ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অদ্ভুত আঁধার এক...

প্রকাশিত: ১১:৪০, ১৯ জুলাই ২০১৯

অদ্ভুত আঁধার এক...

চালর্স ডিকেন্সের গ্রেট এক্সপেক্টেশনস উপন্যাসে পিপ নামের বালকটি বলেছিলো -‘বাচ্চাদের ছোট দুনিয়াতে যেটা সবচেয়ে ভালোভাবে টের পাওয়া যায় সেটা হলো অন্যায়’ পিপের সেই কথা যেন ভয়ংকরভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে বাংলাদেশে। পিপ শুধু শিশুদের পৃথিবীর কথা বলেছিল কিন্তু আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি অন্যায় আর নির্মমতায় ভরা ভয়ঙ্কর এক পৃথিবী, যে পৃথিবী নিরাপত্তহীন নির্মম আর অন্যায়ে পরিপূর্ণ। আমরা দেখছি প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়, নির্বাক দর্শক হয়ে তা দেখে মানুষ। নারী ধর্ষিত হয় চলন্ত বাসে, ধর্ষণের পর পুড়িয়ে ফেলা হয়, শিক্ষকরা ছাত্রীদের ধর্ষণ করে, শিশুদের ধর্ষণ করে ছুড়ে ফেলা হয় রাস্তায়, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করা হলে তাকে হত্যা করা হয়। আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাকে একপ্রকার পাগল ভাবা হয় তার ওপর নেমে আসে নানা হয়রানি। আমাদের স্বপ্নের এই দেশটা কেন এমন হয়ে গেল? বিশেষজ্ঞদের মতামত সামাজিক এই অবক্ষয়, মানুষের বোধহীনতা আর সমাজে বেড়ে যাওয়া নারী ও শিশু ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন ও নিপীড়ন নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞদের কিছু মতামত নিম্নরূপ : জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ডা. হেদায়েতুল ইসলামের মতে, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার থেকেই মানুষ ধর্ষণের মতো এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ করে। সমাজে তারা সঠিকভাবে কারও সঙ্গে মিশতে না পারায় একাকিত্বে ভোগে। সুস্থভাবে নিজের মনের বহিঃপ্রকাশ করতে না পেরে তারা বিচ্ছিন্নভাবে থাকে। ফলে এ ধরনের কিছু মানুষ দুর্বলের ওপর আঘাত করে। আসলে তারা অসুস্থ। তাদের যৌনপ্রবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও অসামাজিক হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। প্রায় এসব ঘটছে। আর যারা করছে তারা আমি বলব অপ্রকৃতিগ্রস্ত সুস্থ নয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু জিপিএ দিয়ে না মেপে শিক্ষার আরও উন্নয়ন করেও এসব দূর করতে ভূমিকা রাখবে। কেননা, ছোট বেলা থেকেই শিশুদের পরিপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে গড়তে হবে। মনোবিদ অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যেমন অনেক দিক থেকে উন্নতি-উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছি, তেমনি সামগ্রিকভাবে একটি মানসিক-সামাজিক অধঃপতন ও অবক্ষয়ের মধ্য দিয়েও যাচ্ছি। পরিবার-শিক্ষা-রাজনীতি-আদর্শ সব জায়গাতেই এর কালো ছায়া আছে। সবাই যখন অর্থবিত্তের দিকে ঝুঁকে পড়ে তখন এর আড়াল দিয়ে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় বড় হয়ে ওঠে। সে অবক্ষয় এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে অসুস্থ যৌনতা ও মানসিক বিকারগ্রস্ততাও জাগ্রত করে। নারীর প্রতি সম্মানের জায়গাকে তারা মোটেই মূল্যবোধ দিয়ে দেখতে পারে না; যার অন্যতম বলি হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সালাহউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, ‘অপ্রিয় হলেও সত্যি যে আমাদের দেশে অবাধে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করার সক্ষমতা হয়নি। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাবও বড়ভাবেই পড়ছে। আবার অনেকে যৌনশিক্ষার বিষয়কে উৎসাহিত করলেও এর নেতিবাচক দিক নিয়েও ভাবনার অবকাশ রয়েছে। চীন-থাইল্যান্ডের মতো উন্মুক্ত সংস্কৃতির দেশই এখন রক্ষণশীলতার পথ খুঁজতে শুরু করেছে নতুন প্রজন্মকে রক্ষার জন্য। ফলে আগে থেকেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়া মানুষের কাছে অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির সহজলভ্যতা যৌন অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধে উৎসাহ জোগাতে পারে।’ সিনিয়র উপপরিচালক নিনা গোস্বামী বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণে দেখতে পেয়েছি, শিশুরা ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। একদিকে তারা শিক্ষক-আত্মীয়স্বজন বা দুর্বৃত্তের ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে মা-বাবা বা পরিবারের অন্যদের কলহের শিকার হয়ে খুন হচ্ছে। অনেক ঘটনার মামলাও হচ্ছে না আবার মামলা হলেও সঠিকভাবে বিচারকাজ এগোচ্ছে না। এমনকি বড়দের মতো শিশুরাও পরিস্থিতির মুখে পড়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। গত ছয় মাসে ৪০ শিশু আত্মহত্যা করেছে, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘটনার শিকার ১৭ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, নিখোঁজের পর উদ্ধার হয়েছে এক শিশুর লাশ।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের ধর্ষণগুলো দেখলে দেখা যায় ব্যক্তিগত লালসা, আচরণগত ও নানা কারণ। আর শিশু ধর্ষণ হয় কারণ ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচার মতো সক্ষমতা একটি শিশু রাখে না, শিশুরা ধর্ষকের চেয়ে একটু দুর্বল হয়। অনেক সময় একজন ব্যক্তি নানা ফাঁদ পেতে শিশুকে কাছে এনে ধর্ষণ করছে। আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়াটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ভয়ানক চিত্র ও সতর্কবাণী। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক ধর্ষণের কারণ সম্পর্কে বলেন, ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই এর পেছনে দায়ী মূলত কয়েকটি বিষয়। প্রথমত হলো- প্রযুক্তির অপব্যবহার। কারণ ইন্টারনেটে অতি সহজে যৌন ছবি, উত্তেজক ভিডিও পাওয়া যায়। ফলে ধর্ষণের নৈরাজ্য বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে- পুঁজিবাদের ফলে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে মানুষের মধ্যে দূরত্ব, পারস্পরিক সম্মানবোধ, সহনশীল আচরণ অনেকটাই কমে গেছে। আর একইসঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছে। আর তৃতীয়টি হলো- ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের ক্ষেত্রে এক প্রকার শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। এটা থেকে বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি তৈরি হয়। যখন কোন ধর্ষণের দ্রুত বিচার না হয়, তখন এটি আরও একটি ধর্ষণের ঘটনার জন্য দায়ী। এ সব বিষয় যদি সংশ্লিষ্টরা মাথায় রেখে কাজ করে, তবে ধর্ষণের ঘটনা অনেকাংশে কমে যেতে পারে। সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক ডা. ইশতিয়াক মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এককথায় বলতে গেলে এক ধরনের সামাজিক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পারছি আমরা। তবে আমার মনে হয়, শিশুর প্রতি সহিংসতা যতটা বাড়ছে, তার সঙ্গে ঘটনার ভিকটিম বা ভিকটিমের স্বজনদের পক্ষ থেকে বিষয়টি চেপে না রেখে প্রকাশ করার সাহস ও সচেতনতা অনেকটা বাড়ছে। ফলে ঘটনা আগের তুলনায় বেশি প্রচারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তথ্য প্রকাশ ও মানুষের প্রতিবাদের এই স্পৃহাকে ইতিবাচকভাবে দেখে অপরাধ কমানোর মতো পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবারের আরো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। স্কুল-কলেজে নারীর প্রতি পুরুষের মানসিক আচরণ, সম্মানবোধের বিষয়ে আরো বেশি সচেতনতা বাড়াতে কাজ করা প্রয়োজন। পরিবার থেকেও ছেলেদের এ শিক্ষা দেওয়ার জন্য মা-বাবাকে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। ঢাকায় জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহিরিন বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন দেশে ধর্ষণের হাত থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক তেমন কোন ব্যবস্থা নেই ধর্ষণ রোধ করে শিশুদের নিরাপদ রাখার জন্য যে ধরণের অবকাঠামো, লোকবল বা সেবা দরকার সেগুলো এখনো অনেক কম। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ করে কমিউনিটি লেভেলে যে ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন আছে সেগুলো এখনো কার্যকর নয়। কিছু সার্ভিস আছে বা লোকজন আছে। কিন্তু শিশুদের বিষয় বা এ ধরনের ঘটনাকে কেউই সেভাবে আমলে নেন না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সামাজিক কল্যাণ কার্যক্রমের পক্ষ থেকে সোশ্যাল ওয়ার্কারদের থাকার কথা, কমিউনিটি লেভেলে এবং প্রবেশের অফিসার যার একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে, অনেক জায়গায়ই তারা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।’ আইনের ভাষ্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী-২০০৩)-এর ধারা ৯-তে অনুসারে যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদ-েও দ-িত হবেন। যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী অন্য কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদন্ডে ও দন্ডিত হবেন। যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা আহত হয়, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদন্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদন্ডে ও দন্ডিত হবেন। কেউ ধর্ষণের চেষ্টা করলেও অনধিক ১০ বছরের কারাদন্ড ও পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ডের কথা রয়েছে। সামাজিক অবক্ষয় ॥ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ আমরা যদি একটু ভালো করে পরিসংখ্যানগুলো এবং আমাদের নিকট অতীতের দিকে চোখ রাখি আমরা দেখতে পাবো যে আমাদের এই অবক্ষয় ধারাবাহিক এবং ক্রমবর্ধমান এবং বর্তমানে আমাদের সামাজিক অবক্ষয় ভয়াবহ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মূল্যবোধ, মানবতাবোধ আর নৈতিকতার বোধ। বিশেষজ্ঞের মতামত থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সমাজিক অস্থিরতা, ইন্টারনেটে যৌন ছবি পর্নোগ্রাফি, সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা, উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, নারী ও শিশুদের ধর্ষণের হাত হতে রক্ষার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সুব্যবস্থা না থাকা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়া এসকল বিষয়গুলোকেই দায়ী করেছেন। এই সব বিষয়গুলোকে যদি আমরা সমন্বয় করি তাহলে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হলো আমরা পুঁজির করাল গ্রাসে বিধ্বস্ত। পুঁজির কাছে নতজানু আমাদের সমাজ। ব্যক্তিস্বার্থ আর বস্তগত উন্নতির মোহে আমরা ভাসিয়ে দিয়েছি আমাদের নৈতিকতা বোধ আর মল্যূবোধ। উপরের সিঁড়িতে পা রাখার এক মাতাল খেলায় লিপ্ত প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিযোগী। উপরের সিঁড়িতে পা রাখার এক মাতাল খেলায় লিপ্ত। এক অন্ধ আর সর্বগ্রাসী প্রতিযেগিতায় বিপন্ন আমাদের স্বস্তি আর সন্তুষ্টির জায়গাটি। প্রতিনিয়ত এই প্রতিযোগিতার মানসিকতা গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের সুকুমার বোধ আর মানবিক গুণগুলোকে। ফলে সহমর্মিতা, সহযোগিতা আর বন্ধুত্বের জায়গাটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। নির্মম আর কঠিন একটা সময়ে প্রবেশ করেছি আমরা। এখানে কারো জন্য কারো কোনো ছাড় নেই। আমাদের বোধশক্তি মরে গেছে। এই ভোতা বোধের কারণে চোখের সামনে কাউকে কুপিয়ে মারলেও আমরা নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি এবং কেউ কেউ ক্যামেরায় সেই ছবি ধারণ করি কিন্তু বাঁচানার কোনো চেষ্টা করি না। আমরা শিশুদের চরম স্বার্থপর করে গড়ে তুলছি, নিজের স্বার্থ ছাড়া তারা আর কোনো কিছুই শেখে না। অপরকে সম্মান করতে তারা শেখে না। ফলে রাস্তায় মেয়েদের দেখলে তারা নোংরা কথা ছুড়ে। তাদের আক্রমণ করতেও কোনো দ্বিধাবোধ করে না। সম্পদ, অর্থলোভ, প্রতিপত্তির মোহ আমাদের এমনভাবে গ্রাস করেছে যে খুব সামান্য কিছুর প্রত্যাশায় আমরা বিকিয়ে দিতে পারি সকল নৈতিকতাবোধ আর মূল্যবোধকে। অর্থ উর্পাজন আর নানাবিধ অর্জনের ক্ষেত্রে আমরা বেছে নিয়েছি দুর্নীতি আর অসৎপন্থা ফলে আমাদের আগামী প্রজন্ম আমাদের সম্মান করতে তো শিখছেই না বরং তারা গুরুজনদের দেখছে খলনায়কের দৃষ্টিতে। তাদের কোনো অপকর্মের ক্ষেত্রে আমরা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না কারণ আমাদের নিজেদেরই নৈতিকতার জোর নেই। আরো আরো বেশি কিছু প্রাপ্তি আর অর্জনের আশায় আমরা খুব অস্থির। এই অস্থিরতার জন্য আর স্বার্থান্ধতার জন্য ভেঙ্গে গেছে আমাদের সমাজিক বন্ধনগুলো। আমাদের ভেতর থেকে প্রেম, মায়া, মমতা উধাও হয়ে যাচ্ছে। আমরা হয়ে যাচ্ছি রোবট। সম্মান শ্রদ্ধা আর স্নেহের মতো সুন্দর বিষয়গুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের কাছ থেকে। ফলে যে কোনো মানুষের সাথে যে কোনো আচরণে আমাদের কোনো দ্বিধা জাগছে না। আমাদের মূল্যবোধ নৈতিকতা আর সুকুমার বৃত্তিগুলো হারিয়ে ফেলায় সামনের অপবিষয়গুলোই আমরা গ্রহণ করছি। ইন্টারনেটে আমাদের সন্তানেরা দেখছে নানা পর্নোগ্রাফি আর যৌন উত্তেজনাকর ছবি। ছোট শিশু থেকে শুরু করে প্রত্যেকের হাতে স্মার্টফোন। প্রত্যেকের কাছেই এখন উন্মুক্ত এই ফ্রি-সেক্সের বিষয়গুলো। যথার্থ সেক্সশিক্ষাহীন আমাদের সন্তানদের সামনে এই উন্মুক্ত এই সেক্সের জগত তাদেরকে বিপথগামী করছে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধস নেমেছে। শিক্ষকরা হারিয়ে ফেলেছে তাদের নৈতিকতা। বাণিজ্যমুখী এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকরা নানাভাবে সুবিধা নিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। আর শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনা না করেই শিক্ষকের অনুগ্রহ নিয়ে ভালো ফলাফলের আশায় শিক্ষকদের অনৈতিক বিষয়গুলোকে মেনে নিচ্ছে। এরকম অনৈতিক ও মূল্যবোধহীন পরিবেশের কারণে শিক্ষকদের লালসার শিকার হচ্ছে ছাত্রীরা। নানাভাবে তাদের যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে একটা অত্যন্ত নোংরা আর রুচিহীন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষাঙ্গনে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর নানা অগ্রগতি হলেও এবং নারী ক্ষমতায়ন, নারী অগ্রগতি এ বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও কার্যক্রম দেখা গেলেও সমাজে নারীকে সম্মানহীন ও মূল্যহীন। নারীকে এখনো নানাভাবেই অবমাননা করা হচ্ছে। নারীর প্রতি এই অবমাননা আর অসম্মানজনক দৃষ্টির কারণেই নারী ও শিশুকে যত্রতত্র ধর্ষণ করা হচ্ছে। শিশুরা বেশি ধর্ষিত হচ্ছে কারণ তারা দুর্বল এবং তাদের প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতা নেই। নারীকে পণ্য ভাবা হচ্ছে। নারী সৌন্দর্যের