ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাত বিদেশীর হাত ধরে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড!

প্রকাশিত: ১২:০১, ১৭ জুলাই ২০১৯

সাত বিদেশীর হাত ধরে চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড!

ইংল্যান্ডে ভিনদেশীদের অবদান কতটা গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বকাপ ক্রিকেট তার বড় উদাহরণ। যে দলটার হাত ধরে দীর্ঘ ৪৪ বছরে প্রথম শিরোপা জিতল ইংলিশরা সেখানে সাতজনই ছিলেন বিদেশী! বড় নাম অবশ্যই অধিনায়ক ইয়ন মরগান। ৩২ বছর বয়সী তারকা তারকা জন্মভূমি আয়ারল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও খেলেছেন! পরে কাউন্টি খেলে নাগরিকত্ব নিয়ে ইংল্যান্ড দলে জায়গা করে নেন। গতবার গ্রুপপর্ব থেকে বাদ পড়া দলটাকে যেন জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় বদলে দেন তিনি। অবিশ্বাস্য উত্থানের গল্প লিখে অভিবাসী দেশটির হাতে তুলে দেন স্বপ্নের অধরা শিরোপা। শুধু তাই নয়, ঘরের মটিতে ইংল্যান্ডের এবারের বিশ্বকাপে পনেরো সদস্যের দলের বাকি ছয়জন হলেন বেন স্টোকস, জেসন রয়, জোফরা আর্চার, মঈন আলি, আদিল রশীদ ও টম কুরান। যদিও দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া টম কুরানের বিশ্বকাপে খেলা হয়নি। কন্ডিশনের কারণেই পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত দুই স্পিনার আদিল রশীদ আর মঈন আলি ছিলেন অদল-বদল হয়ে। তবে অধিনায়ক মরগানের সঙ্গে শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন নিউজিল্যান্ডে বংশোদ্ভূত বেন স্টোকস ও দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া জেসন রয় এবং ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান জোফরা আর্চার। ইংল্যান্ড দলের অধিনায়ক ইয়ন মরগান ২০০৭ সালে আয়ারল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছে!। ২০০৯ সাল থেকে তিনি ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা শুরু করেন। পরপর ৩টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের হয়ে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ইংল্যান্ডে আসার আগে আয়ারল্যান্ড দলে মরগানকে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন আইরিশ তারকা নাথান ও’ব্রায়েন। তার মতে, মরগান হলো সেই ক্রিকেটার যে সব সময় মাঠে সেরা ক্রিকেটার ছিল। আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলা ২৩ ম্যাচে মরগানের স্ট্রাইকরেট ছিল ৭১.৬৭। আর ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা ২১০ ম্যাচে তার স্ট্রাইকরেট ৯৪.১৯। ২০১১ আইপিএলে ২ লাখ ২০ হাজার পাউন্ডের চুক্তিতে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে খেলেন মরগান। কিন্তু আসরের মাঝপথে তিনি ফিরে যান ইংল্যান্ড এবং ‘এ’ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯৩ রানের ইনিংস খেলে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের পথ সুগম করেন। ব্যক্তি মরগানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো তিনি যা ভাল মনে করেন, তা করতে দ্বিধা করেন না। যেমন বাংলাদেশে ইংল্যান্ডের সর্বশেষ সফরে তিনি আসেননি। নিরাপত্তাজনিত কারণে ওই সফর থেকে নাম তুলে নেয়ায় ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন তিনি। নিজের কাজ ও কর্মের প্রতি এ রকম অবিচলতাই তাকে তার