ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একদিনে আক্রান্ত ১৭১ জন

রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে

প্রকাশিত: ১০:৫১, ১৭ জুলাই ২০১৯

রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েই চলেছে

নিখিল মানখিন ॥ রাজধানীতে বেড়েই চলেছে নতুন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। গত দু’ দিন গড়ে ঘণ্টায় ভর্তি হয় ছয় নতুন ডেঙ্গু রোগী। মঙ্গলবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাতজনে। অর্থাৎ এদিন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে মোট ১৭১ জন। আর সরকারী হিসাবে ১-১৬ জুলাই পর্যন্ত ভর্তি হয়েছে মোট ২৭৬৭ ডেঙ্গু রোগী। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত মোট আক্রান্ত হয়েছে ৪৭৩১ জন। গত তিনদিনে গড়ে ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছে ১১ জন নতুন রোগী। বেসরকারী পরিসংখ্যানে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যানে প্রতিবছর আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বেশি ডেঙ্গু রোগী দেখা যায়। অর্থাৎ এ বছরও ওই তিন মাসেও বিগত বছরগুলোর মতো ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা দিলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যাবে। ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। তাই রোগী ও চিকিৎসক উভয়কেই খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। জ্বর হলেই ডেঙ্গু টেস্ট পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে জানান, ডেঙ্গু কোন মারাত্মক রোগ নয় এবং এতে চিন্তার কিছু নেই। এই রোগ নিজে নিজেই ভাল হয়ে যায়, এমনকি কোন চিকিৎসা না করালেও। ডেঙ্গু নিয়ে অহেতুক ভয় নেই। সাধারণ ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঝুঁকি ১ শতাংশের কম। তবে মারাত্মক জটিলতা এড়াতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত। ডেঙ্গু রোগী ও তাদের অভিভাবকদের সজাগ থাকার পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, যেকোন জ্বরে আক্রান্ত রোগী যত বেশি বিশ্রামে থাকবে, যত বেশি তরল খাবার খাবে, তত দ্রুত জ্বর নিয়ন্ত্রণে আসবে। তাই ডেঙ্গুর মূল চিকিৎসা প্রচুর তরল বা পানি গ্রহণ করা, পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকা ইত্যাদি। যেকোন জ্বরে ১০১ ডিগ্রী ফারেনহাইটের ওপর তাপমাত্রা গেলেই তা কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে সাপোজিটরি ব্যবহার করতে হবে। প্রচুর পানি, শরবত ও তরল খাবার বেশি দিতে হবে। কোন অবস্থায়ই শরীরে যেন তরলের ঘাটতি না হয়। জ্বর হলে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোন ওষুধ খাবেন না। অন্যান্য ওষুধ প্রয়োগ না করাই উচিত। তবে যেকোন জ্বর তিনদিনের বেশি থাকলে, শরীরে প্রচ- ব্যথা থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এতে এ্যান্টিবায়োটিকের কোন ভূমিকা নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোন ব্যথার ওষুধ সেবন নয়। কেননা হেমোরেজিক ডেঙ্গু হলে কিছু ব্যথার ওষুধ রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে বিপদ ঘটাতে পারে। তীব্র জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখ ব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে অবশ্যই বিশ্রাম নিতে হবে। জ্বর কমে যাওয়ার পরের কিছুদিনকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড। এ সময়টায় সবার সচেতন থাকা খুব জরুরী। ডেঙ্গুর চিকিৎসা বাড়িতেও সম্ভব, তবে বেশি দুর্বল ও পানিশূন্য হয়ে পড়লে বা শরীরের কোথাও রক্তবিন্দুর মতো দাগ, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, নাক বা মাড়ি থেকে রক্ত পড়ার মতো যেকোন লক্ষণে দেরি না করে হাসপাতালে নিতে হবে। আক্রান্তদের কারও পেট ব্যথা বা ডায়রিয়া হলে সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত। ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্তরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। তাই সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া উচিত। ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। অন্য ভাইরাসজনিত রোগের মতো ডেঙ্গু রোগের সরাসরি কোন প্রতিষেধক নেই, টিকাও নেই। লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয় বলে জানান অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ। প্রতিবছর জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকে। তবে আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্তের মৌসুম যেন সারা বছর। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ বছর রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার দ্রুত বাড়ছে এবং আক্রান্তদের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হওয়ার হিড়িক পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ঘণ্টায় সাতজনের বেশি ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি ১ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৪৭৩১ জন। মারা গেছেন ৩ জন। চলতি বছরে মোট আক্রান্তের এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৬, ফেব্রুয়ারিতে ১৯, মার্চে ১২, এপ্রিলে ৪৫, মে’তে ১৫৩ এবং জুনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬৯৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। আর ১ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৭৬৭ জন। অর্থাৎ এই ১৬ দিনে গড়ে দৈনিক ১৬৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বেসরকারী হিসেবে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি হবে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ১৯ বছরে রাজধানীতে আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী ও মৃতের সংখ্যা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সালে ৫৫৫১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৯৩ জন, ২০০১ সালে ২৪৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৪৪ জন, ২০০২ সালে ৬২৩২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৫৮ জন, ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১০ জন, ২০০৪ সালে ৩৪৩৪ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৩ জন, ২০০৫ সালে আক্রান্ত ১০৪৮ জন ও মৃত্যু ৪ জন, ২০০৬ সালে আক্রান্ত ২২০০ জন ও মৃত্যু ঘটে ১১ জনের। এভাবে ২০০৭ সালে ৪৬৬ জন, ২০০৮ সালে ১১৫৩ জন, ২০০৯ সালে ৪৭৪ জন এবং ২০১০ সালে ৪০৯ আক্রান্ত হলেও ওই চারটি বছরে কেউ মারা যায়নি। আর ২০১১ সালে ১৩৫৯ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১২ সালে ৬৭১ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১ জন, ২০১৩ সালে ১৭৫৯ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ২ জন, ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন আক্রান্ত, ২০১৫ সালে ৩১৬২ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ৬ জন, ২০১৬ সালে ৬০৬০ জন আক্রান্ত ও মৃত্যু ১৪ জন, ২০১৭ সালে আক্রান্ত ২৭৬৯ ও মৃত্যু ৮ জন এবং ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্তের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যু ঘটে। রোগীদের দেখতে ঢামেকে ডিএসসিসি মেয়র ॥ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের খোঁজ-খবর নিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) গেলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। মঙ্গলবার বিকেলে তিনি ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের দেখতে যান। এ সময় তিনি ঢামেকের ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন তিনি। পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের উদ্দেশে মেয়র বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নগর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করে মাঠে আছে। অচিরেই শহরকে ডেঙ্গুমুক্ত করা হবে। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশে না, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরেও হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। সাঈদ খোকন বলেন, ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা কিন্তু ময়লা আবর্জনায় বংশ বিস্তার করে না। এটি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ পানিতে বংশ বিস্তার করে। তাই আমরা শীঘ্রই বাসাবাড়িতে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিগুলোতেও মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য মশক কর্মী পাঠাব। আপনারা তাদের বাসাবাড়িতে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে সহযোগিতা করবেন। সেই সঙ্গে আপনার প্রতিবেশীদেরও বলবেন যেন কোন পানি দুই দিনের বেশি জমিয়ে না রাখে। সবার সচেতনতায় আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে পারব। পরে ঢামেক হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে বঙ্গবাজার এলাকায় একটি ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিমের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন মেয়র।
×