ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তেজনার সেরা মুহূর্তটা দেখলাম লর্ডসের বিশ্বকাপ ফাইনালে ॥ স্টিভ ওয়াহ

প্রকাশিত: ১২:০০, ১৭ জুলাই ২০১৯

উত্তেজনার সেরা মুহূর্তটা দেখলাম লর্ডসের বিশ্বকাপ ফাইনালে ॥ স্টিভ ওয়াহ

ঐতিহাসিক ট্রাফালগার স্কোয়ারে ‘ক্রিইয়ো কাপ’ প্রতিযোগিতায় বিশেষ অতিথি হিসেবে এসেছিলেন তিনি। এতদিন লন্ডনে ছিলেন আইসিসির বিশ্বকাপ দূত হয়ে। ক্রিকেট উৎসাহীদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কিছু সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বললেন স্টিভ ওয়াহ। যার ট্রফি ক্যাবিনেটে দুটো বিশ্বকাপ আছে। সাতাশিতে এ্যালান বর্ডারের দলের তরুণ মুখ ছিলেন তিনি। নিরানব্বইতে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। তুলে দেয়া হলো সেই কথোপকথনের অংশ। নতুন বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দেখলাম রবিবার, তার প্রতিক্রিয়া : খুব বাজে। অস্ট্রেলিয়া আগে জিতেছে, ওদেরই আবার জেতা উচিত ছিল (হাসি)। তবে এটা খুবই ভাল ব্যাপার। যোগ্যতর দল হিসেবেই জিতেছে ইংল্যান্ড। যদিও আমার মনে হয় নিউজিল্যান্ড, যারা রাগবিতে খুব ভাল, তারা যদি জিততে পারত আরও মজা হতো। খেলাধুলার দুনিয়ায় অন্যতম সেরা দল ‘অল ব্ল্যাকস’। ফাইনালে পৌঁছনোর পর যদি ওরা শেষ হার্ডলটাও পেরোতে পারত, দারুণ ব্যাপার হতো। আগে ইংল্যান্ড তিনটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছে। গোটা দেশ বিশ্বকাপের আবেগে ভাসছিল। অবশেষে সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল মরগানদের জয়ের মধ্য দিয়ে। আমি জানি, বিশ্বকাপ জেতার অনুভূতি কী। সবাই কাপ ছুঁয়ে দেখতে চায়, অসাধারণ এক অনুভূতি। দেশের প্রত্যেকটা মানুষ ভাবে, আমি এই কাপ জিতেছি। দুর্দান্ত এক উৎসব। আর সেটাই করে দেখালো ইংল্যান্ড, প্রথমবারের মতো। অস্ট্রেলিয়ার বিদায়ে অবাক কি না : এটাই ক্রিকেট। একটা দল জিতবে, অন্যটা হারবে। ইংল্যান্ড দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলেছে। তবে অস্বীকার করব না, প্রথম সেমিফাইনালের ফল দেখে আমি অবাক হয়েছি। দ্বিতীয় সেমিফাইনালের ব্যাপারে বলব, জয়-পরাজয়ের বিরাট ব্যবধানটা আমাকে অবাক করেছে। কিন্তু সেটাই তো ক্রিকেট। কী ঘটবে, কেউ জানে না! বিশ্বকাপে বড় স্কোর সেভাবে দেখা গেল না কেন : মাঠ যখন ছোট ছিল আর পিচ ব্যাটিং-সহায়ক ছিল, তখন কিন্তু বড় রান হয়েছে। আমি কিন্তু ২৫০ বনাম ২৫০ ধরনের ওয়ান ডে ম্যাচ দেখতে বেশি ভালবাসি। তার কারণ, এই ম্যাচগুলোতে বোলারদের স্কিলটাও দেখা যায়। ব্যাটসম্যানদের ওপর পাল্টা চাপ তৈরি হয়। কিন্তু সেটা একান্তই আমার পছন্দ। হয়ত বেশি লোকে ৪০০ রানের খেলা দেখতে পছন্দ করে। লর্ডসের পিচ নিয়ে ভাবনা : আমার মনে হয়, সহজ ব্যাটিং উইকেটই মনে হচ্ছিল। রবিবার হয়ত ৩৫০ প্লাস স্কোর আশা করেছিলাম। কিন্তু হয়নি। বিশ্বকাপ দশ দলের হওয়া নিয়ে : আমার মনে হয় আফগানিস্তান দারুণ এক সাফল্যের কাহিনী। ওরা কিন্তু অন্যান্য দেশকে উদ্বুদ্ধ করছে ক্রিকেটে উঠে আসার জন্য। ওরা দুর্দান্ত। আমার মতে, আরও অনেক দেশকেও যুক্ত করতে হবে। ক্রিকেটের বিশ্বায়ন ঘটাতেই হবে। ক্রিকেটকে যদি অন্যান্য বড় খেলার সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়, তা হলে বিশ্বায়ন