ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সাহিত্যে বর্ষা

প্রকাশিত: ১১:৫৮, ১৯ জুলাই ২০১৯

 সাহিত্যে বর্ষা

বাংলা কবিতায় বর্ষার বন্দনা হয়েছে সেই মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত। বর্ষা আর বৃষ্টি এখন কবিতার একটি অংশ। এমন কোনো কবি নেই বর্ষাকে কেন্দ্র করে দু’একটি পঙক্তি রচনা করেননি। ‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়- এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায়’ - (রবীন্দ্রনাথ, বর্ষার দিনে) বৃষ্টির আবেদন চতুর্মুখী। বৃষ্টির অপরূপ দৃশ্য আমাদের মনে কুহক জাগায়। মায়াবি রূপ আমাদের মোহিত করে, আন্দোলিত করে শিহরিত করে। ঋতু পরিবর্তিত চিরায়ত ধারায় আষাঢ়-শ্রাবণ এ দুই মাসকে ঘিরে আমাদের বর্ষাকাল। বর্ষাকালে আকাশ থাকে গুরুগম্ভীর কালো মেঘের ভারে নিরন্তর অবনত। গর্জন, মেঘবর্ষণের বিপুল দাপট চলে এ দুই মাসে। বাংলা সাহিত্যে ষড়ঋতুর প্রভাব ও প্রতিপত্তি বহুদূর-সঞ্চারী। বর্ষার চরিত্র বা সৌন্দর্যের যে বহুগামী বৈচিত্র্য তা অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে স্বতন্ত্র। এ স্বতন্ত্র বর্ষা ঋতুকে নিয়ে কবিদের কবিতায় বর্ষার রূপ বা সৌন্দর্য ধরা দিয়েছে নানান অভিপ্রায়ে। কবিমনে বর্ষার প্রভাব চমৎকার! বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ঋতুভিত্তিক সাহিত্যে বর্ষা নিয়েই বেশি সাহিত্য রচনা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে কাজী নজরুল বা পল্লীকবি জসীম উদ্দিন কিংবা তিরিশের কবিরাও বর্ষা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। রবি ঠাকুরের প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষা। বর্তমানকালের কবিরাও বর্ষায় প্রভাবিত। রোমান্টিকতায় ভরপুর বর্ষা ঋতু। জীবনানন্দ যেমন হেমন্তে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন রবি ঠাকুর তেমনই বর্ষায় প্রভাবিত হয়েছেন। কারণও আছে। জমিদারি সূত্রে তিনি বাংলাদেশের শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুরে নদীপথে প্রায়ই আসতেন। বর্ষায় যৌবনভরা নদীদের নৈসর্গিক দৃশ্য সৃষ্টি হয়! বাঁকেবাঁকে রূপ বদলায় প্রকৃতি। এ কারণেই রবিসহ কবি-সাহিত্যিকগণ বর্ষায় প্রভাবিত বেশি হয়ে থাকেন। বর্ষায় কাজের ব্যস্ততা কম থাকে। বিধায় অলস সাথে রোমান্টিক কখনও বিরহের সাহিত্য সৃষ্টি হয় বর্ষাতেই। আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে। গাছে কদম ফুল আর বৃষ্টির পরশ। কেয়া বনে খেলা করে কেতকী। গরমের দাপট কমাতে বর্ষার আগমন। বৃষ্টির জল গায়ে নৃত্য করে পশুপাখি। তাই বলা যায়, বর্ষা কেবল ঋতুই নয়, বাঙালীর সংস্কৃতির অংশও বটে! বর্ষার সতেজ বাতাসে জুঁই কামিনী, দোলনচাঁপা, রজনীগন্ধা, বেলি, কদম-কেয়া আরও কত ফুলের সুবাস! পুকুরে রঙিন হয়ে ফোটেপদ্ম। কেয়ার বনে কেতকীর মাতামাতি, নাচানাচি, দুরন্ত বালক-বালিকার জলক্রীড়া! চমৎকার সব দৃশ্য ভাবুক ও সমৃদ্ধিশালী করে তোলে কবি মনকে। বর্ষায় বিভিন্নরকম ফুল ফোটে। চারদিকে ফলের বাহার। নদী-খাল-বিলে পলিপানি আর মাছে ভরপুর। এক মোহিনীয় দৃশ্য সৃষ্টি হয় বর্ষাকালে। বিরহও জাগে। তাইতো কবি নজরুল বর্ষাতে বিরহের সাহিত্য রচনা করেছেন। নতুন প্রজন্মও রোমান্টিক ও বিরহের উভয়ক্ষেত্রে সাহিত্য রচনা করছেন। বিশেষ করে ছড়া-কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীত বিতানেই শুধু বর্ষা নিয়ে গানের সংখ্যা ১২০টি। বর্ষা আসে চিরায়ত সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে। তাইতো তিনি যথার্থই বলেছেন : ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না মেঘমল্লারে সারাদিনমান বাজে ঝরনার গান মন হারাবার আজি বেলা পথ ভুলিবার খেলা।’ জাতীয় কবি নজরুল বর্ষায় প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি বিরহের কবিতা-গান লিখেছেন। ’বর্ষা বিদায়’ কবিতায় নজরুল গেয়েছেন : ‘যেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি চলিতে চলিতে চমকে ওঠ না কবরী ওঠে না দুলি যেথা রবে তুমি ধেয়ানমগ্ন তাপসিদী অচপল তোমায় আশায় কাঁদিবে ধরায়, তেমনি ফটিক জল।’ বর্ষা নিয়ে জসীম উদ্দীনও বাদ যাননি। বাদ যাওয়ার কথাও না! তিনি যে পল্লী কবি! ’পল্লী -বর্ষা’ কবিতায় তিনি লিখলেন- ‘গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায় গল্প গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়! কেউ বসে বসে কাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রশি; কেফবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাকা বাঁধে কষি কষি। মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে আমির সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে। বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু মেঘ ডাকে, এসবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপ আঁকে।’ কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা বর্ষা নিয়ে লিখেছেন : ’বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে মনে মনে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বনে বনে বৃষ্টি পড়ে মনের ঘরে চরের বনে নিখিল নিঝুম গাও গেরামে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে।’ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি, প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বর্ষাকে এড়িয়ে যাননি। বাংলা ভাষার শুদ্ধতম এ কবির কবিতায় বর্ষা এসেছে আরও কাছ ঘেঁষে। ’এ জল ভাল লাগে’ কবিতায় কবি বলেছেন : ‘এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে; এই জল ভালো লাগে; নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে- বনের ভিতর বার বার উড়ে যায়, তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে...’ পল্লী কবি জসীম উদ্দীনের কবিতায় বর্ষা এসেছে আরেক রকম ব্যঞ্জনা হয়ে। তিনি উদাস হয়ে দেখেছেন বর্ষার রূপ। সে রূপে এমনই ব্যাকুল হয়েছেন যে তিনি কোন পথ আর খুঁজে পান না, সব পথই আনন্দে ভরপুর : ‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলো কেশ, মন যেন চায় কারে.. মাইকেল মধুসূদন দত্ত ’বর্ষাকাল’ কবিতায় লিখেছেন : ‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর রমণী রমন লয়ে সুখে কেলি করে দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।’ বর্ষাকে নিয়ে মহাদেব সাহা লিখেছেন : ‘বর্ষা, তোমাকে না হয় আরো একটু টেনে বলি বরষা পদাবলির ঢংয়ে বর্ষা শুনে নাকি কারো মন খারাপ হয়ে যায় বিরহ জাগে; আমার কিন্তু বৃষ্টি খুব ভালো লাগে, বৃষ্টি আমার শৈশবের মতো মেয়েরা ভিজতে চায় বৃষ্টিতে ভিজুক না মেয়েরা জলে না নামলে পদ্মফুল ফুটবে কেন।’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী বর্ষার চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন : ‘সখি, নব শ্রাবণ মাস জলদ-ঘনঘটা, দিবসে সাঁঝছটা ঝুপ ঝুপ ঝরিছে আকাশ! ঝিমকি ঝম ঝম, নিনাদ মনোরম, মুহুর্মুহু দামিনী-আভাস! পবনে বহে মাতি, তুহিন-কণাভাতি দিকে দিকে রজত উচ্ছ্বাস।’
×