পূর্বসূরীদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। ইংলিশদের হয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ে চিরদিনের জন্য তার উঠে গেল গ্রেট অধিনায়কদের তালিকায়। মাইক বেয়ারলি, মাইক গ্যাটিং, গ্রাহাম গুচের মতো কিংবদন্তিও যা পারেননি সেটিই করে দেখালেন মরাগন। মরগানের পর স্টোকসের কথা আলাদা করে বলতে হবে। দীর্ঘ ৪৪ বছরের আক্ষেপ ঘুচল ইংল্যান্ডের। রবিবার ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তুমুল উন্মাদনার ফাইনাল ‘টাই’ হলে ‘সুপার ওভারে’ নাটকীয় জয়ে প্রথম বারের মতো বিশ্বকাপে শিরোপার স্বাদ পেল ক্রিকেটের জনক ইংলিশরা। সুপার ওভারও ‘টাই’ হলে বাউন্ডারি সংখ্যায় ম্যাচের ফয়সালা হয়! আর তাদের স্মরণীয় এ জয়ের নায়ক বেন স্টোকস। ৯৮ বলে ৫ চার ও ২ ছক্কায় অপরাজিত ৮৪ রান করে তিনিই মূলত ইংল্যান্ডকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু নির্ধারিত ৫০ ওভারে ফয়সালা করে আসতে পারেননি। কিউইদের ২৪১/৮Ñএর জবাবে ২৪১ রানে অলআউট স্বাগতিকরা! সুপার ওভারেও ১৫ রানের মধ্যে ৮ রান এই অলরাউন্ডারের। তবে নিয়মিত উইকেট হারিয়ে শঙ্কায় পড়া দলকে ভীষণ চাপের মধ্যে জয়ের পথ দেখানো চমৎকার ইনিংসটি স্টোকসকে এনে দেয় ম্যাচসেরার উপহার। সেটিও আবার জন্মভূমি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আসাধারণ এই ফাইনালে! অলরাউন্ডার হিসেবে বিখ্যাত বেন স্টোকসের জন্ম নিউজিল্যান্ডে হলেও বর্তমানে ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটার তিনি। ২০১১ সাল থেকে ইংল্যান্ডের হয়ে নিয়মিত খেলছেন স্টোকস। আসরজুড়ে জনি বেয়ারস্টো, জো রুট, জেসন রয় ব্যাট হাতে রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন, বল হাতে উইকেট নিয়ে আসর মাতিয়েছেন আরেক ভিনদেশী জোফরা আর্চার। তবে নিরবে নিজের অলরাউন্ডার সত্তার পরিচয় দিয়েছেন স্টোকস। ৬৬ গড়ে করেছেন ৪৬৫ রান। হাফ সেঞ্চুরি ৫টি। যার একটি খেললেন ফাইনালে। আসরজুড়ে শিকার গুরুত্বপূর্ণ ৭ উইকেট। ইংল্যান্ড দলে এবারের বিশ্বকাপে অল রাউন্ড পারফর্ম করে আলোচনায় ছিলেন সুপার স্টোকস। তবে ফাইনালের আগে স্টোকস কেবল ইংলিশ ক্রিকেটার হিসেবেই আলোচনায় ছিলেন না। তিনি আলোচনায় ছিলেন জন্মভূমির বিপক্ষে খেলছেন বলে। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে ১৯৯১ সালে জন্মগ্রহণ করেন ২৮ বছর বয়সী বেন স্টোকস। তবে পিতার চাকরির সুবাদে ছোটবেলাতেই ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। তার বাবা নিউজিল্যান্ডের এক সময়কার রাগবী খেলোয়াড় ছিলেন। বর্তমানে স্টোকসের পিতা রাগবীর কোচিংও করিয়ে থাকেন। তাইতো চাকরির সুবাদেই ইংল্যান্ডে চলে আসতে হয় পুরো পরিবারকেই। ককারমাউথে বসবাস শুরু করেন স্টোকস পরিবার। সেখান থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ জন্মায় বেন স্টোকসের। ২০০৯ সালে ডারহামের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে বেন স্টোকসের। