ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছয় দফা একটি ‘টাইম বোমা’ ॥ ১৯ জুলাই, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৪০, ১৯ জুলাই ২০১৯

 ছয় দফা একটি ‘টাইম বোমা’ ॥ ১৯ জুলাই, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই দিনটি ছিল সোমবার। এদিন কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা দল বাবুরহাটে পাকহানাদারদের একটি গাড়ির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এই আক্রমণে ৫জন পাকসেনা নিহত ও ৭জন আহত হয়। সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের নির্দেশে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ, হাবিলদার মতিন ও শাহাবউদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা দল রাজাকারসহ হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্যের মান্দারীবাজার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে ২জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিস্তানীদের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি একজন মেজরের কমান্ডে করুইয়াবাজার অবস্থানে ভারতে গমনরত প্রায় দু’শ’ শরণার্থীকে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা দল পাক হানাদারদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এই সময় ক্যাপ্টেন মাহফুজ শরণার্থীদের পালিয়ে আসতে বললে প্রায় দেড়শ’ শরণার্থী নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসে ও কিছু শরণার্থী গোলাগুলিতে নিহত হয়। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩০ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী কোন ক্ষতি স্বীকার না করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ভালুকা থানার বাজারঘাঁটি আক্রমণ করে। এ আক্রমণে হানাদারদের ঘাঁটি বিধ্বস্ত হয় এবং ২২জন পাকসেনা নিহত ও ১১ জন আহত হয়। ঢাকা শহরের তিনটি বিদ্যুত সরবরাহ কেন্দ্রের ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ফলে রাতে শহরের একাংশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। মার্কিন সংবাদ সংস্থা এপির খবরে বলা হয়েছে, রাতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা চামেলিবাগ ও শাহবাগ বিদ্যুত সরবরাহ কেন্দ্রে আক্রমণ করে কেন্দ্র দুটিকে বিকল করে দেন। মুক্তিফৌজ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর হতে পাকসেনাদের উৎখাত করে মেহেরপুর দখল করে এবং পাকসেনাদের ঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়েছে। ভারত সরকারের তথ্যানুযায়ী ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ লাখ ২১ হাজার ৪শ’ ৯০জন। কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা রাওয়ালপিন্ডিতে বলেন, জাতীয় জীবনের এ সঙ্কটকালে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি দেশদ্রোহিতামূলক। পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইউম খান বলেন, দেশের রাজনৈতিক দল হিসেবে শুধু পাকিস্তান মুসলিম লীগই প্রথম থেকে ৬ দফার বিরোধিতা করে এসেছে, ৬ দফাকে একটি ‘টাইম বোমা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এ.এন.এম. ইউসুফ নারায়ণগঞ্জে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের কর্মতৎপরতা দেখতে যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোস্তফা শওকত ইমরান। নিউজ উইক ’বাঙালীরা রুখে দাঁড়িয়েছে’ শিরোনামে এক নিবন্ধ প্রকাশ করে। দ্য স্টেটস ম্যানের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে পাকসেনারা সম্ভাব্য গেরিলা আক্রমণ থেকে রাজধানী ঢাকা, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ও চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এসব সূত্র মোতাবেক, সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেনা পূর্বাঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে এবং শুধু চট্টগ্রাম- সিলেট সেক্টরে এ সংখ্যা ৭০ হাজারের মতো। পশ্চিমাঞ্চলে নিয়োজিত সেনাশক্তি এর চাইতে কম বলে মনে করা হয়। পাকবাহিনীর, ঢাকা ময়নামতি ও চট্টগ্রামের সরবরাহ লাইন সচল রাখার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিন মাস চেষ্টার পরেও তারা প্রত্যন্ত অঞ্চল ও সীমান্ত এলাকার সেনাবাহিনীর জন্য জরুরী ও কৌশলগত কেন্দ্রগুলোর মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি। গত মাসে মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৯০টি সফল গেরিলা ও কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করে। যাতে বহু পাকসেনা হতাহত হয়। বিশ্বাসযোগ্য হিসাব মতে এসব অপারেশনে ১৭০০ জন পাকসেনা নিহত বা গুরুতর আহত হয় যেখানে মুক্তিবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল অনেক কম। ঢাকায় গেরিলা বাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রায়ই খ-যুদ্ধ হচ্ছে। এ সময় আতঙ্কিত ও বাহ্যত নীরব শহর উত্তাল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। ২৮ জুন ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর পরই ঢাকা শহরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই ধারাবাহিকভাবে গেরিলা আক্রমণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ৩ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ‘পাক বে কোম্পানি’ গেরিলা আক্রমণে ধ্বংস হয়। এখান থেকে অনেক দূরে বসবাসকারী মানুষেরা সারা রাত এখানকার জ্বলন্ত আগুন দেখতে পেয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এখন কৌশলগত সেনা অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ শহর, শিল্পাঞ্চল ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে করা হয়। ইতোমধ্যে পূর্বাঞ্চলে পাকসেনাদের কৌশলগত পরিবর্তন বেশ লক্ষণীয়। পাকসেনারা এখন তাদের গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি এবং স্থল ও জলপথের যোগাযোগ রক্ষায় বেশি তৎপর। এর ফলে সিলেট ও চট্টগ্রামের মধ্যে কয়েকশ’ মাইল সীমান্ত এলাকা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় নিয়োজিত ছোট ছোট ঘাঁটিতে অবস্থানরত সেনাদের প্রত্যাহার করে সুরক্ষিত ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী যেসব এলাকা থেকে পাকসেনা সরিয়ে নেয়া হয়েছে তার কিছু এলাকায় রাজাকার নামের এক নতুন বেসামরিক বাহিনী নিয়োগ করা হয়। পূর্বাঞ্চলের মুক্তিসেনারা এখন পাকসেনাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়া উন্নতমানের চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। সুসজ্জিত পাকসেনারা যারা একমাস আগেও গ্রামাঞ্চলে আক্রমণ চালিয়ে ভীতির সঞ্চার করত এখন তারা গেরিলা আক্রমণ ও তাদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির ভয়ে আতঙ্কিত। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া এক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭ জন পাকসেনা কুমিল্লার নবীনগর গ্রামের এক মুসলিম লীগ নেতাকে গেরিলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষার জন্য এক মাস আগে নিয়োজিত ছিল। গভীর রাতে গেরিলারা এখানে আসে এবং তাদের সবাইকে বাইরে আসতে বলে; এর পর বিনা বাধায় তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। আমি যখন এখান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দেবীপুর সীমান্ত এলাকায় ছিলাম তখন আমাকে আরেকটি কাহিনী বলা হয়। গত শনিবার বিকেল ৩ টায় গেরিলা বাহিনী কুমিল্লা সীমান্তবর্তী সালদা নদীতে একটি সেনা স্পিড বোটে অকস্মাত হামলা চালায় যেখানে দু’জন মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন ও ৪ জন সেনাসহ মোট ৮ জন নিহত হয়। এরা সবাই সালদা নদীর ঘাঁটি পরিদর্শনে এসেছিল। এলাকা ত্যাগ করার জন্য তাড়াহুড়ায় ছিল ও অকস্মাৎ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। অভিযানের সময় গেরিলারা কিছু চাইনিজ আগ্নেয়াস্ত্র, ওয়ারলেস সেট ও স্পিড বোট দখল করে। একই সঙ্গে আরেকটি স্পিড বোট ধ্বংস হয়ে যায়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×