খুবই দরকার। হয়ত কিছু দেশকে স্ট্রিট ক্রিকেট খেলিয়ে উৎসাহিত করা যেতে পারে। অভিজ্ঞ লোকদের সেই সব দেশে পাঠিয়ে কাজ শুরু করা যায়। অনেক দেশেই প্রতিভা আছে। কিন্তু ক্রিকেটের পরিকাঠামো নেই। অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তুতি নিয়ে : আমার মনে হয়, ওরা অন্য রকম পিচ হবে ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিল। আসলে পিচ নিয়ে অত ভেবে বিশ্বকাপে খেলতে আসা যায় না। সব রকম পরিবেশ, পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হবে। বিশ্বকাপ জিততে গেলে সেই স্কিলটুকু থাকতেই হবে। কেউ যদি বলে, এক রকম পিচ হবে ভেবে এখানে খেলতে এসেছিলাম আর এসে দেখলাম অন্য রকম, তা হলে আমি বলব, অজুহাত দিচ্ছে। তুমি তো পেশাদার ক্রিকেটার, তাই না? তা হলে সব রকম পরিস্থিতি, পিচের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে না কেন? তোমরা বিশ্বের সব জায়গায় খেলে বেড়াচ্ছ সারা বছর। কোন পিচ আর কোন পরিবেশ তোমাদের জানতে বাকি থাকছে? তোমরা ভাল প্লেয়ার। তা হলে পারবে না কেন? প্রথম সেমিফাইনাল কি অঘটন এবং বিরাট কোহলির ক্যাপ্টেন্সিতে কোন ভুল ছিল কিনা : আমার মনে হয়, আমার চেয়ে ভারতীয়দের কাছে এই ফল বেশি অপ্রত্যাশিত ছিল। বিরাটের ক্যাপ্টেন্সিতে কোন ট্যাকটিকাল ভুল ছিল আমি মনে করি না। নিউজিল্যান্ড খুবই ভাল ক্রিকেট খেলেছে। জিমি নিশামের দুর্দান্ত ক্যাচ আর মার্টিন গাপটিলের অবিশ্বাস্য সরাসরি থ্রো দেখিয়ে দিল, বিশ্বকাপে অসাধারণ ফিল্ডিং উৎকর্ষও ম্যাচ জেতাতে পারে। আর এক জনের কথা বলব। রস টেইলর। নিউজিল্যান্ডের এই জয়ে উইলিয়ামসন এবং টেইলরের অনেক কৃতিত্ব প্রাপ্য। মন্থর ব্যাটিংয়ের জন্য ওদের অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ, পরিস্থিতিটা যে ওরাই সব চেয়ে ভাল ধরতে পেরেছিল। শুনুন, বিশ্বকাপ জিততে গেলে ‘স্ট্রিট স্মার্ট’ হতে হবে। উইলিয়ামসন আর টেইলর সেদিন সেটাই করেছে। ইচ্ছা করলেই ওরা অস্ট্রেলিয়া বা ভারতের মতো ব্যাট চালাতে পারত। আর তা হলেই হুড়মুড় করে উইকেট পড়ে যেত। নিউজিল্যান্ড একটা রণনীতি নিয়ে খেলতে নেমেছিল। পরিকল্পনা করে এসেছিল। কোহলির খুঁত ধরার চেয়েও আমি তাই বেশি কৃতিত্ব দেব নিউজিল্যান্ডকে। কোহলির ক্যাপ্টেন্সিতে পরাজয়ের চেয়েও বড় বিষয় এটা নিউজিল্যান্ডের জয়। এ ভাবেই দেখতে চাই আমি। দক্ষিণ আফ্রিকা নিয়ে হতাশ কি না : এটা স্বীকার করতেই হবে যে, দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে আমি একই সঙ্গে হতাশ এবং অবাক। এবারও ওরা এসেছিল বিশ্বকাপ জেতার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু সেই খালি হাতেই ফিরতে হলো। আমার মনে হয়েছিল, এবার দক্ষিণ আফ্রিকা ভাল করবে। কারণ ওদের ঘিরে প্রত্যাশা কিছুটা কম ছিল। প্রত্যেকবারই অন্যতম ফেবারিট হিসেবে ওরা খেলতে আসে। সবচেয়ে হতাশ নিশ্চই ওরাই হয়েছে। ফল যা দেখাচ্ছে, তার চেয়ে ভাল দল ওরা। খুবই কঠিন প্রতিপক্ষ যে হয়ে উঠতে পারে, সেটা আমরা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই দেখেছি। বিশ্বকাপের যে কোন দলকে হারানোর দক্ষতা দক্ষিণ আফ্রিকার ছিল। তাই এই করুণ বিদায়ে ওরা অবশ্যই হতাশ হয়েছে। আটত্রিশের ধোনিকে নিয়ে সমালোচনা এবং তার মতামত : শুনুন, ওয়ান ডে ক্রিকেটে এক জন জিনিয়াস