ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আলমগীর সাত্তার

আমার পাইলট লাইসেন্স এবং থানাবুলা খান

প্রকাশিত: ১১:৫৭, ১৯ জুলাই ২০১৯

আমার পাইলট লাইসেন্স এবং থানাবুলা খান

বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান পাইলট চার্লস লিন্ডবার্গকে নিয়ে একখানা বই লিখতে শুরু করেছি। লিন্ডবার্গ এমনই সুদর্শন ছিলেন যে তাঁকে নর্ডিকগড বলেও সম্বোধন করা হতো। নরওয়ে, সুইডেন, স্ক্যানডিভিয়ার অধিবাসীদের বলা হয় নর্ডিক জাতি। লিন্ডবার্গের পিতামহ ওলা ম্যানসন। তিনি ছিলেন সুইডেনের পার্লামেন্টের সদস্য। তাঁর প্রথম স্ত্রীর গর্ভে তাঁর তখন ছয়টি সন্তান ছিল। ওই বয়সে লোভিসা নামের এক সুন্দরী যুবতীর সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লোভিসার গর্ভে জন্ম হয় লিন্ডবার্গের পিতার। লোভিসা এবং তাঁর শিশুপুত্রকে নিয়ে ওলা ম্যানসন চলে আসেন আমেরিকায়। আত্মপরিচয় গোপন করার জন্য আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করার সময় ওলা ম্যানসন নিজের নামকরণ করেন আগস্ট লিন্ডবার্গ। পুত্রের নাম রাখেন চার্লস আগস্ট লিন্ডবার্গ। সংক্ষেপে সিএ লিন্ডবার্গের পুত্রই হলেন, বিশ্ববিখ্যাত পাইলট চার্লস আগস্টাস লিন্ডবার্গ। লিন্ডবার্গ ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসে আমেরিকার সামরিক বিভাগের ফ্লাইং শাখায় ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করলেন। প্রথমে তাদের অনেকগুলো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে হলো। ওইসব বিষয়ে গড়ে ৯৭.৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে লিন্ডবার্গ প্রথম স্থান লাভ করলেন। এরপর শুরু হয় ফ্লাইং প্রশিক্ষণ। একবার বেশি ভাল ফ্লাইং করার জন্য তো তাঁর ফ্লাইং স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার অবস্থা হয়েছিল। সেবার একদিন ১৮ জন ফ্লাইং ক্যাডেটের একটি ট্র্যাঙ্গুলার ক্রসকান্ট্রি ফ্লাইট করার পরীক্ষা ছিল। যেমন মনে করা যাক, ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রওনা করে প্রথমে বরিশাল বিমানবন্দরে অবতরণ করতে হবে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসতে হবে। পরীক্ষাটা ছিল অনেকটা অমন ধরনের। লিন্ডবার্গের পরীক্ষা ছিল প্রত্যেক ক্যাডেট পাইলট কেলি নামের বিমান ঘাঁটি থেকে একাকী যাত্রা করে গঞ্জালেস নামের বিমানবন্দরে গিয়ে সেখানকার বিমানবন্দরের ম্যানেজারের স্বাক্ষর নিয়ে কিউরো নামে ছোট আর একটি বিমানবন্দরে যেতে হবে। আবার ওখানকার বিমানবন্দর ম্যানেজারের স্বাক্ষর নিয়ে কেলি বিমান ঘাঁটিতে ফিরে আসতে হবে। প্রত্যেক ক্যাডেট পাঁচ মিনিট পর পর যাত্রা করবে। লিন্ডবার্গের সিরিয়াল নম্বর ছিল তিন। এর অর্থ প্রথমজনের চেয়ে তিনি দশ মিনিট পরে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু ট্র্যাঙ্গুলার ক্রসকান্ট্রি ফ্লাইট সম্পন্ন করে সবার আগে তিনি ঘাঁটিতে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর লগবুকে কিউরো বিমানবন্দরের ম্যানেজারের স্বাক্ষর ছিল না। এতে করে লিন্ডবার্গের উর্ধতন কর্তাব্যক্তিরা মনে করলেন, লিন্ডবার্গ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি