ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ১৯ জুলাই ২০১৯

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

(শেষাংশ) হযরত নুহ আলায়হিস্ সালামের সময় ঘটে যাওয়া মহাপ্লাবনে এই গৃহ ধসে পড়ে এবং দীর্ঘকাল এই স্থান বিরান অবস্থায় থাকে। হযরত আদম (আ.) এর বংশধররা পৃথিবীর নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। বহু বছর পর নিঃসন্তান হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজিরার গর্ভে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে যাঁর নাম রাখা হয় ইসমাঈল। আল্লাহর হুকুমে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ৮৬ বছর বয়সে আল্লাহর রহমতে প্রাপ্ত শিশু পুত্র ইসমাঈলকে ও স্ত্রী হাজিরাকে কয়েকদিনের খাবার ও পানি দিয়ে মক্কার এই বিরান স্থানে রেখে আসেন ফিলিস্তিনের কানআন থেকে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে। তিনি দোয়া করেছিলেন : হে আমার রব্! এই নগরীকে (মক্কা) নিরাপদ রেখ এবং আমাকে ও আমার বংশগণকে প্রতিমা পূজা থেকে দূরে রেখ। (সুরা ইব্রাহীম : আয়াত ৩৫)। কয়েক দিনের মধ্যে খাবার-দাবার ও পানি ফুরিয়ে গেলে পানির জন্য সমতলভূমিতে শিশু ইসমাঈলকে রেখে মা হাজিরা পাগলিনীর মতো সাফা-মারওয়া পাহাড়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন আর সন্তানের দিকে তাকাতে থাকেন, হঠাৎ দেখতে পান শিশু ইসমাঈলের পায়ের কাছে ঝিরর্ঝির করে পানি বের হচ্ছে তিনি ছুটে এসে সেই পানির উৎসের চারদিক পাথর দিয়ে বেঁধে দিলেন। আস্তে আস্তে সেখানে একটি কূপের সৃষ্টি হলো যার নাম যমযম্-অফুরন্ত পানি। বেশ কয়েক বছর পর হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্বপ্নে একদিন তাঁর পার্থিব সবচেয়ে প্রিয় বস্তুকে কোরবানি করার জন্য আদিষ্ট হয়ে প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পুত্রকে তিনি স্বপ্নের কথা বললে পুত্র ইসমাঈল বললেন : আব্বা, আপনি আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করুন, আমাকে ইনশাআল্লাহ্ আপনি ধৈর্যশীল পাবেন। পুত্রকে তিনি সঙ্গে নিয়ে মক্কার অদূরে মিনা স্থানে পৌঁছলেই শয়তান তিনটি স্থানে তাঁদেরকে আল্লাহর এই হুকুম পালন করা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার জন্য প্ররোচিত করলে তাঁরা পাথর তুলে শয়তানকে মারলেন এই বলে : দূর হ শয়তান, আল্লাহর সন্তুষ্টিই আমাদের কাম্য। তারপর মিনার একটি স্থানে পুত্র ইসমাঈলকে কাত করে শুইয়ে দিয়ে তাঁর গলায় ছুরি চালালে আল্লাহর তরফ থেকে তা করতে নিষেধ করা হলো এবং এটা যে পরীক্ষা ছিল ইব্রাহীমের জন্য তা ঘোষিত হলো। পুত্রের বদলে একটি দুম্বা কোরবানি দেয়ার নির্দেশ এলো। হযরত ইব্রাহীম (আ.) তাই করলেন। সেই কোরবানি দেয়ার রীতি এখনও চালু আছে। লক্ষ্য করা যায় হজের বিধানগুলো পালিত হয় নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট নিয়মে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে নির্দেশ দেন তাঁর গৃহ বা কা’বা ঘর পুনর্নির্মাণের জন্য। কিন্তু সেই গৃহের ভিত্তি যে যমযমের অতি নিকটে তা তাঁর জানা ছিল না। ফেরেশ্তা জিব্রাঈল এসে তা দেখিয়ে দেন এবং এক খন্ড মেঘ তার ওপর ছায়াপাত করে। হযরত ইব্রাহীম সেই স্থান খুঁড়ে ভিত পেয়ে যান, সেই ভিতের ওপর তিনি তাঁর পুত্র ইসমাঈলের সহযোগিতায় কা’বা শরীফের দেয়াল তোলেন। যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি এই দেয়াল তোলেন সেই পাথরে তাঁর পায়ের চিহ্ন গভীর হয়ে পড়ে যায়। সেই পায়ের চিহ্নের পাথরখানি আজও কা’বা শরীফের পাশে রক্ষিত আছে, যাকে মাকামে ইব্রাহীম বলা হয়। কা’বা ঘর পুনরায় নির্মিত হয়ে গেলে আল্লাহ্ হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামকে এখানে এসে হজ করার ঘোষণা করতে নির্দেশ দেন। