ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নানা অপরাধে এরা জড়িত

ফের মাথাচাড়া দিয়েছে কিশোর গ্যাং, এবার ‘নিউ নাইন স্টার’

প্রকাশিত: ১০:৫১, ১৬ জুলাই ২০১৯

 ফের মাথাচাড়া দিয়েছে কিশোর গ্যাং, এবার ‘নিউ নাইন স্টার’

আজাদ সুলায়মান ॥ স্কুলছাত্র আদনান কবির হত্যার দু’বছরের মাথায় ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। দীর্ঘদিন বিরতির পর এবার তারা নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। নিউ নাইন স্টার গ্যাং নামে তারা ইতোমধ্যে হত্যাকান্ড, মাদক ব্যবসা, স্কুল কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। আদনান হত্যার পর এই গ্রুপের হত্যাকান্ডের শিকার হয় নাবিল মোশাররফ নামের এক স্কুলছাত্র। সর্বশেষ গত সপ্তাহে শুভ নামের আরও এক স্কুলছাত্রকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে এই বাহিনী। তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে শুভকে প্রকাশ্যে দিবালোকে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা সবাই কিশোর। এ হত্যাকান্ড তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাব পেয়ে যায় নিউ নাইন স্টার নামের ভয়ঙ্কর কিশোর অপরাধীদের সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান। তাদের ধরার জন্য সাঁড়াশি অভিযানে নামে র‌্যাব। তাতে প্রথম দিনেই ধরা পড়ে ১৪ কিশোর অপরাধী। যারা সবাই নিউ নাইন স্টারের সদস্য। এ বিষয়ে র‌্যাব জানিয়েছে- রাজধানীর উত্তরা, তুরাগ, আব্দুলাহপুর, টঙ্গী ও পার্শ¦বর্তী এলাকায় হঠাৎ করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এসব কিশোর অপরাধীরা। তারা বেশ কিছুদিন ধরে এলাকায় উৎপাত করছে। টানা কয়েকদিন নজরদারির পর তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেয়ে আটকের জন্য মাঠে নামে র‌্যাব-১। আগে এসব এলাকায় ছোট বড় অনেক কিশোর গ্যাং গ্রুপ থাকলেও র‌্যাবের একাধিক অভিযানে অধিকাংশ গ্যাং গ্রুপ নিষ্ক্রিয় হয়। কিন্তু হঠাৎ করে নিষ্ক্রিয় গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা নতুন নামে সংগঠিত হয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। র‌্যাব-১ এর গোয়েন্দা অনুসন্ধানে এ ধরনের তথ্য উঠে আসে। ওরা হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে ওঠায় নিজেদের মধ্যে আন্তঃকোন্দল দেখা দেয়। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে হত্যাকান্ডে মেতে ওঠে। এরই পরিণতিতে প্রাণ দিতে হয়েছে শুভর মতো নিরীহ স্কুল ছাত্রকে। র‌্যাব সূত্র জানিয়েছে, এই নাইন স্টার গ্যাং-এর মূল কাজই হলো- এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, স্কুল কলেজে র‌্যাগিং করা, স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, ছিনতাই, উচ্চ শব্দ করে মোটরসাইকেল বা গাড়ি চালিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, ছিনতাই, অশ্লীল ভিডিও শেয়ার করাসহ এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা। এরা এলাকার নিরীহ ও মেধাবী যুবক, কিশোরদের চাপে রেখে জোরপূর্বক দলে আসতে বাধ্য করে। গ্যাংভিত্তিক এদের নিজস্ব লোগো রয়েছে যা দেয়াল লিখন ও ফেসবুকে ব্যবহার করে। এরা ফেসবুকে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে হুমকি প্রদান করে স্ট্যাটাস দেয় এবং পরস্পরের আইডি হ্যাক করার চেষ্টা করে। এরা গ্যাং এর ওপর নির্মিত বিভিন্ন পশ্চিমা চলচ্চিত্র অনুসরণ করে থাকে। র‌্যাবের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে তুরাগ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকারী তেমনি একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ এর তথ্য পাওয়া যায়। এই গ্রুপটি এর আগে ২০১৭ সালের দিকে উত্তরা এলাকায় ‘নাইন স্টার’ নামে সক্রিয় ছিল। কিন্তু আদনান হত্যাকান্ডে জড়িত থাকায় এই গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হলে গ্যাংটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। সম্প্রতি তুরাগ এলাকায় ‘নিউ নাইন স্টার’ গ্যাং গ্রুপ নামে এটি আবারও আত্মপ্রকাশ করে। এরপরই শুরু হয় আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই র‌্যাব মাঠে নামে। প্রথমদিন উত্তরা ও দলিপাড়া এলাকা থেকে আটক করা হয় ১১ জনকে। তারা হলো- মোঃ হাবিবুর রহমান দাড়িয়া (৩০), ফয়সাল আহম্মেদ (১৭), রাকিবুল হাসান (১৬), মোঃ রমজান আলী (১৭), মোঃ বাবু মিয়া (১৭), মোঃ নজরল ইসলাম (২৭), মোঃ শাহীন হাওলাদার (১৫), তুহিন ইসলাম (১৫), মোঃ মাহমুদ হীরা (১৫), মোঃ রনি ইসলাম(১৫), মোঃ সাগর হোসেন (১৬)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২টি শর্টগান, ৪ রাউন্ড কার্তুজ, ১টি চাইনিজ কুড়াল ও ৩টি ধারাল ছুরি উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃত আসামিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায় যে, তারা ‘নিউ নাইন স্টার’ গ্যাং গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। গ্রেফতারকৃত হাবিবুর রহমান দাড়িয়া, ফয়সাল আহমেদ, বাবু মিয়া ও সাগর আগে উত্তরার ‘নাইন স্টার’ গ্যাং গ্রুপের সদস্য ছিল। বাকিরা তাদের মাধ্যমে নতুন করে দলে এসেছে। নতুন করে গ্রুপে আসা সদস্যরা সকলে স্থানীয় কয়েকটি নামকরা স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। তারা আগের মতোই তুরাগ এলাকায় সংগঠিত হয়ে আধিপত্য বিস্তার করে বলে স্বীকার করে। র‌্যাবের অনুসন্ধানে দেখা যায়- নিউ নাইন স্টার গ্যাং-এর সদস্য সংখ্যা শতাধিক। তাদের মধ্যে গত সপ্তাহে শুভ হত্যাকা-ের পর র‌্যাবের অভিযানে ক’জন ধরা পড়ে। এরপর বাকিরা গা ঢাকা দিলেও ক’জন আত্মগোপন করে উত্তরা ও দলিপাড়া এলাকায়। এ সম্পর্কে উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ জানিয়েছে, কিশোর গ্যাং স্টারের সদস্যরা বেশিরভাগই বিত্তবান পরিবারের। তাদের সহজে ধরা ছোয়া যায় না। তারপরও অর্ধশতাধিকের একটা তালিকা তৈরি করে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। গত সপ্তাহে টঙ্গীতে শুভ নামের এক স্কুল ছাত্র তারই সহপাঠীদের পৈশাচিক হামলার শিকার হওয়ার পর বিষয়টি আবারও সামনে আসে। এই চক্রটিই গতবছর ২০ মার্চ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে নাবিল মোবারক (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রকে হত্যার চেষ্টা করে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই কিশোরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও গ্রেফতার হয়নি হামলাকারী কিশোর। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের চার নম্বর সড়কের ৫৪ নম্বর বাড়ির ছাদে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার একদিন পর নাবিল মোবারকের বাবা মকছুদ আলী উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলাও দায়ের করেন। ওই পরিবারের অভিযোগ- সেদিন রাত ৮টার দিকে নাবিলের মায়ের মোবাইলে জীবন ঢালী নামে এক ছেলে ফোন দিয়ে নাবিলকে খোঁজে। সে নিজেকে নাবিলের বন্ধু পরিচয় দেয়। এরপর নাবিল বাসা থেকে বের হয়ে যায়। রাত ৯টার দিকে নাবিলের এক শিক্ষক ফোন করে জানান, নাবিল মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। এরপর সেখানে গিয়ে নাবিলকে তার মা ও ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পায়। সেখান থেকে চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। নাবিলকে হামলার আগে নিজের ফেসবুকে খুনের হুমকি দিয়ে স্ট্যাটাস দেয় জীবন ঢালী ওরফে সায়ান আহমেদ। সে অভিযুক্ত জীবন ঢালী (১৭) উত্তরার একটি স্কুলের দশম শ্রেণীর অনিয়মিত শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দির নাগেরকান্দি গ্রামে। তার বাবার নাম শাহিন মিয়া। ঘটনার দিন রাত ৮টা ৩২ মিনিটে জীবন তার ব্যবহৃত ফেসবুক আইডি দিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেয়। সেখানে সে ইংরেজি বর্ণে লেখে ‘সব শালারে খুন কইরা লামু’। এরপরই নাবিলকে তার বাসার ছাদে নিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সে। এ ঘটনার পর উত্তরার ‘ডিস্কো বয়েজ বাংলাদেশ’ গ্রুপ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দেয়। যেখানেই জীবনকে পাওয়া যাবে, সেখানেই তাকে দাফন করার কথা বলা হয়েছে ওই গ্রুপে। নাবিলের পরিবারের কোন সহযোগিতা লাগবে কিনা, তাও জানতে চেয়েছে ওই গ্রুপের সদস্যরা।
×