ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাইডে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৯:১১, ১৩ জুলাই ২০১৯

 রাইডে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মোটরসাইকেলের পেছনে চেপে ইদানীং ঢাকার প্রায় সব জায়গায় যাচ্ছেন একটি ট্রাভেল এজেন্সির কর্মী মিরপুরের বাসিন্দা জেসমিন আক্তার। তিনি বলছেন, ঢাকার যানজটের কারণে আরও অনেকের মতো রাইড শেয়ারিং এ্যাপ বেছে নিচ্ছেন তিনি। কারণ মোটরসাইকেলে দ্রুত পৌঁছানো যায়। কিন্তু যে দ্রুততার জন্য এই বাহন ব্যবহার করছেন সেই একই কারণে আজকাল নিজের নিরাপত্তার জন্যও উদ্বেগ বোধ করছেন তিনি। একদিন সন্ধ্যের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করে তিনি বলছিলেন, ছেলেটি একটু অল্প বয়স্ক ছিল। মানে সে এ রকমভাবে চালাচ্ছিল যে, একটুর জন্য বাসের সঙ্গে লাগিয়ে দেয় নাই। আমার মনে হচ্ছিল কখন শেষ হবে। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ঢাকার ভয়াবহ যানজট আর সহজলভ্যতা- এই দুটো কারণে রাইড শেয়ারিং এ্যাপের মোটরসাইকেল আজকাল খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসেবে, মোটরসাইকেলের নিবন্ধন আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। ২০১৭ সালে সারাদেশে তিন লাখ ২৫ হাজারের মতো নতুন মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে। পরের বছর এর সংখ্যা ছিল ৭০ হাজারের বেশি। এর একটি বিশাল সংখ্যা শুধু ঢাকাতেই। আবার একই সঙ্গে অভিযোগের তীরও মোটরসাইকেল চালকদের দিকেই বেশি। একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মী ফারিহা রহমান বলছিলেন, ‘পিক আওয়ারে ড্রাইভাররা একটু পাগলের মতো আচরণ করে। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে, ওকে অন্য আরেকজনকে নিতে হবে।’ তিনি সম্প্রতি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলছেন, ‘আমার ছোটখাটো এ্যাকসিডেন্ট অনেকবার হইছে। সায়েন্স ল্যাবের ওখানে একটা ঢালের মতো, সেখানে পানি ছিল। তো ওই যায়গায় যাওয়ার দরকার ছিল না। কিন্তু সে খুব তাড়াহুড়া করে চালাচ্ছিল। আমি তাকে কয়েকবার বলছি। উনি একজনকে ওভারটেক করতে গিয়ে ঢালে পেছনের চাকাটা পড়ে যায়, আমিও মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যাই।’ সেই যাত্রা কোন রকমে বেঁচে গেছেন কিন্তু এমন ঘটনার শিকার তিনি আরও হয়েছেন। এদিকে চালকরা বরং যাত্রীদের ওপরেই দোষ চাপাচ্ছেন। তারাই দ্রুত গন্তব্যে যেতে চান বলে তাড়া দেন বলে অভিযোগ করলেন কয়েকজন চালক। নুর মোহাম্মদ লিমন নামে একজন চালক বলছেন, ‘অনেক সময় যাত্রীরাই বলে যে আমার অফিস ধরতে হবে একটু তাড়াতাড়ি যান। এটা নিয়ে রিপোর্ট কখনো আসে না যে যাত্রীরা তাড়া দেয়। সবসময় আসে আমাদের রাইডারদের দোষ।’ ওদিকে যারা একটু আয়েশি, গাড়ির মালিক নন অথচ গাড়িতে চড়ার স্বাদ পেতে চান, গাড়ির কেনার ঝামেলায় যেতে চান না, অথবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ঘুরতে যেতে চান, এমন অনেক ক্ষেত্রেই শুধু স্মার্টফোনে কয়েকটি ক্লিক দিলেই মিনিট কয়েক পরই দোরগোড়ায় এসে হাজির হচ্ছে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। এই সুবিধার কারণেই এতটা জনপ্রিয় হচ্ছে রাইড শেয়ারিং এ্যাপের গাড়ি সেবাও। মোটরসাইকেলের সেবার মতো এতটা না হলেও তাদের নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে। রাইড শেয়ারিং এ্যাপগুলোর কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের কাছে যে অভিযোগগুলো আসে তার মধ্যে অন্যতম হলো চালকের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি, পছন্দমতো জায়গায় যাত্রীকে তুলতে না চাওয়া অথবা ভাড়া নিয়ে বিবাদ। কিন্তু সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগই সবচাইতে বেশি। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী করছে তারা? উবারের বাংলাদেশ প্রধান কাজী জুলকারনাইন ইসলাম বলছেন, তারা চালকদের বিস্তারিত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। অনিয়ম হলে চালকদের জন্য নানা ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। তিনি বলছেন, ‘প্রথমত এ্যাপটির ব্যবহার শেখানো হয়। তারপর ন্যাভিগেশন, কিভাবে এটি ব্যবহার করে যাত্রীর কাছে যাবেন। এরপর সড়ক নিরাপত্তার আইন আর চতুর্থ হচ্ছে কাস্টমারকে কিভাবে ভাল সার্ভিস দেয়া যায়।’ প্রথমে সরাসরি সামনে বসিয়ে এই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর সেই ট্রেনিং এর ভিত্তিতে একটি পরীক্ষা নেয়া হয়। সেটিতে পাশ করলেই সে চালক হিসেবে এ্যাপে যুক্ত হয়ে কাজ করতে পারবে। কিন্তু তারপরও প্রাথমিক দিকে প্রথম ৫০টি যাত্রা পর্যন্ত নানা তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। এরপর আবার সেই তথ্যের ওপর পরীক্ষা চলে। সেটিতে পাশ না করলে আবার ট্রেনিং দেয়া হয়। তার অবস্থা যাচাই করে একদম বাদও দেয়া হয় বলে জানান তিনি। একজন চালককে শুরুতেই লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দিতে হয়। সেগুলো লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র কর্তৃপক্ষের কাছে এসএমএস পাঠিয়ে যাচাই করা যায়। চালকদের যাচাই করার জন্য এসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় বলে জানালেন জনাব ইসলাম। এই পদ্ধতি মোটামুটি সবগুলো রাইড শেয়ারিং এ্যাপই করে থাকে। তবে মি. ইসলাম বলছেন, ঢাকা শহরে বিশৃঙ্খল যানবাহন ব্যবস্থা তাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। ঢাকা শহরের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা যে মারাত্মক বিশৃঙ্খল তা নিয়ে বোধকরি নতুন করে বলার কিছু নেই। পুলিশের হিসেবে এই শহরে গড় প্রতিদিন একজনের বেশি পথচারী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ট্রাফিক আইন অমান্য করা, দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, বারবার লেন পরিবর্তন করা, পথচারীকে সম্মান না করা, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব- এমন নানা অভিযোগ রয়েছে এই শহরের চালকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই একই চালকেরা নিবন্ধন করছেন রাইড শেয়ারিং এ্যাপগুলোর সঙ্গে। সম্প্রতি রাইড শেয়ারিং এ্যাপ ব্যবহারকারীদের দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। সর্বশেষ আলোচিত দুটি ঘটনার একটি হলো গতমাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে বেসরকারী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর মৃত্যু। অন্যটি ছিল ঢাকার নিউমার্কেটের কাছে। বরিশাল থেকে আসা একটি পরিবারের এ্যাপে ভাড়া করা গাড়ির সঙ্গে অন্য একটি গাড়ির সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু। এছাড়াও ছোটখাটো দুর্ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। এই খাতটির যেমন আরও ব্যাপক সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে, তেমনি যাত্রীদের নিরাপত্তায় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতার প্রশ্নও উঠছে। পাঠাও এ্যাপের নির্বাহী পরিচালক হুসেইন এম ইলিয়াস বলছেন, তারা সে বিষয় মাথা রেখেই চালকদের প্রশিক্ষণ দেন। বাহনের যাত্রী ও চালক দু’জনের জন্যই বীমার ব্যবস্থার কথা জানালেন তিনি। তিনি বলছেন, ‘পাঠাও-এর প্রত্যেকটা রাইড ইনসিউরড করা থাকে। পাঠাওয়ে থাকা অবস্থায় যদি কোন দুর্ঘটনা হয়, তাদের জন্য হাসপাতাল বেনেফিট আছে। এক্সট্রিম কেসে ডেথ বেনেফিটও আছে।’ তিনি বলছেন, এই বীমার অর্থ পেতে হলে তাদের এ্যাপের মাধ্যমে রিপোর্ট করা যায়। সেখানে বিস্তারিত দিতে হয়। তখন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভুক্তভোগী ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় বলে জানালেন তিনি। এই বীমার ব্যবস্থা অন্য এ্যাপগুলোরও রয়েছে। কিন্তু ঢাকার একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদকর্মী মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বাদল অভিযোগ করছেন, কিছুদিন আগে একটি রাইড শেয়ারিং এ্যাপের মোটরসাইকেল চালকের অসতর্কতায় দুর্ঘটনা শিকার হয়ে তার হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল। আরও বেশ কিছু আঘাতের পাশাপাশি মাথায় আঘাত লাগার পর এখন প্রায়ই স্মৃতিভ্রম হয়। চার মাস পর কাজে ফিরতে পেরেছেন। তিনি বলছেন, যখন রাইড শেয়ারিং কোম্পানির কাছে বীমার অর্থ দাবি করেন তখন তাকে দীর্ঘ সময় পর খুব সামান্য অর্থ দেয়া হয়েছে। তিনি বলছেন, ‘আমি সম্পূর্ণ বিবরণ তাদেরকে দিয়েছি। দুর্ঘটনা সমস্ত ছবি দিয়েছি, কোথায় চিকিৎসা নিছি (নিয়েছি), সব কিছু।’ তিনি বলেন, ‘আমি তাদের এটাও বলছি যে আমার সমস্ত ক্ষতিপূরণ যে তাদের দিতে হবে এমন না। কমপক্ষে একটা পদক্ষেপ যেন আপনারা নেন। তারা সেটা নেয়নি।’ জনাব বাদল বলেন, ‘আমার দেড় লাখের মতো খরচ হয়েছে সেখানে তারা চারমাস ঘুরিয়ে আমাকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়েছে। এটা মেনে নেয়ার মতো না।’ কিন্তু এতসব অভিযোগের পরও আরও নতুন রাইড শেয়ারিং সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। বিআরটিএ জানিয়েছে, সব মিলিয়ে ১৬টি রাইড শেয়ারিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিএর কাছে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। বাংলাদেশে ঢাকাসহ বড় কয়েকটি শহরে ৭টির মতো কোম্পানি ইতোমধ্যেই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ঢাকার অন্যতম বড় দুটি রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানের একটি পাঠাও-এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দুই লাখের মতো চালক ও বাহন। আর আন্তর্জাতিক কোম্পানি উবার জানিয়েছে, তাদের সঙ্গে রয়েছে এক লাখের বেশি। উবার বলছে, প্রতি মিনিটে ঢাকায় ২০৫ জন তাদের এ্যাপ খোলে। বছর দুয়েক আগে অপেক্ষাকৃত নতুন এই সেবাটির জন্য বাংলাদেশ সরকার একটি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয়।
×