বিশেষ প্রতিনিধি ॥ পবিত্র কোরবানির ঈদ সামনে রেখে অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশেষ অভিযানের জালে আটকা পড়েছে অজ্ঞান ও মলম পার্টির সাত সদস্য। গ্রেফতারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ নানান তথ্য। যেভাবে এই ধরনের অপরাধী চক্রের সদস্যরা তাদের জবানবন্দীতে মানুষকে বোকা বানিয়ে কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ বা দ্রব্যে অজ্ঞান করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে জবানবন্দীতে।
পুলিশ ও র্যাব সূত্র জানায়, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে রাজধানীতে ইতোমধ্যেই এই তৎপরতা শুরু করেছে। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে এই অপরাধী চক্রের তৎপরতা বেড়ে গেছে। ওদের জালে আটকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নেমেছে অভিযানে।
সোমবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গোল চত্বর এলাকায় অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ অজ্ঞান ও মলম পার্টির ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১। এরা হলো মোশারফ হোসেন মাহিন, আমিনুল, চাঁদ হাওলাদার, রবিন মিয়া, বাবু, রফিক ও সচিত দাস। তাদের কাছ থেকে তিনটি মলম, পাঁচটি স্পেয়ার ব্লেড, তিনটি মোবাইল ফোন ও ৭৫০ টাকা জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, তারা সংঘবদ্ধ অজ্ঞান ও মলম পার্টি চক্রের সক্রিয় সদস্য। এই চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে বিমানবন্দর এলাকায় চলাচলকারী লোকজন ও পথচারীদের টার্গেট করে। এরপর কৌশলে বোকা বানিয়ে তাদের চোখে চেতনানাশক মলম লাগিয়ে অজ্ঞান করে তাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোনসহ নগদ টাকা এবং মূল্যবান অন্যান্য জিনিসপত্র হাতিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় কেউ টের পেলে ও বাধা দিলে তাকে ভয় দেখাতে তাদের কাছে থাকা স্পেয়ার বেল্ড দিয়ে শারীরিক আঘাত করা হয়।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক সারওয়ার বিন কাশেম বলেছেন, সোমবার দিন সন্ধ্যায় অজ্ঞান ও মলম পার্টির চক্রটি বিমানবন্দরে প্রবেশ করা হজযাত্রীদের টার্গেট করে সেখানে অবস্থান করছিল। হজযাত্রীসহ অন্যান্য যাত্রী ওই এলাকার ফুটওভারব্রিজ পারাপারের সময় তাদের ব্যাগসহ অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী মলম ও অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ছিনতাই করে নিয়ে যায়। এছাড়াও আটককৃতরা শসা, বরই, আচার ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্যে চেতনানাশক রাসায়নিক তরল মিশিয়ে সাধারণ মানুষকে অজ্ঞান করে তাদের সর্বস্ব লুটে নেয়। চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগে অধিকাংশ ভিকটিম ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত জ্ঞানহীন থাকেন। তবে মাত্রাতিরিক্ত চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগে অনেক ভিকটিমের মানসিক বিকারসহ দৈহিক বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। অনেক সময় তাদের মৃত্যুও ঘটে। ডিএমপির এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক মাসে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির এসব সদস্যকে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে অজ্ঞান করার কাজে ব্যবহৃত বড়ি নকটি, নিটরাজিপাম, লেক্সোটানিল, ইপিত্রা, সেডিল, রিভোট্রিল, ডিজোপেন, ক্লোনাজিপান, নিক্স, রাবিং বামের নীল রঙের কৌটা, ওষুধ মিশ্রিত জুস, খেজুর, সাতটি চোরাই মোবাইল ফোন ও একটি প্রাইভেটকার উদ্ধার করা হয়েছে। গুলিস্তান, পল্টন, সায়েদাবাদ, রমনা, নিউমার্কেট, ফকিরাপুল, কুড়িল বিশ্বরোড, বাসস্ট্যান্ড, ওয়ারী, জয়কালী