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এবার জন্মভূমি নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ইংল্যান্ডের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ে ফাইনালের নায়ক বনে গেলেন ক্রেজি স্টোকস। আর বিধ্বংসী ওপেনার জেসন রয়ের জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকায়। ২০১৪ সাল থেকে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলছেন। তাঁর বিধ্বংসী ব্যাটিং ইংল্যান্ডের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। ইংল্যান্ডের এই ওপেনারের উপরে ভরসা ছিল পুরো দলের। তার প্রতিদানও দিয়েছেন তিনি। ১ সেঞ্চুরি ও ৪ হাফ সেঞ্চুরিতে ৬৪ গড়ে করেছেন ৪৪৩ রান। নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার মঈন আলী। পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত এই ২০০৬ সালে ইংল্যান্ড অনুর্ধ-১৯ দলকে নেতৃত্ব দেন। সেবার ইংল্যান্ড শেষ চারে পৌঁছেছিল। টেস্ট ক্রিকেটে গ্রায়েম সোয়ানের জায়গা নেন মঈন। মঈন আলীর সঙ্গী আদিল রশীদও পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডের হয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটে আদিলের। বিশ্বকাপে এবার ইংল্যান্ডের প্রধাণ স্পিনারের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ভিনদেশীদের মধ্যে সবমেষ আলোচিত নাম জোফরা আর্চার। বিশ্বকাপের জন্য ইংল্যান্ডের যে প্রাথমিক দল ঘোষণা করা হয়েছিল তাতে তাঁকে রাখা হয়নি। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে সিরিজের শেষ কয়েকটা ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন আর্চার। সেখানে এবং আইপিএলে তার চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের দৌলতে ডেভিড উইলির পরিবর্তে বিশ্বকাপে আর্চারকে খেলার সুযোগ দেওয়া হয়। ফাইনালে ইংল্যান্ডের হয়ে সুপার ওভার বল করা এই তরুণ এখন দেশের হিরো। বিশ্বকাপে পারফরম্যান্স বিগত চার বছর ধরে ৫০ ওভারের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের হয়ে ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলা ডেভিড উইলির পরিবর্তে বিশ্বকাপ দলে আর্চারকে অন্তর্ভুক্ত করে ঝুঁকি নিয়েছিলেন নির্বাচকরা। সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দেন আর্চার। ২০১৯ বিশ্বকাপে ১১টি ম্যাচ খেলে ২০টি উইকেট নিয়েছেন তিনি। টুর্নামেন্টে সর্বাধিক উইকেট শিকারীর তালিকায় তৃতীয় হয়েছেন আর্চার। টুর্নামেন্ট জুড়ে তার বিষাক্ত পেস-বাউন্সে নাজেহাল হন তাবত সব ব্যাটসম্যান। ১৪ জুলাই ২০১৯ বেন স্টোকসের মতোই দিনটি সোনা দিয়ে বাঁধিয়া রাখবেন আর্চার। ঐতিহাসিক লর্ডসে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের ফাইনালের প্রথম স্পেল খুব একটা আহামরি না হলেও নিজের দ্বিতীয় স্পেলে কেরামতি দেখান আর্চার। স্লগ ওভারে কম রান দেওয়ার পাশাপাশি ১টি উইকেটও নেন। ম্যাচ যখন সুপার ওভার পর্যন্ত গড়ায় কোনও কিছু না ভেবে আর্চারের হাতেই বল তুলে দেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক ইয়ন মরগান। ওভারে একটা ছয় খেয়েও দুর্দান্তভাবে লড়াইয়ে ফিরে আসেন তরুণ পেসার। নাগরিকত্ব : আর্চারের জন্ম ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বাডোজে। তাঁর বাবা একজন ব্রিটিশ। ইংল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করে আর্চারের পরিবার। ২০২২ সালের আগে তা সম্ভব নয় বলে প্রথমে জানিয়ে দিয়েছিল সেদেশের সরকার। কিন্তু এরই মধ্যে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) গত নবেম্বরে তাদের কোয়ালিফিকেশন ক্রাইটেরিয়া পরিবর্তন করে। এর দৌলতেই গত মার্চ মাস থেকে ইংল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন আর্চার। বিশ্বকাপ দলে আর্চারকে রাখা নিয়ে যারা সমালোচনা করেছিলেন, এখন তারাই সেই সিদ্ধান্তকেই বাহবা দিচ্ছেন।
×