ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া মাছ, বেড়েছে ইলিশ

প্রকাশিত: ১০:১৯, ১৮ জুলাই ২০১৯

 ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া মাছ, বেড়েছে ইলিশ

সমুদ্র হক ॥ মাছে ভাতে বাঙালীর পরিচয়ে মিঠা পানির যে মাছগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল তা পুনরুদ্ধারে দেশের মৎস্য বিভাগ খুশির খবর দিয়েছে। বিপন্নের পথে যাওয়া মিঠা পানির ৫৪ প্রজাতির মধ্যে গবেষণা ও বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে অন্তত ৪০ প্রজাতির মাছকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বাকিগুলোও ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। একক প্রজাতির ইলিশের আলাদা হিসাব আছে। আগামী দু’বছরের মধ্যে ২৪ প্রজাতির সামুদ্রিক চিংড়িসহ সামুদ্রিক মাছের অনেক প্রজাতির উৎপাদন বাড়ানো যাবে। মৎস্য বিভাগের এমন সফলতা নিয়ে দেশে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ শুরু হয়েছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘মাছ চাষে গড়বো দেশ,বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। দেশে মিঠা বা স্বাদু পানির মাছের প্রজাতি ২৬০। সামুদ্রিক প্রজাতি ৪৭৫। মিঠা পানির মাছের অভয়ারণ্য যেভাবে তৈরি হয়েছে সামুদ্রিক জলাশয় সেভাবে তৈরি হয়নি। আশা করা হয়েছে আগামী দু’বছরের মধ্যে ২৪ প্রজাতির সামুদ্রিক চিংড়িসহ সামুদ্রিক মাছের অনেক প্রজাতির উৎপাদন বাড়ানো যাবে। এই লক্ষ্যে সমুদ্রে মাছ চাষের গবেষণা এবং উৎপাদনের জন্য বিশেষায়িত কয়েকটি জাহাজ ও ট্রলার আমদানি করা হয়েছে। সমুদ্রে মৎস্য আহরণে জেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। মাছ নিয়ে গল্প কথার শেষ নেই। চিরচেনা এইসব মাছের বেশিরভাগই কিছুদিন আগেও সহজে চোখে পড়ত না। মৎস্য বিভাগ উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সরপুঁটি, কৈ, গুজি, বাইম, পুঁটি, গুলসা, বউ, চেলা, বাল্যে, ফলি, পাবদা, কানছ (শিং) মাগুর, ভ্যাদা মাছের উৎপাদন বাড়িয়েছে। ট্যাংরা, খোকশা, কালাবাটা, ঢেলা, মওয়া, লটা, শোল, বাইম, চান্দা, তিলপুঁটি, ফলই, কালবাউশ, গুইজা, একঠোটা ইত্যাদি মাছের যে জাত বিলুপ্তির পথে যাচ্ছিল সেগুলোও ফিরিয়ে আনা হয়েছে। প্রজননকৃত রই, কাতলা, পাঙ্গাস, বোয়াল, মৃগেল, আইড়, চিতল, শোল, গজার, বাঘা আইড় মাছগুলোর চাষ হচ্ছে। বিদেশ থেকে আসা জাতগুলোর মধ্যে আছে সিলভার কার্প, গোল্ড কার্প, মিরর কার্প, গ্রাস কার্প, বিগহেড, নাইলোটিকা, থাই কৈ, ভিয়েতনামী কৈ, তেলাপুয়ে, ব্লাক কার্প, কমন কার্প জাতের মাছগুলো পুকুর খাল বিলে চাষ করে অধিক উৎপাদন মিলছে। ইলিশ উৎপাদনের আলাদা হিসাব আছে। চিংড়ির দুই জাত বাগদা ও গলদা হিমায়িত প্যাকেটজাত হয়ে রফতানির সিঁড়িতে অনেক আগেই উঠেছে। রফতানির খাতে মাছ এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত। মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে ২ হাজার ২১ সালের মধ্যে দেশে মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে মাছের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি মাছ চলমান প্রক্রিয়ায় বিদেশে রফতানি হবে। ইলিশের একটি সুখবর দিয়েছে মৎস্য বিভাগ। বিশ্বের বিভিন্ন সাগর তীরের যে ১১ দেশে ইলিশ উৎপাদিত হয় তার দশটিতেই উৎপাদন কমেছে। একমাত্র বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছ। ক’বছর ধরে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদফতর, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, পুলিশ সম্মিলিতভাবে জাটকা রক্ষায় যে অভিযান চালাচ্ছে তাতে উৎপাদন বেড়েছে এবং আগামীতে আরও বোড়বে। ছয় বছর আগে ইলিশের উৎপাদন ছিল সাড়ে তিন লাখ মে. টন। বর্তমানে ইলিশের উৎপাদন ৬ লাখ মে.