বাজার সৃষ্টি করে অত্যন্ত সস্তা ও নিচুভাবে বিজ্ঞাপনে ও মিডিয়ায় ব্যবহার করা হচ্ছে নারীকে। সিনেমায় নারীকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। দুভাগ্যজনকভাবে নারী নিজেও সচেতন হচ্ছে না। আধুনিকতার নামে নগ্নতাকে গ্রহণ করছে নারী ও সমাজ। ফলে নারীকে মনে করা হচ্ছে ভোগের সামগ্রী। ফলে নারীকে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন এবং খুন করে ফেলাকেও কিছুই মনে করা হচ্ছে না। মিডিয়াগুলোতে নানা অপকর্ম, অপরাধগুলোকে এমনভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে যে মানুষের কাছে এগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিরোইজম বলে মনে হচ্ছ্।ে মস্তানিকে বাহাদুরি বলে মনে হচ্ছে। দূভঅগ্যের বিষয় হচ্ছে আমাদের সন্তানদের মস্তানিকে আমরা কোনো কানো ক্ষেত্রে গর্বের বলে মনে করছি, এটাকেই মনে করছি স্মার্টনেস। তাই মস্তানি আর অপকর্ম ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছিনতাই মস্তানি, ধর্ষণ করাকে এক ধরনের রোমাঞ্চ বলে মনে করা হচ্ছে। সবশেষে আইন আছে কিন্তু আইনের কোনো শাসন না থাকায় অপরাধীর কোনো শাস্তি হচ্ছে না। অনেকক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরা পড়ছে না, আর ধরা পড়লেও ছেড়ে দেয়া হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে। ক্ষমতাবানদের অনুকূল্যে থাকছে অপরাধীরা। আর ভিকটিমদেরই হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে। তাই প্রকাশ্যে অপরাধ করতেও কোনো দ্বিধা করছে না অপরাধীরা। সত্যকে আড়াল করা হচ্ছে রাজনীতির স্বার্থে। নিরপরাধীকে দেয়া হচ্ছে শাস্তি এইসব অব্যবস্খাপনা আর অন্যায়ই সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে চরম অবক্ষয়ের দিকে। অন্ধকারের সিঁড়ি বেয়ে শিশু ধর্ষণ ও হত্যা, নারী ধর্ষণ ও হত্যা, নানারকম যৌন নিপীড়ন ও নারী নির্যাতন, নানা অপকর্মের পরিসংখ্যান আমাদের দেখাচ্ছে কতটা অবক্ষয় ঘটেছে আমাদের সমাজে। কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে আমাদেও নৈতিকতা আর মূল্যবোধ। আমরা যেন অন্ধকারের সিঁড়ি বেয়ে আরো গাঢ় অন্ধকারের দিকে যাচ্ছি। আমাদের চারপাশ ছেয়ে ফেলেছে খুন, হত্যা, রাহাজানি আর অরাজকতা। হাহাকার, পাপ, ক্ষয়, নীতিহীনতা, অন্যায়, নিরাপত্তাহীনতা আর বিচারহীনতা নিয়ে আমরা যেন একটা মৃত্যুপুরীর দিকে যাত্রা করছি। আমরা যদি এখনই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, যদি আমাদের মূল্যবোধ আর নৈতিকতাবোধ শাণিত করতে না পারি, যদি আমাদের মানবতাবোধকে জাগরিত করতে না পারি তবে আমরা উন্নয়নের যতোই দম্ভ করি না কেন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে নিজেদের যতই প্রতিষ্ঠিত করি না কেন, এবং আমাদের মাথাপিছু আয় যতই বৃদ্ধি করি না কেন, সামাজিক এই অবক্ষয় গ্রাস করে নেবে আমাদের সবকিছু আর আমরা তলিয়ে যাবো বোধহীনতার কালো অন্ধকারে, সেখান থেকে কেউ আর আমাদের উদ্ধার করতে পারবে না। কিছু পরিসংখ্যান নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ে কাজ করা বেসরকারী সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ৮৯৫টি শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০৩টি শিশু খুন হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী ও শিশুদের মধ্যে ১৮ বছর বয়সের নিচের শিশু-কিশোরীরাই বেশি। যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তাদের মধ্যে ১০২ জনের বয়স সাত থেকে ১২ বছর, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়স ৯৭ জনের, অনুর্ধ ছয় বছর বয়স ৫৯ জনের। আর বড়দের মধ্যে ধর্ষণের শিকার ১৯ থেকে ২৪ বছর ২৭ জন, ২৫ থেকে ৩০ বছরের ১৬ জন এবং ৩০ বছরের বেশি বয়সীর সংখ্যা ১৭। যদিও এ ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ৩১২ জনের বয়স যেমন প্রকাশ করা হয়নি আবার মোট ৬৩০টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৪৩২টি। ধর্ষণের পর যাদের খুন করা হয়েছে তাদের মধ্যেও শিশুরাই বেশি। বিশেষ করে, ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে অনুর্ধ ছয় বছর বয়সের পাঁচজন, সাত থেকে ১২ বছর বয়সের সাতজন এবং ১৩ থেকে ১৮ বছরের ৯ শিশুকে। অন্যদিকে ধর্ষণের পর খুন হওয়া বড়দের মধ্যে ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সের দু’জন, ২৫ থেকে ৩০ বছরের দু’জন এবং ৩০ বছরের ওপরের বয়স চারজনের। আসকের প্রতিবেদন অনুসারে ধর্ষণ ও অন্যান্য কারণে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত অনুর্ধ ছয় বছর বয়সী শিশু নিহত হয়েছে ৪১ জন, সাত থেকে ১২ বছর বয়সের খুন হয়েছে ৩৮ জন এবং ৯৪ জন খুন হওয়া শিশুর বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর। অবশ্য এর বাইরে ৩৮ শিশুর হত্যাকে রহস্যজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যসূত্র থেকে আসক এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলে জানান ওই প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র উপপরিচালক নিনা গোস্বামী। ফিরে দেখা অতীত বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফের) দেখা গেছে, ২০১৭ সালে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয় ৫৯৩ শিশু। ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৬২ শিশু। ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ২২ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে সাত শিশু। ২০১৭ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৭০ শিশু ওই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে আর সারাদেশে ৪৪ জন প্রতিবন্ধী শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ওই বছরে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৪৬ শিশু। আর ধর্ষণ চেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৩৪ শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ২১ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে দুই শিশু। ২০১৬ সালের এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৮ শিশু ওই বছর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। এ ছাড়া সে বছর ৪২ প্রতিবন্ধী শিশুও ধর্ষণের শিকার হয়। বিএসএএফের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৫২১ শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল ১৪৩ শিশু। এ ছাড়াও ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয় ৩০ শিশুকে এবং ধর্ষণের পরে আত্মহত্যা করে চার শিশু। ২০১৪ সালে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৯৯ শিশু। আর ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ২১ শিশু। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের নবেম্বর মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত চার বছরে সারাদেশে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৩১ শিশুকে। এ ছাড়া ধর্ষণের পর অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ১৯ শিশু। আইন ও সালিশকেন্দ্র (আসক) বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৮ পর্যবেক্ষণে জানায়, ২০১৮ সালে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের শিকার হয় ৪৪৪ শিশু। নারী ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৩২ জন। এর মধ্যে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৩ জন ও আত্মহত্যা করেছেন ৭ নারী।
×