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হযরত ইব্রাহীম (আ.) হজের ঘোষণা দেন আবু কুবায়স পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে। তারপর থেকে জিলহজের নির্দিষ্ট তারিখগুলোতে হজ পালিত হতে থাকে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ইব্রাহীম ও ইসমাঈল বায়তুল্লাহর দেয়াল তুলবার সময় বলেছিল : হে আমাদের রব! আমাদের এই কাজ কবুল কর নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা। (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৭)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি যখন কা’বা ঘরকে মানব জাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম তখন বলেছিলাম : তোমরা মাকামে ইব্রাহীমকে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর এবং ইব্রাহীম ও ইসমাঈলকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজ্দাকারীদের জন্য আমার গৃহকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৫)। হজের ঘোষণা দেয়ার হুকুম প্রসঙ্গ এনে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দিয়ে দাও, ওরা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটের পিঠে, ওরা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে। (সুরা হজ : আয়াত ২৭)। কালক্রমে এই হজ আইয়ামে জাহিলিয়াতের খপ্পরে পড়ে শিরক ও কুফরের অন্ধকারে ছেয়ে যায়। লাব্বায়েক আলাহুম্মা লাব্বায়েক উচ্চারণ থাকলেও তার সঙ্গে বিভিন্ন গোত্রের ও জাতির দেব-দেবীর নাম সংযুক্ত হয়ে যায় এবং মক্কার বাইরে থেকে যারা হজ করতে আসত তারা ইহরাম বাঁধা বলতে উলঙ্গ হওয়া বুঝত এবং তাই করত। মক্কার কুরাইশরা আভিজাত্যের কারণে আরাফাত ময়দানে আমজনতার সঙ্গে ৯ জিলহজ মিলিত হতো না, তারা মুয্দালিফায় এসে জড়ো হতো। আরাফাত ময়দানে হযরত ইব্রাহীম কর্তৃক নির্মিত একটি মসজিদ ছিল তাও যত্নের অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর নিকট হজ বিধান নাজিল হলে তিনি ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে এক লাখ চল্লিশ হাজার সাহাবীসহ হজ পালন করেন। তিনি ৯ জিলহজ আরাফাতে পৌঁছে হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালামের মসজিদ যেখানটিতে ছিল ঠিক সেইখানটিতে কালো কম্বল দিয়ে একটি তাঁবু স্থাপন করেন এবং সেখান থেকে উটের পিঠে আরোহণ করে বিদায় হজের খুতবা দিতে দিতে আরাফাত পাহাড়ের চূড়ায় উঠে শেষ করেন। আরাফাত পর্বতের নামকরণ করা হয় জবলে রহমত। আজকের মসজিদে নামিরাই হচ্ছে সেই স্থান, সেখানে ইব্রাহীম মসজিদ ছিল। প্রিয় নবী (সা.) সেই হজ যেভাবে পালন করেছিলেন এখনও হজ সেই নিয়মে পালিত হয় এবং হতে থাকবে। কুরাইশরা যে আভিজাত্যের অন্ধ অহমিকায় আমজনতার সঙ্গে আরাফাতে ৯ জিলহজ না গিয়ে মুয্দালিফা অবস্থান করত তা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : তোমরা যখন আরাফাত হতে প্রত্যাবর্তন করবে তখন মাশ্’আরুল হারাম (মুয্দালিফার পাহাড়)-এর নিকট পৌঁছে আল্লাহর যিকর করবে এবং তিনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাঁর যিকর করবে। যদিও ইতোপূর্বে তোমরা বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৮)। হজ বিশ্ব মানবতার ঐক্য ও সংহতির এক অপূর্ব নিদর্শন। আল্লাহর মেহমান হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক অনন্য ব্যবস্থা হজ। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফ
×