ধোনি। সেমিফাইনালেও রান আউটটা হওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের অনেকেরই মনে হচ্ছিল, ওই ম্যাচ বার করে নিতে পারে। একটা কথা মনে রাখতে হবে। ধোনি যদি ম্যাচউইনার না হতো, ওকে নিয়ে এত কথা হতোই না। অসংখ্যবার ও ম্যাচউইনারের কাজ করে দিয়েছে! কতবার অবিশ্বাস্য সব জায়গা থেকে ও ভারতকে জিতিয়ে দিয়েছে! ধোনিকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে, কারণ ও এখনও খেলেই চলেছে তাই। হয়ত বেশি লম্বাই খেলে চলেছে। কিন্তু এটাও ঠিক, যতক্ষণ ও ক্রিজে থাকে, ভারতের আশাও বেঁচে থাকে। ধোনির ক্রিকেট দক্ষতায় এখনও আস্থা রাখি। এই ইংল্যান্ড কেন অতীতের দলগুলো থেকে আলাদা : প্রথম কারণ, এই ইংল্যান্ড দলটা ভয়ডরহীনভাবে খেলেছে। পেশাদার খেলায় এই জিনিসটা করা খুব কঠিন। এই দলটার কোন দুর্বলতা ছিল না। খুব ভাল ফিল্ডিং দল। ব্যাটিংয়ে দারুণ গভীরতা। বোলিংয়ে নানা রকম বিকল্প হাতে ছিল। অর্থাৎ সম্পূর্ণ একটা দল হয়ে খেলেছে ওরা। আমার দেখা সেরা ওয়ানডে টিমগুলোর একটা এই ইংল্যান্ড। আর ওদের চূড়ান্ত যোগ্যতা নির্ধারণ হয়ে গেল রবিবারের ফাইনালে। ওরা ফাইনালটা জিততে পেরে ইংল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা ওয়ানডে টিম আখ্যা পেয়ে গেল। আর যদি ওরা হেরে যেত, তা হলে বলতে হতো ইংল্যান্ড সেই টিমগুলোর একটা যারা চেষ্টা করেছিল জেতার, কিন্তু পারেনি। বিশ্বকাপের মান নিয়ে খুশি নাকি ১০০ বলের ক্রিকেট প্রতিযোগিতাই ভবিষ্যত : (হাসি) জানি না। এক শ’ বলের ক্রিকেট নিয়ে খুব বেশি তথ্য আমার কাছে নেই। এরপর হয়ত স্ট্রিট ক্রিকেট আসবে। লোকে যা দেখে উপভোগ করবে, সেটাই আমার কাছে ঠিক আছে। তবে আমার ব্যক্তিগত মতো যদি চান, টেস্ট ক্রিকেটই সব সময় সেরা ফর্মেট হিসেবে থাকবে। খেলোয়াড়দেরও অর্থনৈতিক সুরক্ষা দরকার। নিজের, পরিবারের বা পরবর্তীকালে যদি ব্যবসা করে জীবিকা চালাতে হয়, সেই নিরাপত্তা দরকার। যতক্ষণ না টেস্ট ক্রিকেটকে উপেক্ষার স্তরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, সব ধরনের ফর্মেট নিয়ে চলতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে কোন কিছুই যেন টেস্ট ক্রিকেটকে বিসর্জন দেয়ার বিনিময়ে না আসে। টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ : অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। অন্তত দশ বছর আগে। কিন্তু এখনও হয়ে ওঠেনি। এবারে হবে শুনছি। টেস্টের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অবশ্যই দরকার। বিশ্বকাপের সেরা মুহূর্ত : এবারের বিশ্বকাপ আমি খুব বেশি দেখতে পারিনি। তবে ফাইনালে যে চমক দেখলাম, তা অবিশ্বাস্য। ম্যাচ টাই, সুপার ওভারও টাই। কি আশ্চর্য। তবে একটা মুহূর্তকে বেছে নেয়া কঠিন। বেন স্টোকসের ক্যাচটা অবিশ্বাস্য ছিল। আমার মনে হয়, ওর ক্যাচটা দুর্দান্ত একটা বিশ্বকাপের মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছিল। শেল্ডন কটরেলের ক্যাচটার কথাও বলতে হবে। অবশ্যই সেমিফাইনালে মার্টিন গাপটিলের রান আউট (ধোনিকে যা ফিরিয়ে দেয়)। এগুলো প্রত্যেকটাই খুব মনে রাখার মতো মুহূর্ত হয়ে থাকছে। তবে সেরা মুহূর্তটা দেখলাম লর্ডসে ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালে। গোটা ম্যাচটাই ছিল উপভোগ্য। সূত্র : ইন্টারনেট
×