ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ওয়ান ইলেভেন এবং কারাবন্দী শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ১৯ জুলাই ২০১৯

 ওয়ান ইলেভেন এবং কারাবন্দী শেখ হাসিনা

তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বাঙালী জাতির গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে নিরবচ্ছিন্নভাবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে নেতৃত্বহীন করা হয়েছিল। শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র সেনা শাসনে বন্দী ছিল বছরের পর বছর। দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আজ নন্দিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬-২০০১ সালেও শেখ হাসিনা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এক মেয়াদ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। দলের দায়িত্ব গ্রহণ, নেতৃত্বদান এবং ক্ষমতায় আরোহণের বন্ধুর পথ অতিক্রম করেছেন তিনি সফলতার সঙ্গে। জনমানুষের অধিকারের পক্ষে কথা বলার ‘অপরাধে’ তাঁকে বিভিন্ন সময় গৃহে অন্তরীণসহ গ্রেফতার বরণ করতে হয়। শুধু তাই নয়, ১৯৮১ সালের পর অন্তত ২১ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা এবং প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ ও সাংবিধানিক ধারা পুন:প্রবর্তনের দাবিতে কথা বলায় সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। ঐ বছর ১ মার্চ শেখ হাসিনাসহ গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দেয়া হয়। একই বছরের ২৭ নবেম্বর সংসদ নির্বাচনের দাবিতে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে সামরিক জান্তা শেখ হাসিনাকে তাঁর মহাখালীর বাসায় অন্তরীণ করে রাখে। ১৪ ডিসেম্বর গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান তিনি। ১৯৮৭ সালের ১১ নবেম্বর গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দী হন শেখ হাসিনা। ১০ ডিসেম্বর এই অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি পান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও পাকিস্তানী শাসকদের হাতে তিনি সপরিবারে বন্দী ছিলেন। শেখ হাসিনাকে দীর্ঘতম কারাজীবন ভোগ করতে হয় ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। গ্রেফতারের আগে শেখ হাসিনার নামে একাধিক মামলা দেয়া হয়। গ্রেফতারের পর তাঁকে পুলিশের একটি জীপে করে ঢাকার সিএমএম আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন ভীতসন্ত্রস্ত পরিস্থিতির মুখেও দলের নিবেদিত কর্মীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। আদালত প্রাঙ্গণে প্রিয় নেত্রীকে একনজর দেখতে সমবেত হন হাজারো কর্মী-সমর্থক। এটাই স্বাভাবিক। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে সেদিন আমিও অন্যদের মাতো প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে ছিলাম। সেদিন আদালতে শেখ হাসিনার জামিনের আবেদন না মঞ্জুর হয় এবং তাঁকে জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে বিশেষ কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত এলাকায় তাকে যথাযথ নিরাপত্তা না দেয়ায় তিনি নাজেহালের শিকার হন। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার হয়ে ৩৩১ দিন শেরে বাংলা নগর সাবজেলে বন্দী থাকেন। বন্দীদশার প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত জাতির পিতার কন্যার জন্য ছিল বিভীষিকাময়। অরাজনীতিকায়নের অশুভ প্রক্রিয়ার সংগঠকদের কর্মকান্ডে দেশের মানুষ ছিল আতঙ্কিত। কিন্তু জনগণের সম্মিলিত শক্তির কাছে কোন অপতৎপরতাই টিকে থাকেনি। ‘এই সত্য ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিলেন। প্রবল জনমত ও আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের সমর্থনের কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালের ১১ জুন শেখ হাসিনাকে জামিনে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ওই সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়েরকৃত কয়েকটি মামলায় বিশেষ জজ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীকালে ওই সব মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে শেখ হাসিনা হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়। বঙ্গবন্ধু কন্যার মুক্তির দাবিতে দেশে-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হলে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তাঁকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দাবি জানান। উন্নত চিকিৎসার স্বার্থে কারাবন্দি শেখ হাসিনাকে ২০০৮ সালের ১১ জুন আট সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। সেখানে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত কান ও চোখের চিকিৎসা নেন তিনি। দেশে ফেরার পর আবার তাঁকে কারাগারে রাখা হয়। আটকের এক বছরেরও বেশি সময় পর স্থায়ীভাবে মুক্তি পান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। এরপর থেকে আমরা এই দিনটিকে গণতন্ত্র অবরুদ্ধ দিবস হিসেবে পালন করে আসছি। এখানে উল্লেখ্য, ২০০১ সালে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত ৪ দলীয় জোট সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের পর পরই ক্ষমতার দাপটে স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে দেশ শাসন করতে থাকে