না সে। এখন যখন বাবাই বৃষ্টিতে ভেজার কথা বলেছেন, তখন আর কোন ভয় নেই। বাবা আর রুমকি দু’জনেই এবার ছাদের ওপর চলে গেল। প্রবল বেগে বাতাস বইছে। গাছের ডালপালাগুলো দূরন্তভাবে দোল খেতে শুরু করেছে সেই বাতাসের বেগে। মিষ্টি করে দুলছে তার বাগানের গোলাপ গাছের ছোট্ট চারাগুলোও। অল্প সময়েই বৃষ্টির পানিতে ছাদের ওপর পানি এসে জমা হয়েছে। বৃষ্টির ঠান্ডা পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে রুমকির শরীর। আর গা ঝাঁকি দিয়ে উঠছে তার। পাখির ডানার মত দু’হাত উঁচু করে ছাদের এপাশ ওপাশ ছোটাছুটি করছে সে। নিজেকে যেন পাখি বলেই মনে হচ্ছে তার কাছে। যে পাখিটা প্রকৃতির সঙ্গে তালমিলিয়ে নিমিষেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তৃতীয় বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ; চট্টগ্রাম অলঙ্করণ: প্রসুন হালদার
×