মন্দির, উত্তরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এদের গ্রেফতার করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে অজ্ঞান পার্টি ও মলম পার্টির ওই সদস্যরা বলেছে, পবিত্র কোরবানি ও রমজানের ঈদ সামনে রেখে তারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল, বাসস্ট্যান্ড, সদরঘাট ও রেলস্টেশনে আগত ব্যক্তিদের টার্গেট করে সখ্য স্থাপন করে। এরপর তাদের অপর সদস্যরা টার্গেট করা ব্যক্তি ও তাদের সদস্যকে ট্যাবলেট মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্যের আমন্ত্রণ জানায়। ওই ব্যক্তি রাজি হলে ট্যাবলেটমিশ্রিত দ্রব্য তাকে খাওয়ায় এবং নিজেদের সদস্যরা সাধারণ খাবার খায়। টার্গেটকৃত ব্যক্তি অচেতন হলে তারা তার মূল্যবান দ্রব্যাদি নিয়ে দ্রুত চলে যায়। এক্ষেত্রে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা খাদ্যদ্রব্য হিসেবে চা, কফি, জুস, ডাবের পানি, পান, ক্রিম জাতীয় বিস্কুট ইত্যাদি ব্যবহার করে। এছাড়াও তারা অভিনব কৌশল হিসেবে মানুষকে অজ্ঞান করে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন থেকে নিকটাত্মীয়-স্বজনের কাছে ফোন করে বলে সে আমাদের কাছে আটক আছে। তাকে মুক্ত করতে বিকাশ বা অন্যকোন মাধ্যমে টাকা পাঠাতে হবে। ভিকটিমকে মুক্ত করতে আত্মীয়-স্বজন টাকা পাঠালে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা জবানবন্দীতে জানায়, অজ্ঞানপার্টি একা যাতায়াতকারী যাত্রীকে টার্গেট করে। বেশভুষা দেখে যাত্রীর কাছে মূল্যবান সামগ্রী থাকতে পারে- আন্দাজ করে তাকে কৌশলে খাবার, বিড়ি-সিগারেট বা কোমল পানীয়ের সঙ্গে চেতনানাশক খাইয়ে দেয়। যাত্রী অচেতন হয়ে পড়লে যাত্রীর টাকাপয়সা ও মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে দ্রুত নেমে যায়। হঠাৎ করে ওরা বন্ধু বেশে বা ফেরিওয়ালা সেজে কিংবা অচেনা সহযাত্রীর সহযোগী হয়ে অজ্ঞানপার্টি ও মলমপার্টির সদস্যরা আবির্ভূত হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক অস্থায়ী বা ভ্রাম্যমাণ দোকানের উন্মুক্ত খাবার, ডাবের পানি, জুস, চা, কফি, পান, খেজুর, ঝালমুড়ি, শক্তিবর্ধক হালুয়া, ক্রিম জাতীয় বিস্কুট, চকোলেটসহ নানা ধরনের পানীয়। এসব পানীয়তে অজ্ঞান করার বিভিন্ন দ্রব্য মেশানো থাকে। এর মধ্যে এটিভ্যান নামক ট্যাবলেটের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। অজ্ঞান করার ওষুধ মিশ্রিত খাবার বা পানীয় গ্রহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেবনকারী ব্যক্তি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা ওই ব্যক্তির দামী মালপত্র টাকাপয়সা নিয়ে সটকে পড়ে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, অজ্ঞান ও মলম পার্টির তৎপরতারোধে বিশেষ অভিযান রয়েছে। অজ্ঞান করার ওষুধ সরবরাহকারী ফার্মেসিসহ অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও অভিযান অব্যাহত আছে। এছাড়া রাজধানীর বাস, রেল ও লঞ্চ টার্মিনালসহ জনসমাগম বেশি থাকে এমন জায়গাগুলোয় জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অজ্ঞান ও মলম পার্টির সদস্যদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষী না থাকায় তারা আদালত থেকে সহজেই জামিনে বের হয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছে তারা। কারাগার থেকে বের হয়ে ওরা পুনরায় একই কাজ শুরু করে। তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অজ্ঞানপার্টির সদস্যদের গ্রেফতার করলেও পুলিশকেই বাদী হয়ে মামলা করতে হয়। সেক্ষেত্রে মামলার ধারাগুলো দুর্বল হয়ে যায়। যদি ভুক্তভোগীদের কেউ বাদী হয়ে মামলা করতেন তবে এটি শক্ত হতো। কিন্তু ভুক্তভোগীরা এগিয়ে না আসায় পুলিশের দায়ের করা মামলার দুর্বল ধারাগুলোর ফাঁক গলিয়ে ওরা সহজেই কারাগারে থেকে বের হয়ে আসছে।