টনের বেশি। বিশ্বের মোট উৎপাদিত ইলিশের ৬৫ শতাংশই বাংলাদেশের। ভারতের ১৫ শতাংশ ও মিয়ানমারের ১০ শতাংশ। বাকিটা অন্য ৮ দেশের। মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এস এম রাশেদুল হক জানান, দেশে এই প্রথম ইলিশ প্রক্রিয়াজাত করে স্যুপ ও নুডলস তৈরি হচ্ছে। কাঁটা অবমুক্ত করে প্রক্রিয়াজাত পণ্যের উদ্ভাবক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের মাৎস্য প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. নওশাদ আলম। ইলিশের যে পুষ্টিমান তা ঠিক থাকছে। স্বাদ গন্ধ ঠিক রাখতে ইলিশের তেল বা চর্বি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঠিক রাখা হয়েছে। ইলিশের মধ্যে খাবার উপযোগী উপাদান ৬০ শতাংশ। এ ছাড়াও আছে আমিষ ও খনিজ চর্বি, ওমেগা-৩ ফ্যাট, অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এ্যাসিড, কয়েক ধরনের এ্যামাইনো এ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন। যকৃতে আছে ভিটামিন এ, তেলে আছে ভিটামিন এ বি ডি। প্রক্রিয়াজাত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করছে মৎস্য অধিদফতর। বছরে প্রতিজনের মাছের চাহিদা ২১ দশমিক ৯০ কেজি করে। প্রতিজনে মিলছে ২০ দশমিক ৩০ কেজি করে। এই ঘাটতি মিলিয়ে আগামী ২ হাজার ২১ সালের মধ্যে মাছের উৎপাদন প্রায় ৫০ লাখ মে.টনে পৌঁছবে। ওই সময়ে বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদা সম্পূর্ণ মিটিয়ে মাছ রফতানি করা যাবে। অপ্রচলিত মাছ যেমন কাঁকড়া, কুঁচা গজার চ্যাং ইত্যাদি মাছগুলো রফতানির তালিকায় বেশি যোগ হবে। বদ্ধ জলাশয়, আধাবদ্ধ জলাশয় উন্মুক্ত জলাশয় ও সামুদ্রিক জলাশয় এই চার শ্রেণীর জলাশয়কে কয়েক ভাগে ভাগ করে মাছ চাষে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। মৎস্য বিভাগের হিসাবে দেশে বদ্ধ জলাশয় বা পুকুরের পরিমাণ ৩ লাখ ৭১ হাজার ৩০৯ হেক্টর। মৌসুমি জলাশয় ১ লাখ ৩০ হাজার ৪৮৮ হেক্টর। বাঁওড় ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর। চিংড়ির খামার ২ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৪ হেক্টর। প্লাবন ভূমি ৬ হাজার ৭৭৫ হেক্টর। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, বাঙালী নদীর মাছের স্বাদই আলাদা। মাছের রাজা পদ্মার ইলিশের স্বাদ একেবারে রাজকীয়। পদ্মার ইলিশের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। বর্তমানে শিশু ইলিশ (জাটকা) নিধন দমন করা হয়েছে। সাধারণের পাতে ইলিশের টুকরো পড়ছে। একটা সময় বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বেড়ে গেলে স্রোতের অনুকূলে চাঁই বা দাড়কি বসিয়ে ছোট মাছ ধরা হতো। কখনও নৌকায় লতা পাতাসহ গাছের ডাল ভরে রাতভর ডুবিয়ে রেখে পরদিন তুলে নানা জাতের মাছ মিলত। তউরা জাল ও খেয়াজালে তো মাছ ধরা হতো। পানি কমে গেলে দল বেঁধে পলো দিয়ে মাছ ধরার আনন্দ আলাদা। ছোট মাছের চর্চরির স্বাদই মজার।
×