তারা। সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, হামলা-মামলা এমন কোন হেন কর্ম নেই ৪ দলীয় জোট সরকার করেনি। বিএনপি-ছাত্রদল-যুবদল-জামায়াত-ছাত্রশিবির মিলে দেশে এক অরাজকতার সৃষ্টি করে। ফলে দেশে নানা রকম বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা, জনসন্তোষ বিস্ফোরণোন্মুুখ হয়ে দেখা দেয়। পাশাপাশি সরকারের প্যারালালভাবে হাওয়া ভবনের উত্থান ঘটে। হাওয়া ভবন এমনই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে- যেন এই ভবনই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। হাওয়া ভবনের নেতা তারেক জিয়াকে দেশের যুবরাজ বলতে শুরু করে। চাঁদাবাজ, ধান্দাবাজ, লুটপাটকারী, টাকা পাচারকারী, অবৈধ ব্যবসা, টেন্ডারবাজি- সব ধরনের দুর্বৃত্তপরায়ণমূলক কাজের এক সুদূরপ্রসারী আড্ডাখানায় পরিণত হয় এই ভবন। ফলে দেশে এক চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তারা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাও চালায়। তাদের ক্ষমতার দাপটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়, ক্ষমতা পাকা করতে ২২ জানুয়ারির সাজানো নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। তারেকের ছকে নির্বাচন বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগ নেন রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ড. ইয়াজ উদ্দিন। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগসহ সকল বিরোধীদল আন্দোলন ও সংগ্রামের রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ অচল করে দেয়। এক পর্যায়ে আসে ওয়ান ইলেভেন। ওয়ান ইলেভেনের আগে টানা প্রায় দুই মাস যে দুর্বার আন্দোলন হয় তখন আমার নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে দলের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করেছি। সে সময় ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিনই মঞ্চ তৈরি করে সমাবেশ-মিছিল করেছি। বিএনপি জোট সরকারের শাসনামল এক নাজুক অবস্থায় পড়ে। এমন চরম বিস্ফোরণোন্মুুখ অবস্থায় আসে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদিও ৩ মাসের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিন্তু তারা ক্ষমতার মোহে পড়ে যায়। প্রতিবাদ করেন আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিবাদ-আন্দোলনের ডাক দেন তিনি। এতে সরকারের কোপানলে পড়েন শেখ হাসিনা। সে কারণে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার আগে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছিল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। আসলে দীর্ঘদিন ধরেই একটি মহল শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার পরিকল্পনা করে। বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলে ২১ আগস্টসহ কয়েকবার তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায় সরকারও সে পথে হাঁটে। তারা প্রথমেই শেখ হাসিনার চলাচল নিয়ন্ত্রিত করা ও তাঁর সঙ্গে সুধাসদনে দেখা করতে আসা নেতা-কর্মীদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে চিকিৎসা শেষে তিনি দেশে ফিরতে চাইলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তিনি যখন দেশে ফিরে আসেন এবং লাখো জনতা ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে যখন প্রিয় নেত্রীকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানায়, তখনই সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুঝতে পারে তাকে বাইরে রাখা ঠিক হবে না। গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। নেত্রীকে গ্রেফতারের পর ঢাকায় জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং কিশোরগঞ্জে নেতাকর্মীদের সঙ্গে দলের হয়ে কাজ করি। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ করি এবং সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে জেল থেকে বের করার সকল প্রকার কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করি। যেভাবেই হোক শেষ পর্যন্ত আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনাকে জেল থেকে বের করে আনতে সক্ষম হই এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অতঃপর টানা তৃতীয়বার নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদান রেখে এবং আওয়ামী লীগের আপদে-বিপদে নির্যাতনে নিপীড়নে একাট্টা হয়েও দল আওয়ামী লীগ এবং সরকার আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যথাযথ মর্যাদা অনেকের ভাগ্যে জোটেনি। হয়তো আমার মতো বহু নেতা-কর্মী তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা হতে বঞ্চিত। এতে অনেকেই হয়তো নিরাশ হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা করছি। এই বিষয়টি এখনই ভাবা দরকার। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আওয়ামী লীগের সত্যিকারার্থে যারা নিবেদিত নেতা-কর্মী তারা এখনও দলের বিপদে দলের পাশে এসে দাঁড়ায়। এমনকি নিজের সহায় সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে দলের সঙ্গে একান্তভাবে জড়িয়ে থাকতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। তারা দলের মানসম্মান ক্ষুণœ হলে দারুণভাবে আহত হয় এবং দুঃখে বিচলিত হয়। তাই দলের হাই কমান্ডকে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক পরিচালক বিআরটিএ
×