ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

৭১ এর এই দিনে ॥ বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী প্রতিষ্ঠা ॥ ১৭ জুলাই, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ১৭ জুলাই ২০১৯

৭১ এর এই দিনে ॥ বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী প্রতিষ্ঠা  ॥ ১৭ জুলাই, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৭ জুলাই দিনটি ছিল শনিবার। এই দিন শালদা নদীর রেলওয়ে স্টেশনের এক হাজার দক্ষিণে মনোরা রেলওয়ে ব্রিজ পর্যন্ত পাকবাহিনীর সৈন্যরা অগ্রসর হয়ে ব্রিজের চতুর্দিকে বাঙ্কার তৈরির প্রস্তুতি নেয়। এ সময় ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানির একটি প্লাটুন মর্টারসহ পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনারা সম্পূর্ণভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং বহু পাক সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা উপায়ান্তর না দেখে তাদের শালদা নদী ঘাঁটিতে ফিরে যায়। কুমিল্লা-চাঁদপুর রাস্তার আশীকাটি গ্রামের কাছে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা পাকবাহিনীর একটি কনভয়ের ওপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৮জন পাকসেনা নিহত ও অনেক আহত হয়। নিয়মিত ও গণবাহিনীর একটি সম্মিলিত কোম্পানি হাজীগঞ্জের কাছে পাকবাহিনীর নরসিংপুর ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকহানাদার বাহিনীর ১৩জন সৈন্য নিহত ও অনেক সৈন্য আহত হয়। আক্রমণ শেষে মুক্তিযোদ্ধা দল নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে আসে। লেঃ হুমায়ূন কবিরের এক প্লাটুন যোদ্ধা একদল পাকসেনাকে লাটুমুড়া থেকে চন্দ্রপুর যাওয়ার পথে এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে পাকবাহিনীর ৪জন নিহত ও একজন আহত হয় এবং বাকি সৈন্য প্রাণ বাঁচাতে লাটুমুড়ার দিকে পালিয়ে যায়। কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কে পুটিয়া গ্রামের সামনে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন একটি ওয়াপদা ট্রাক হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের পুঁতে রাখা এন্টি-ট্যাংক মাইনের ওপর বিস্ফোরিত হয়। ফলে ট্রাকটি ধ্বংস হয় এবং ট্রাকে অবস্থানরত একজন পাকসৈন্য, দু’জন রাজাকার ও ড্রাইভারসহ সবাই নিহত হয়। পরে পাকসেনাদের আর একটি জীপ ও ট্রাক এন্টি-ট্যাংক মাইনের বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়। এতে ৫ জন পাকসৈন্য, ১জন পাক মেজর ও ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে কুমিল্লা থেকে পাকসেনারা ৩০টি গাড়িতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। সামনের গাড়ি থেকে পাকসৈন্যরা নেমে আস্তে আস্তে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হলে এন্টিপার্সোনাল মাইন বিস্ফোরণে ৬-৭ জন সৈন্য নিহত ও অনেক আহত হয়। রামগঞ্জের উত্তরে নরিমপুর হতে এক কোম্পানি পাক রেঞ্জার্স ও রাজাকার দল মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলে হাবিলদার জাকির হোসেনের নেতৃত্বে এক প্লাটুন যোদ্ধা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর পাকসেনারা দু’জন রাজাকারের লাশ ফেলে পালিয়ে যায়। রাজশাহী জেলার শাহপাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর একটি টহলদার দলের ওপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকবাহিনীর ২২ জন সৈন্য নিহত হয়। গফরগাঁও থানার দেইল পাড় গ্রামে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচ- সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ১৭ জন নিহত ও ২৭ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা মানিকগঞ্জের ঘিওর থানা আক্রমণ করে পাক সেনাদের আহত করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করে। ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সের ঘোষণা মোতাবেক বাংলাদেশ নৌবাহিনী আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাঙালী অফিসার ও নাবিকগণ পশ্চিম পাকিস্তান ত্যাগ করে দেশে এসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠন করেন। ভারত থেকে প্রাপ্ত ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নামের ছোট দুটি গানবোট এবং ৪৯ জন নাবিক নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ সমস্ত নাবিকগণ শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হন। পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেঃ জেনারেল এ.এম.কে. নিয়াজী টাঙ্গাইল, শেরপুর ও হালুয়াঘাটের সেনাবাহিনীর ঘাঁটিসমূহ পরিদর্শন করে। শেরপুর ও হালুয়াঘাটে নিয়াজী রাজাকারের সশস্ত্র ট্রেনিং দেখেন এবং তাদের সেনাবাহিনীর পাশে থেকে কাজ করার নির্দেশ দেন। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধের সুপারিশ গৃহীত হয়। ভারতের বিহার রাজ্য থেকে প্রকাশিত সাময়িকী ‘কম্পাস’-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলাদেশের স্বীকৃতি সম্পর্কে সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশ সম্মেলন সমিতি কর্তৃক আয়োজিত এক জনসভায় দেশের সব রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সমূহের উদ্দেশ্য এই মর্মে আবেদন করেন যে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বিশেষ চাপ দেবার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেলেই ঐ দেশের মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে উপযুক্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে ইয়াহিয়া খানের হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা সহজ হয়ে উঠবে। শ্রী নারায়ণ এই অভিমত প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সেনারা যে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে তার ফলে ভারতকে এক ভীষণ সঙ্কটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই সঙ্কটের মধ্যে দিয়েই ভারতকে প্রকৃত রাজনৈতিক পরীক্ষা দিতে হবে। এই সঙ্কটের মাঝেই ভারত সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে অথবা তাকে ভাঙনের মুখে দাঁড়াতে হবে। আজ বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলছে তার বোঝা ভারতকে বহন করতেই হবে। বাংলাদেশ পরাজিত হলে, পরিণামে ভারতকেও পরাজয় বরণ করতে হবে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে ভারত শামিল হয়ে গেছে। পাকিস্তানের ওপর অন্যান্য রাষ্ট্রদের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য ভারত অপেক্ষা করতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ যে রায় দিয়েছেন তার মর্যাদা ভারতকে দিতে হবে। পাকিস্তান বাংলাদেশে যে নিপীড়ন ও অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তা থেকে সরে দাঁড়াবে না। আর তার নীতিরও পরিবর্তন ঘটাবে না। এমতাবস্থায় এক্ষুনিই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দিতে হবে। ভারতের স্বার্থেই এ কাজটা করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ থেকে যারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, তাঁদের আগমণের ফলে এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা রকমের জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের সামরিক চক্র যে টাকা খরচ করছেন, তার চাইতে তিন চারগুণ বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে ভারতকে বিনা যুদ্ধেই। যদি কেউ মনে করেন যে যুদ্ধ চলতে থাকলে পাকিস্তানের কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে, তাহলে তিনি ভুল করবেন। তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে, তাকে বাইরে থেকে মনে হবে গৃহযুদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে এ যুদ্ধ গৃহযৃদ্ধ নয়। এ যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী একটা জাতীয় সঙ্গে একটি মুক্তিকামী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জনগণের যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বার্তা বহন করে তিনি এটা উপলব্ধি করেছেন যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে পাকিস্তানী সামরিক চক্রের ভারত বিরোধী প্রচারকার্য ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সমস্যাবলী নিয়ে বিশ্বের দুটি রাষ্ট্র অর্থাৎ আমেরিকা ও ফ্রান্স অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে পাকিস্তানকে আরও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হবে না। কিন্তু পরবর্তী দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে আরও ছয়/সাত জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে। ফ্রান্স সরাসরি পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র না পাঠালেও সেখানে খোলাবাজারে পাকিস্তানের জনগণের কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। এখন ভারতে প্রায় ৭০ লাখ শরণার্থী এসেছে বাংলাদেশ থেকে। অদূর ভবিষ্যতে এই সংখ্যা এক কোটিতে দাঁড়াবে। তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের ও দুর্গত শরণার্থীদের সাহায্য দেয়ার জন্য এ পর্যন্ত বিহারের জনগণ ২৭ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছে। বিহারের অধিবাসীগণ বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৫০ লাখ টাকা সংগ্রহ করার এক কর্মসূচী নিয়েছে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ এ. কে. মল্লিক বলেন, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে বিহারের জনগণ যে ভূমিকা পালন করেছেন তা কোনদিনই বাংলাদেশের মানুষ ভুলবে না। ড. মল্লিক আরও বলেন, বাংলাদেশে বাঙালী হিন্দু ও বাঙালীর মধ্যে কোন শক্তিই ফাটল ধরাতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত বাংলার মুক্তিকামী মানুষ জয়ী হবেই। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে এখন যে যুদ্ধ চলছে তা হলো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার যুদ্ধ। এমতাবস্থায় গণতান্ত্রিক ভারতের জনগণ যদি বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাহলে বাংলাদেশের মুক্তি আরও ত্বরান্বিত হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×