ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আরএস না বিএস- কোন্ জরিপের ভিত্তিতে উচ্ছেদ তাও অঘোষিত

চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা নিরসনে বিপুল অর্থ কি জলেই যাবে?

প্রকাশিত: ১০:৫০, ১৬ জুলাই ২০১৯

  চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা  নিরসনে বিপুল অর্থ কি জলেই যাবে?

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম মহানগরীর মারাত্মক জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার যে ৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকারও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে- সে অর্থ সম্পূর্ণভাবে ব্যয় হওয়ার পর তা শেষ পর্যন্ত জলে যাবে কিনা তা নিয়ে ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞ মহলে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়েছে। সরকার গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম একটি। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নানা দিক নিয়ে পরোক্ষভাবে এক সংস্থা আরেক সংস্থাকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ এ ঘটনা নিয়ে চউকের সঙ্গে চসিকের চরম বিরোধের সূত্রপাত হয়ে আছে। মহানগরীর খাল ও নালা-নর্দমা সংস্কার, নিয়মিত দেখভাল করার দায়িত্বও মূলত নগর কর্তৃপক্ষের। অর্থাৎ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক)। বছরের পর বছর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষই নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করে আসছে। এ কাজ সব সময় যে একেবারে ইতিবাচক ফল বয়ে এনেছে তা বলা যাবে না। সুষ্ঠু পরিকল্পনার বরাবরই যেমন অভাব ছিল, তেমনি দুর্নীতি অনিয়মও কম হয়নি। এরপরও নগর কর্তৃপক্ষ এ খাতে সরকার থেকে প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ পেয়ে থাকে। যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট খাল ও নালা-নর্দমা সংস্কার কার্যক্রম সম্পাদিত হয়ে থাকে। কিন্তু এবারই প্রথম এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) এই দুই সংস্থার পক্ষে সরকারের কাছে পৃথক পৃথক প্রকল্প পেশ করে। অজ্ঞাত কারণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এ কাজ চউককে প্রদান করে। এ খাতে বরাদ্দ দেয় ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চউক এ প্রকল্পের অনুমোদন পেলেও চসিক এ নিয়ে যে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে এবং তা নানাভাবে প্রকাশ হয়। এরপরও এ নিয়ে সরকারী সিদ্ধান্তে কোন পরিবর্তন আসেনি। প্রকল্প অনুমোদন পেয়ে এর বাস্তবায়নে গত দু’বছর আগে চউক অন্য একটি সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। এ কাজ সম্পন্ন করতে বিভিন্ন ধরনের প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত নিয়ে গড়িয়ে যায় দীর্ঘ সময়। এরই মাঝে ৫৭৫ কোটি টাকারও বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। ২০১৭ সালে দেড়শ কোটি এবং এরপরে ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে আরও ৪২৫ কোটি টাকা। এরই মধ্যে চলতি বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর টানা বর্ষণে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। চউকের পক্ষ থেকে গণমাধ্যম কর্মীদের জানানো হয়েছে, এ মেগা প্রকল্প সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন এবং সুফল পেতে আরও কয়েক বছর সময় গড়াবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মহানগরীতে সর্বমোট ৭৩টি ছোট-বড় খালের অস্তিত্ব ছিল। দখল ও দূষণে এবং নানা ধরনের বর্জ্য ফেলার কারণে ভরাট হয়ে যাওয়ায় সে সংখ্যা বর্তমানে সর্বোচ্চ ৪৩। এর মধ্যে থেকে ৩৬টি খাল সংস্কারের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে ৫টি খালের দুপাড় ও খাল অভ্যন্তর সংস্কার কাজ হয়েছে এবং এখনও চলছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে খাল সংস্কারে অবৈধ উচ্ছেদের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটি কোন প্রক্রিয়ায় হবে তার কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা নেই। সূত্রমতে, কর্ণফুলী নদীর দুপাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে আরএস জরিপের ভিত্তিতে। অর্থাৎ আরএস জরিপ অনুযায়ী যেসব স্থাপনা গড়ে উঠেছে তাতে হাত দেয়া হবে না। অপরদিকে নগর অভ্যন্তরে যেসব খাল সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়েছে তা নাকি বিএস জরিপ অনুযায়ী সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন চউকের বিদায়ী চেয়ারম্যান ও সংস্থার বোর্ড। অথচ এটি সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত এবং এমনকি বেআইনী হিসেবেও দাবি রয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে। এদিকে সংস্কার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় শুরুতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশেষভাবে যেসব খাল চিহ্নিত করা হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- বির্জাখাল, মির্জাখাল, দোমখালি খাল, মহেশখালী খাল, গয়নাছড়া খাল, খন্দকিয়া খাল, নোয়াখাল, ফিরিঙ্গিবাজার খাল, চাক্তাইখাল, রাজাখালী খাল। এসবের মধ্যে এ পর্যন্ত ৪টি খালের সংস্কারে হাত দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রবল ও টানা বর্ষণের পর দেখা যায়, শহর এলাকায় জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ মোটেই কমেনি। আগের মতোই রয়ে গেছে। এমনও দেখা গেছে, বৃষ্টির সময় বিভিন্ন খালে কোন পানি নেই। অথচ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে থৈ থৈ পানি জমে থাকছে। এই বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত বর্তমানে যেসব খালের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলোর অধিকাংশের সঙ্গে অন্তসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। ফলে খালগুলোর মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক গতিতে পানি প্রবাহিত হচ্ছে না। অপরদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি যদি আমলে আনা যায় তাহলে এটিও অন্যতম একটি কারণ। কেননা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, হালিশহর, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, বাকলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকা গত কয়েক বছর ধরে বর্ষণের সময় জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। একদিকে সাগর থেকে আসা জোয়ারের পানি, অপরদিকে ভারি বর্ষণের পানি। সাগরের পানি লোকালয়ে ঢুকছে আর লোকালয়ে বর্ষণের পানি বেরুনোর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে সর্বত্র এখন জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। ফলে নতুন করে পরিকল্পনা গ্রহণে দাবিও উঠেছে নগরবিদদের পক্ষ থেকে। স্থপতি আশিক ইমরান জনকণ্ঠকে জানান, শুধু ভরাট হয়ে যাওয়া খাল এবং জোয়ারের পানির কারণ নয়। অন্যতম আরেকটি কারণ এর নেপথ্যে রয়েছে। তা হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা সড়কের যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি এবং পাহাড়খেকোদের আগ্রাসন। নগর অভ্যন্তরে কয়েকটি স্পটে বর্ষণ হলেই পাহাড়ের মাটি পানির সঙ্গে সড়কে চলে এসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। কিছু কিছু পাহাড়ের মালিক এবং অবৈধভাবে পাহাড় কাটায় যারা রত তারা বর্ষণের আগেই পাহাড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে যাতে বৃষ্টির পানিতে পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ে। এবং হচ্ছেও তাই। এ অবস্থায় পাহাড় কাটা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা বাঞ্ছনীয় বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন। এদিকে খাল সংস্কারে সরকার অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে ঠিকই। কিন্তু এ নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণীত হয়নি। যে কারণে সরকারী তহবিলের কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ খরচ হচ্ছে বটে কিন্তু কাক্সিক্ষত সুফল মিলছে না। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতেও কোন সুফল আসবে না বলে ধারণা করছেন নগর পরিকল্পনাবিদগণ।
×