ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ক্রিকেট হোক ইমেজ ও গর্বের হাতিয়ার

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ১৭ জুলাই ২০১৯

সিডনির মেলব্যাগ ॥ ক্রিকেট হোক ইমেজ ও গর্বের হাতিয়ার

এখনকার বাংলাদেশ কেমন সেটা জানার জন্য আমাদের ক্রিকেটারদের দেখাই যথেষ্ট। একসময় আমাদের দুধভাত মনে করলেও এখন আমরা সাবালক। ইংল্যান্ডে এবারের বিশ্বকাপে আমরা আর কতদূর যেতে পারতাম সেটা সময় বলবে। কিন্তু এ পর্যন্ত যা ঘটেছে তাতে বড় ছোট সবার মনে ভয় ঢুকিয়ে এবং ভালবাসা জাগিয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ আমাদের যৌবনের বা তারুণ্যের বাংলাদেশ। আমরাও ক্রিকেট ভালবাসতাম, খেলতামও। আমাদের আজকালকার মত এত সুন্দর উইকেট বা স্ট্যাম্প ছিল না। কাঠ কেটে বানাতাম। আমাদের ভাল কোন ব্যাট ছিল না, বলও না। আমাদের ছিল শুধু উৎসাহ আর প্রেরণা। তখন সবেমাত্র ডানা মেলছে আমাদের দেশ। কিন্তু তার শাসনে ছিল মিলিটারি জেনারেল। যাদের আরেক নাম একনায়ক। এরা কিভাবে খেলাধুলা বা জাতির যতœ নেবে? এদের তো পায়ের তলার মাটিই টলমলে। তাদের না ছিল জনসমর্থন না কোন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। খারাপ ভাল যাই বলেন না কেন রাজনীতি ছাড়া দেশ চলে? না কেউ চালাতে পারে? এসব জেনারেলরা নিজেদের দেবদূত ফেরেশতা বা মহানায়ক ভাবলেও মূলত এরা ছিল ধূর্ত আর সেনানির্ভর, মানে অস্ত্র নির্ভর। এসব শাসকের আমলে আমাদের দেশে ক্রিকেট খেলতে আসতো বিদেশের ক্লাব। তিন দিন দু’দিন এমন সব খেলাকেই আমরা ভাবতাম বিরাট কিছু।সে সময় এখন ইতিহাস। এখন বাংলাদেশ তার নিজস্বতায় উজ্জ্বল। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলসহ যেসব নেতারা এদেশের জন্মলগ্নে কাজ করেছেন; যাঁরা এ দেশের স্বপ্ন দেখেছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও জনমনে এমন সংশয় ছিল যে আমরা কি পারব? এমন কথাও শুনতাম বাংলাদেশ কি আসলেই দেশ হিসেবে মাথা তুলে বাঁচতে পারবে? দরিদ্র, অভাবী জাতির অপবাদ আজ মুছে গেছে। আর্থিকভাবে সামাজিক উন্নতিতে পাশের দেশকে টেক্কা দিয়ে চলা বাংলাদেশে এখন খেলাধুলাও চলে গেছে আরেক পর্যায়ে। আমাদের দেশের সাকিব আল হাসান বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। মনে পড়ে নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঢাকায় এসে তাঁর ভাষণে সাকিবের কথা বলেছিলেন। সাকিব শুধু কি একজন খেলোয়াড়? সে এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দূত। এই যে সম্ভাবনা আর উদ্ভাস এসব কি পাকিস্তানের সঙ্গে থাকলে সম্ভব হতো? তারা তো আমাদের মাঠে পানির বোতল নিয়ে দৌড়ানোতেই রেখে দিত। বড়জোর একজন কাউকে দ্বাদশ ব্যক্তি করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। বুঝতে দিত না আমরা কি পারি আর কি পারি না। এর নাম সেলফ স্টিম ডাউন করে দেয়া। উঠতে বসতে আপনাকে কেউ দমিয়ে রাখলে আপনি একসময় নিজ থেকেই অর্কমণ্য আর অপদার্থে পরিণত হবেন। বাঙালীকে তাই করতে চেয়েছিল পাকিস্তান। কথায় কথায় ফকির ভিখারি ডাকা আর শারীরিক শক্তির দোহাই দিয়ে ছোট করে রাখার ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। যে কারণে আজ আমরা মাথা তুলতে পারছি। আরও একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার। পাকিস্তান বা শক্তি নির্ভর যে কোন দলের দিন শেষ। জোশ আর খেলা এক বিষয় না। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যে কোন খেলাই উভয় দেশের জন্য যুদ্ধ। এই স্নায়ুযুদ্ধে পাকিস্তান চলতো জোশের ওপর ভর করে। ধীরে ধীরে ভারত সে চাপমুক্ত হতে পেরেছে বলে গত আটাশ বছর ক্রিকেট বিশ্বকাপে কোন খেলায় পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে জিততে পারেনি। পাকিস্তান কি আসলে তেমন কোন দল যে একবারও জিততে পারে না? পারে। কিন্তু ঐ যে জোশ আর খেলা মানে ধর্মযুদ্ধ- এই মানসিকতা পরিহার করতেই হবে। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে যারা মাতম করেন আমি তাদের দলে না। আবার যারা বলেন, খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশানো ঠিক না আমি তাদের দলেও না। রাজনীতি কারা মেশায়? আমরা না। যারা খেলার নামে পাকিস্তানকে অন্ধ সমর্থন দেয় বা ভারতের জন্য কাঁদে তারা? বাংলাদেশ সম্ভবত একমাত্র দেশ যে দেশের খেলায় সমর্থকের কেউ কেউ পাকিস্তান বা ভারতের প্রতি দুর্বলতা অনুভব করে। এই দুর্বলতা পাপ। আমি বাঙালী মুসলমানকে একতরফা দোষ দেব না। তাদের ভেতর যেমন মুষ্টিমেয় মানুষ পাকিস্তান বলতেই দুর্বল তেমনি আমি বাঙালী হিন্দুদের ও দেখেছি ভারতের জার্সি পরে মাঠে খেলা দেখতে যেতে। দুটোই অপরাধ। এমন কড়া আর অন্ধ সমর্থকের দরকার নেই আমাদের। আমাদের এখন সামনে যাবার সময়। বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম আর মর্যাদা নানা কারণে বাড়ছে। পোশাক, খাবার থেকে নানা বিষয়ে বিদেশের বাজারে সাড়া ফেলেছে আমাদের দেশ। ক্রিকেট সে মর্যাদাকে দিচ্ছে নতুন অভিধা। কিভাবে? বিশ্বের যেসব দেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় সেসব দেশেই আমাদের অভিবাসন আর যাতায়াত বেশি। আমাদের সিডনিতে এই সেদিনও বাংলাদেশ কোথায় এটা জানার জন্য এরা বলতো, নেক্সট টু ইন্ডিয়া? আমি সবসময় বলতাম নো। ইন্ডিয়া ইজ নেক্সট টু বাংলাদেশ। আজ তাও বলতে হয় না। ওরাই বলে দেবে সাকিবের কান্ট্রি? এভাবেই বড় হয়ে উঠছি আমরা। অকারণ জোশ আর ক্রিকেট না বুঝে সামাজিক মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানোদের বিষয়ে সাবধান হতে হবে। ভারতের সঙ্গে খেলা শুরুর আগেই এরা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পায়। আর পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা মানেই এরা বলে ঘৃণা করতে হবে। আমি কোনটাই নিতে পারি না। ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বৈরিতা আমরা সমর্থনের বেলায় মনে রাখব। কখনও তাদের সমর্থন না করতেও পারি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের গায়ে কেন নোংরা আঁচড় লাগতে দেব? খেলোয়াড়দের দেখুন তাদের ভেতর কিন্তু এখন তেমন আক্রোশ নেই। সেদিন দেখলাম ভারতের সঞ্জয় মাঞ্জেরকার আর পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরামের গলায় গলায় ভাব। একজন আরেকজনের সানগ্লাস চোখে লাগিয়ে মশকরা করছে। নানা ধরনের টুর্নামেন্টের কারণে খেলোয়াড়েরাও এখন বন্ধু। আমরাই শুধু ঝগড়া করে মরি। খেলায় বাদ প্রতিবাদ সমর্থন বিরোধিতা থাকবে। না থাকলে খেলার মজা কোথায়? কিন্তু সেটা যেন রাজনীতি না হয়। না হয় কোন দেশের প্রতি বিদ্বেষ। এ ধরনের আক্রোশ আর যাই করুক কোন জাতিকে সবল হতে সাহায্য করে না। আর একটা কথা বলা প্রয়োজন। কেন আউট হলে বা হেরে গেলেই আমরা ধরে নেব ষড়যন্ত্র হচ্ছে? বলছি না তা হয় না। হলে এর যথাযথ জবাব দিতে হবে। অকারণে ঝগড়া করে আর বিদ্বেষ ছড়িয়ে কি সমাধান মিলবে? এ ধরনের প্রক্রিয়া বন্ধুত্ব, ভাবমূর্তি আর দেশের সম্মান নষ্ট করে। যে কথাটা বলতে চাই খেলার শক্তি বা আমাদের খেলোয়াড়দের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে। আগেই বলেছি জোশ আর উন্মাদনার ক্রিকেট খেলতে গিয়ে পাকিস্তান আজ চরম সঙ্কটে। আর শুধু শক্তি নির্ভর হলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইলের সঙ্গে সাকিব কোনকালেও পারত না। যে কারণে শক্তির ক্রিকেট না আমরা চাই ক্রিকেটের শক্তি। ক্রিকেট এখন আমাদের পরিচয়, আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তি, আমাদের আন্তর্জাতিক ইমেজ।
×