আদপেই কিউরো বিমানবন্দরে যাননি এবং ওখানে না গিয়ে সরাসরি ঘাঁটিতে ফিরে এসেছেন। লিন্ডবার্গ কিউরো বিমানবন্দরের সবকিছুর স্কেচ করে দেখালেন। কিন্তু কর্তাব্যক্তিরা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। অবশেষে জানা গেল, ঐদিন অনেক বিলম্বে কিউরো বিমানবন্দরের ম্যানেজার তাঁর অফিসে পৌঁছেছিলেন। পিআইএ (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স) করাচীতে একটি ফ্লাইং একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ওই একাডেমি থেকেই আমি পাইলট লাইসেন্স পেয়েছিলাম। তখন নিয়ম ছিল পাইলট লাইসেন্স পেতে হলে একটি ট্র্যাঙ্গুলার ক্রসকান্ট্রি ফ্লাইটের পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হবে। পরীক্ষা নেবেন পাকিস্তান সিভিল এ্যাভিয়েশন বিভাগের একজন ফ্লাইট ইন্সপেক্টর। আমার ক্রাসকান্ট্রি ফ্লাইটটি ছিল করাচী থেকে হায়দ্রাবাদ। সেখান থেকে মরুভূমির মাঝে ‘থানাবুলা খান’ নামের একটি গ্রামের ওপর পৌঁছে ফিরে যাব করাচী। করাচী থেকে হায়াদ্রাবাদ যাওয়া বেশ সহজ ব্যাপার। হায়দ্রাবাদ হলো সিন্দু প্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। করাচী থেকে ওই শহরের দূরত্ব এক শ’ মাইলের চেয়ে খানিকটা বেশি। দুই আসন বিশিষ্ট সেসনা-১৫০ প্লেনে যেতে সময় লাগত এক ঘণ্টা পনেরো থেকে বিশ মিনিট। সমস্যা ছিল, হায়দ্রাবাদ থেকে থানাবুলা খান যাওয়া। ওখানে কোন বিমানবন্দর ছিল না। ছিল না কোন রেডিও বাকন। রাস্তাঘাট ছিল না। ছিল কেবল বিশ পঁচিশখানা মাটির ঘর। কোন গাছপালাও ছিল না। ওখানে পৌঁছানোর উপায় ছিল কেবল রেডিও কম্পাস এবং সময়ের হিসাব অর্থাৎ প্লেনের গতিবেগ হিসাব করে ডিআর (DEAD RECONING) নেভিগেশনের মাধ্যমে। সময় হিসাব করে দেখছিলাম, আমার থানাবুলা খানের ওপর পৌঁছে যাওয়ার কথা। প্লেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থানাবুলা খানের কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না। আমি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এমন সময় একটা দমকা বাতাসের কারণে আমার প্লেনের সম্মুখ ভাগ কিছুটা নিচু হলো। আর ঠিক সামনেই দেখতে পেলাম থানাবুলা খান গ্রামখানা। আমার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন যে ফ্লাইট ইন্সপেক্টর তিনি অবশ্যই সময়ের হিসাব রাখছিলেন। আমাকে নিশ্চিত মনে ফ্লাই করতে দেখে তিনি মনে করলেন আমি ওই গ্রাম দেখতে পাইনি এবং গ্রামখানা অতিক্রম করে গিয়েছি। তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, কোথায় থানাবুলা খান? আমি প্লেনের একদিকের ডানা একটু কাত করে তাঁকে দেখালাম, আমরা থানাবুলা খানের ওপরেই আছি। এরপর বলতে হবে না যে আমি পাস করে গেলাম। এক সপ্তাহ পর কমার্শিয়াল পাইলট লাইসেন্সও হাতে পেয়ে গেলাম। বিষয়টা প্রায় ষাট বছরের আগের ঘটনা। এখনও আমি থানাবুলা খানের কথা ভুলে যাইনি। তখনও ভেবেছি, এখনও ভাবি, যেখানে গ্রীষ্মের সময় দিনের তাপমাত্রা থাকে ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। কোথাও গাছপালা নেই, কাছাকাছি কোন গ্রামও নেই, সেখানে কয়েকটি মাটির ঘরে কিছু মানুষ বাস করে কেন? এর উত্তর আমার জানা নেই।
×